গল্প : মেঘের রং কালো
লেখক : সাঈদ আজাদ
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
সাঈদ আজাদের “মেঘের রং কালো” শিরোনামের এই ছোটগল্পটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্টের দেয়াল থেকে নেওয়া হয়েছে। এই লেখার অবস্থান, প্রেক্ষাপট এখন অবদি জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হবে।
![]() |
মেঘের রং কালো || সাঈদ আজাদ |
মেঘের রং কালো || সাঈদ আজাদ
(ক)
বাবা, মুরগির রান আরেকটা দেই তোমারে? বলতে বলতে মনোয়ারা হাসানের পাতে বাটি ভর্তি মাংস পুরোটাই ঢেলে দেয়।
না না চাচী, আর দিয়েন না।...সব নষ্ট হইব। এতক্ষণ ধইরাত খাইলামই।
হাসান কাজ করে মালয়েশিয়াতে। আজ বাড়ি এসেছে। প্রায় নয় মাস পর এল। খুব সকালেই পৌছেছে বাড়ি। নাস্তা খেয়ে দুপুরতক ঘুমিয়ে অনেকক্ষণ ধরে টিউবওয়েলের পানিতে গোসল সেরেছে। আগে আগে বাড়ি থাকতে পুকুরেই করত গোসল। কিন্তু আজ সকালে পুকুরে গা হাত মুখ ধুয়ায় পর দারুণ কুটকুট করেছে। অনেক দিন অভ্যাস নেই। চুলকাতে চুলকাতে শরীরের এখানে ওখানে লাল চাকা চাকা হয়ে গেছে। দুপুরে আর তাই পুকুরে নামার সাহস হয়নি।
মেঝ চাচার ঘরে দুপুরে খেতে এসেছে হাসান। দাওয়াত ছিল। প্রথমে রাজী হতে চায়নি। কিন্তু মনোয়ারা এত পিড়াপিড়ি করল, শেষে আর না করতে পারেনি।...পুরো টেবিলেই বিভিন্ন রকম তরকারির বাটি সাজানো। মনোয়ারা নিজে বসে পরিবেশন করেছে।
একী বাবা, দুধটা ফালাইয়্যা রাখলা যে!...গাছ পাকা আম আছে ঘরে। চিনির মত মিষ্টি। কয়টা ভাত নিয়া মাইখ্যা খাও ।
না চাচী, পেটে আর জাগা নাই। বহুত খাইছি। খাসির মাংস মুরগির মাংস চিংড়ি মাছ রুই মাছ কই মাছ... খাইলামত সবই। একজন মানুষ আর কত খাইতে পারে।
কী আর এমন খাইছ। বিদেশে থাইক্যা তোমার পেটই ছোট অইয়্যা গেছে। আমার জামাইরা এক একজন মাশাল্লা খাইতে পারে ভাল। তাগ খাওইয়্যাও সুখ আছে।...কত আশা করছিলাম, তোমারেও তাগ লগে বসাইয়্যা খাওয়ামু। কপালে হইল না।...তা বাবা, অনেক্ষণ ধইরা ভাবতাছি তোমারে একটা কথা কই। কিন্তু কইতে বাধে। আবার কী মনে কর!
কী এমন কথা, কন না চাচী। হাত ধুতে ধুতে বলে হাসান।
থাক। কইয়্যা কাজ নাই, ভাববা যে চাচী বানাইয়্যা কথা কয়। আবার শত্রু ভাববা আমারে।
আপনে কি চাচী কুসুমের বিষয়ে কিছু কইতে চান?
তুমি বাবা বুদ্ধিমান পোলা। আগেও দেখছি, না কইতেই বুঝ কী কইতে চাই। আমগ মনিরাও এমনই। কওয়ার আগেই সব বুঝে। আহা কত ইচ্ছা ছিল তোমার লগে মনিরার... কইতেছিলাম, তুমিত মাসের পর মাস থাক বিদেশে। তা বাবা, বউয়েরওত একটু খোঁজ খবর রাখতে হয় ।
কেন চাচী। দুই চারদিন পর পরইতো ফোনে কথা হইত।
তা ফোনে কি আর সব খবর জানা যায় বাবা।...তয় এইটাও ভাবি, তোমার কানে কী কথাটা কেউ তুলতে পারল না। তোমার মা ভইনারাত আর চোখ বন্ধ কইরা চলে না।
কী ব্যাপার চাচী। আমিত কিছুই বুঝতে পারতাছি না।
কথাটা কেমনে যে কই। তুমি হইলা আমার পোলার মত। ... তা বাবা, নিজের চোখে না দেখলে আমারও বিশ্বাস হইত না।... থাক বাবা, না হয় নাই-ই কইলাম। জোয়ান বয়সে অমন একটু আধটু হয় কারো কারো। তয়, বড় মুখ কইরা কইতে পারি বাবা, আমার মেয়েরা আবার এমন না। যেই শাসনে রাখি আমি! আমার কথা ছাড়া বাড়ির বাইরে পাওটাও রাখে নাই কেউ। চাইর মেয়ের কেউ-ই না।...ঘরে পাতা দই আছে বাবা, দেই একটু। খাও। শরীলটা ঠান্ডা হইব, হজমটাও ভাল হইব। ... ও মনিরা, গেলি কই! হাসানরে একটু দই দে। আলমারিতে আছে দেখ।
না চাচী, পেটে এক কণাও জাগা নাই। আর কিছু খামু না।... কুসুমের কথা কী কইতে চাইছিলেন!
তা দেকছেত গ্রামের সবাই। ...কইলে দোষ হইব একলা আমার।
মা, দই নিয়া আইছি। মনিরা দরজায় এসে দাঁড়ায়।
কীরে, শরমের কী আছে!...হাসানরে মনে হয় আইজ প্রথম দেখলি? ভিতরে আয়।
মনিরা নড়ে না। নত মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল মাটিতে ঘষে।
থাক চাচী। কইলামত দই খামু না। কুসুমরে নিয়া কী কইতেছিলেন।
তুমিত কুসুমরে বিয়া কইরা তিন মাস পার হওয়ার আগেই গেলাগা মালোশিয়া।... পরথম পরথম বাড়ির বাইরে পাও দিত না কুসুম। আস্তে আস্তে কী যে হইল! মেয়েটা যে খারাপ তা কই না। আসলে বয়সেরই দোষ।...কুসুমের মামাত ভাই হিরারেত চিনই।... কী আর কমু, তুমি বোধহয় পেলেনে উঠ্যাও সার নাই। হিরা বাড়ি আইসা হাজির।... সময় নাই অসময় নাই দুইজনের এইখানে সেইখানে ঘুরাঘুরি।... হাসাহাসি। এই পুকুরে যায় গোসল করতে। এই কলেজে যাওয়ার নাম কইরা বাইর হয়।...একদিন দেখি দুইজনে হাত ধরাধরি কইরা পাটখেতে ঢুকে। নিজের চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতাম না।... আমারত সন্দেহ হয় কুসুমের পেটের বাচ্চাটা ...
মা জানালাটা বন্ধ কর। হঠাৎ মনিরা চেঁচিয়ে উঠে। বৃষ্টি শুরু হইছে।
অত চিল্লানির কী হইল! আষাঢ় মাসেত বৃষ্টি নামবই।
তা বৃষ্টিটা নামল ঝমঝমিয়েই। চারপাশ আঁধার করে। টিনের চালে কেমন একটা শব্দ হচ্ছে। কতদিন পর শব্দটা শুনল হাসান। বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে মনটা খারাপ হয়ে গেল।...মনোয়ারা চাচী যা বলল, সে সব কি ঠিক? তা এত বড় মিথ্যেইবা বলতে যাবে কেন মনোয়ারা? হাসানের মাথার ভেতরে কেমন শূন্য শূন্য লাগছিল।
লক্ষণ যা দেখতাছি, বৃষ্টি কমতে সময় লাগব। আমি কই কী বাবা, তুমি আমগ ঘরেই একটু কাত হইয়া থাক।...কইরে মনিরা, চৌকিতে তোলা চাদরটা বিছাইয়্যা দে। হাসান একটু শুইব।
মনিরা সাড়া দেয় না। চাদরও দিয়ে যায় না। তবে মনিরা যে পাশের ঘরে আছে বুঝতে পারে হাসান। হয়তো লজ্জা পাচ্ছে। মনোয়ারা এক সময় মনিরার সাথে হাসানের বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। প্রায়ই হাসানকে এটা সেটা রান্না করে ডেকে ডেকে খাওয়াত। মনিরার বিভিন্ন গুণের কথা বলত। ঠিক কালো বলে নয়, মনিরাকে এমনিই পছন্দ না হাসানের। কিন্তু সেটা কখনো ও মুখ ফুটে বলতে পারেনি। মনোয়ারা বুঝি মৌনতাকে সম্মতি বলেই ধরে নিয়েছিল।...তবে হাসানের মা আগেই নাকি ছোট জায়ের বড় মেয়ে কুসুমকে হাসানের জন্য পছন্দ করে রেখেছিল। বিদেশ যাওয়ার আগে যখন কথাটা বলল রেহানা, তখন আর দ্বিমত করেনি হাসান। বলতে কী কুসুমকে মনে মনে হাসানও পছন্দ করত। সেটা অবশ্য কুসুমকে কখনোও বলেনি। তা কুসুমকে কেই-বা পছন্দ না করবে। আশেপাশের দু-দশ গ্রামে কুসুমের মত সুন্দর মেয়ে আছে! যেমন গায়ের রঙ তেমন চেহারা। সংসারের কাজে কামে পটু। স্বভাবেও ভারি নম্র। লেখাপড়ায়ও খারাপ না। এসএসসি পাশ করে ইন্টারে ভর্তি হয়েছিল। বিয়ের পর অবশ্য কলেজে যাওয়া ছেড়েছিল। তা চাচীতো বলল, আবার নাকি কলেজে যাচ্ছে কুসুম।...মনটা খচখচ করছে হাসানের। মনোয়ারার কথা বিশ্বাস করতে মন চায় না। অবার যেন অবিশ্বাসও হয় না।
বৃষ্টির বেগ বেড়েছে আরো। সেই সাথে জোড়ালো বাতাস। বাইরে বুঝি ঝড়ই হচ্ছে।
খ.
ধামার মত পেটটা নিয়ে একটু হাঁটলেই হাঁপ ধরে যায়। উঠানটা হেঁটে পার হয়ে এসে খাটে বসে বড় বড় শ্বাস নেয় কুসুম। সন্ধ্যা হয়েছে কখন। দুপুর থেকে বৃষ্টি হয়ে হয়ে খানিক আগে থামল। গরমটা কম লাগছে এখন। ঘরের ভেতর অন্ধকার। সুইচ টিপে আলো জ্বালে। আলো জ্বালতে দশ পাও হাঁটেনি। তাতেই কী কষ্ট।...হাসান কখন এল! দেখেনিত কুসুম। শুয়ে ছিল। আলো জ্বালাতে চোখে হাত দিয়েছে। বোধহয় ঘুমাচ্ছিলই। আলো জ্বালাতে ঘুম ভেঙ্গেছে। কুসুম জানে, আলো থাকলে ঘুমাতে পারে না হাসান।
আপনে না মুনিরাগ ঘরে ছিলেন। আসলেন কখন? দেখলাম নাত! ...লাইট নিভাইয়্যা দিমু? চোখে আলো লাগে?
আমি ঘরে না থাকি এইটাই চাও তুমি, না?
ও আল্লা, তা চামু কা! আমারত মনে হয় সারাক্ষণই আপনের পাশে বইসা থাকি। ...কতদিন পরে আপনে আসলেন! জানলার পাশে খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে বসে কুসুম। উঁচু পেটটাকে যথাসম্ভব ঢেকেঢুকে রাখে।...মায় আপনের জন্য চাউলের রুটি আর কষা মুরগির মাংস রানতেছে। আমিই কইছি রানতে। জানিত আমি, আপনে কষা মুরগির মাংস দিয়া চাউলের রুটি পছন্দ করেন।
খিদা নাই।
খাইছেনত সেই দুপুরে। রাতের খাওনের সময় হইতে হইতে খিদা হইব।...বাবুর কী নাম রাখবেন ঠিক করছেন?
আইচ্ছা আমি মালোশিয়া যাওয়ার পরে হিরা আসত বাড়িতে?
আসতত। বাজার সদাই কইরা দিত। ... আজকাওত আসছে। হিরা ভাই-ইত মুরগি জবাই কইরা দিল। এতক্ষণত হিরা ভাইয়ের লগেই কথা কইতেছিলাম।
বইসা বইসা তার লগেই গপসপ করলে হইত। আমার কাছে কী?
আপনে রাগ করছেন?...আমি মনে করছিলাম আপনে এখনো মনিরাগ ঘরে। আসার কোন সাড়া শব্দত পাই নাই।
হিরা প্রায়ই আসত, না? হাসান শোয়া থেকে উঠে বসে।
কইলাম না, বাজার সদাই কইরা দিতে আসত। আপনে যাওয়ার পর পরইত আববায় বিছানায় পড়ল। ইবরাহীম আর ইসমাইল দুইজনইত ছোট। বু্ইজ্যা শুইন্যা বাজার করতে পারে না। পচা মাছ আর বাসি তরকারি আনে।...আপনে হাত মুখ ধু্য়্যা লন। আমি দেখি, রান্নার কী হইল। কুসুম বের হয়ে যায়।
হাসান কুসুমের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন ধীরে ধীরে হাঁটছে কুসুম। উঠানটা পার হতেই কত সময় লাগছে।... রান্না ঘরের কাছে যেতেই হিরা হাসতে হাসতে বের হয়ে আসে। দেখতে হিরা হাসানের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। লম্বা। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং। ধারাল পুরুষালি চেহারা। হিরাকে দেখে কেমন বিতৃষ্ণায় মন ভরে উঠে। সুন্দর শয়তান।
দুলাভাই, ইবরাহীম ঘরে ঢুকে। আপনার জন্য খাওন বাড়ছে খাইতে আসেন।
তোমার আপারে না কইছি, খিদা নাই আমার। আবার তোমারে পাঠাইছে কেন!
কী এমন খাইছেন, সারাদিন যাওয়ার পরও খিদা লাগে না। আসেনত। রেহেনা চাচীও আমগ ঘরে। আপনে গেলে খাইতে বসব।
ইবরাহীম, আমার পেটটা ভালা না ভাই। খাইতে ইচ্ছা করতাছে না। মারে, চাচীরে কইস বুঝাইয়্যা। যাওয়ার সময় লাইটটা নিভাইয়্যা দিয়া যাইস।
কিরে হাসান, রেহেনা ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালায়। ঘর অন্ধকার কইরা শুইয়্যা রইছস! তর চাচীয়ে এত কষ্ট কইরা সব রাঁনল খাইতে গেলি না। হইছে কী তর? শরীল ঠিক আছে? জ্বরজারি বাধাস নাইত আবার। না করলাম, তাও কালকা পুষ্কুণীতে নামলি গোসল করতে।...রেহেনা হাসানের কপালে হাত রাখে। না, শরীলত ঠিকই আছে।
কিছু হয় নাই মা। এমনি খাইতে ইচ্ছা করতাছে না। দুপুরের খাওনটা বেশি হইয়্যা গেছিল। অনেকদিন অভ্যাস নাইত।
মালোশিয়া কি পেট ভইরা খাইতি নারে হাসান? শরীলটাও যেন শুকাইয়্যা গেছে।
না মা, খাইছি ঠিকই। ঐখানে কাজেকামে থাকি...ইচ্ছা কইরাই মাপমত খাই। আজকা দুপুরে বেশিই হইয়্যা গেছে খাওয়াটা। পেট ভারী ভারী লাগতাছে।
কী দরকার আছিল মনোয়ারার ঘরে খাওয়ার। কতদিন পরে আইলি, আমরা কি কম আয়োজন করছি।... গলা উঁচিয়ে বলে রেহেনা, এমনেত আমার কথামত কুসুমরে বিয়া করছস বইল্লা হিংসায় বাঁচে না। আমারেও দেখতে পারে না দুইচোখে। আমার পুতেরে আবার দাওয়াত দিয়া খাওয়ানের কী দরকার!... সেই কখন থাইক্যা শুইয়্যা রইছস, বলতে বলতে স্বর নরম হয় রেহেনার। উঠ্যা একটু হাঁটাচলা কর বাবা। ভালা লাগব। হাঁইট্যা টাইটা্যা খাইতে আয়। এত আয়োজন করছে, না খাইলে চাচী কষ্ট পাইব।
আচ্ছা, যাও তুমি। এত কইরা কই খিদা নাই...
হাসান আগেই এসেছিল। খাওয়া শেষে কুসুম ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে, দরজা ঠেলে দেয়। পা ছড়িয়ে খাটের বাজুতে ঠেস দিয়ে বসে। জানালা দিয়ে দেখা যায় আকাশে মস্ত একখানা চাঁদ হাসছে। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে তুমুল স্বরে। মাঝে মাঝে ব্যাঙও।...দেখছেন, কী সুন্দর চাঁদ আকাশে। কুসুম জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে, জোছনা কী ফকফক করতাছে! আষাঢ় মাসের জোছনা এমন জোরালই হয়। গত আষাঢ় মাসে আমগ বিয়া হইছিল। দেখতে দেখতে বছর ঘুরল। সময় কত তাড়াতাড়ি যায় না!...এতদিন একটা কথা কই নাই আপনেরে, আপনেরে কইলাম আমি বিয়ার আগে থাকতেই পছন্দ করতাম। আপনে বুঝতেন?
হাসান কোন কথা বলে না।
বাবুর কী নাম রাখবেন, ঠিক করছেন কিনা কইলেন না ত?
হিরা কয় নাই কি নাম রাখবা?
হিরা ভাইত সবখানেই আছে। কুসুম হাসে। মেয়ে হইব শুইন্যাই বলে নাম ঠিক কইরা রাখছে।
তোমার মুখে দেখি হিরা ছাড়া কথা নাই।...মনোয়ারার কথাগুলো কানে বাজে হাসানের। মাথার দু‘পাশে ভেতরে কেমন দপদপ করতে থাকে।...তা কী নাম ঠিক করছে তোমার হিরা ভাই?
কী নাম ঠিক করছে কয় নাই আমারে।
হিরা যেই নাম ঠিক করছে সেইটাই রাকখ্যো। আমার কাছে নাম চাওয়ার দরকার কী।
আপনের কী হইছে কনত? কেমন জানি কথাবার্তা কইতাছেন!
তুমি হিরার লগে বড় পুষ্কুণীতে গোসল করতে গেছিলা?
গেছি একলা নাকি? মনিরা শাহিদা কাজল সবাই মিল্যাইত গেছি।
হিরার লগে পাট খেতেও কি সবাই মিল্যা ঢুকছিলা?
কেমনধারা কথা কন!
একজন আমারে কইছে, নিজের চোখে হিরার লগে তোমারে পাটখেতে ঢুকতে দেখছে।
যেই কউক মিছা কইছে।...এতবড় মিছা কথাটা আপনে বিশ্বাস করলেন! আমারে আপনে চিনেন না ছোটবেলা থাইক্যা!
মানুষের বদলাইতে সময় লাগে না। আমারত সন্দেহ হয় তোমার পেটের বাচচাটা আমার কিনা...
কী...কী কইলেন আপনে!...কী কইলেন! এত অবিশ্বাস করতেন আমারে। এত অবিশ্বাস! কই, কোনদিনত বুঝতে পারি নাই। আমি জানি, জানি কার কথায় আপনে... বলতে বলতে কুসুম বিছানায় ঢলে পড়ে। বাইরে তখন শুরু হয়েছে প্রবল বর্ষণ। টিনের চালে ঝমঝম শব্দ।
গ.
বৃষ্টি হল দু‘দিন ধরে। গতরাতেই বোধহয় ব্যথা উঠেছে কুসুমের। নতুন ঘরে রেহেনা আর নিজের মায়ের সাথে ছিল কুসুম। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে মাঝে মাঝে হাসান কুসুমের কাতরানি শুনেছে। সকালের দিকে ধরেছে বৃষ্টি। খাল পুকুর সব বোধহয় পানিতে টইটুম্বুর। উঠানে হাঁটু পানি।
হাসান ঘুমাতে পারেনি দু‘রাত। সারাক্ষণ মাথার ভেতর দপদপানি। বুকের মাঝে অস্থিরতা। মাথার যন্ত্রণাটা আছেই। ক্লান্তও লাগছে খুব। ...কুসুমের কোন সাড়া শব্দ নাই। সারাবাড়িটাই কেমন যেন চুপচাপ। বেলাত কম হল না। ঘুম থেকে জাগেনি নাকি কেউ? ক্লান্ত শরীরে বিছানায় শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়ে হাসান।
বেশ বেলায় ঘুম ভাঙ্গে হাসানের। বিছানায় বসে ছিল চুপচাপ। ছপছপ শব্দে উঠানের পানি ভেঙ্গে রেহেনা ঘরে ঢুকে, কিরে হাসান, সারাদিনই ঘুমাইবি নাকি? মেয়ের মুখটাত দেখলিও না একবার! তা দেখবিই বা কেমনে, যে বৃষ্টিটা হইল দুইদিন ধইরা! ঘর থাইক্যা যে বাইর হবি তার কী উপায় ছিল। কী সুন্দর মেয়ে হইছে তর। কুসুমের রঙ পাইছে। দেখবি আয়।
রেহেনা মেয়েকে হাসানের কোলে দিলে, হাসান কেমন ভয়ে ভয়ে তাকায় কাঁথায় জড়ানো ছোট্ট বাচ্চাটার দিকে।
কুসুমের গায়ের রঙ পাইলে কী হইব, দেখতে তর মত হয়েছে মেয়ে! জন্মের পরপর তুই দেখতে ঠিক এমন আছিলি। ঠিক তর নাক তর চোখ তর ঠোঁট। কাঁন্দেও তর মত মুখ বাঁকা কইরা।।
ঘুমিয়ে মাথার দপদপানিটা যেন একটু কমেছিল। রেহেনার কথায় যন্ত্রণাটা ফিরে আসে। বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগে হাসানের। দেখতে তার মত হয়েছে মেয়ে!...তা রেহেনা কি আর ভুল বলবে!...মালয়েশিয়া যাওয়ার কিছুদিন পর পেটে বাচ্চা আসার খবরটা ফোনে দিতে দিতে কুসুম কত্ত খুশি হয়েছিল। হাসান বোধহয় দুঃখটা তারচেয়ে বেশিই দিল।
আসার পর থেকে হাসান বলতে গেলে শুয়েই কাটিয়েছে সময়। বের হয়নি একবারও। যখন তখন বৃষ্টিত ছিলই। তাছাড়া মনটাও ছিল বিক্ষপ্ত।...মনোয়ারার কথায় এত বড় ভুলটা করল! গায়ের রঙ কালো বলে মানুষের মনও কালো হবে। হাসানের কথায় কী অবাক হয়েছিল কুসুম। কুসুমের বিস্ফারিত চোখের বিষাদ হাসান কি দূর করতে পারবে কোনদিন। তাকে কি আর ভালবাসবে কুসুম? বিশ্বাস হারালে ভালবাসাতো ভেসে যায়ই।
রাত এখন একরকম না ঘুমিয়েই কাটছে হাসান। মাথার ভেতরে কেমন কেমন যেন করে তার। ঠিক যন্ত্রণা না, কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। খেতেও পারে না ঠিকমত। খাওয়ার পর গলা দিয়ে কেমন টক ঢেঁকুর উঠে। অন্ধকার পুরো না কাটতেই বাইরে আসে হাসান। বাতাসটা কেমন ঠান্ডা, একটু যেন ভাল লাগে। চড়ুইরা দল বেঁধে হল্লা করছে। আধার সরে দ্রুত ফরসা হচ্ছে চারপাশ।
উঠানের আরেক ধারে নতুন ঘরটাতে কুসুম বাচ্চা নিয়ে শোয়। সেদিকে একবার তাকায় হাসান। ক‘দিন ধরে কুসুমের সাথে দেখা হচ্ছে না। আসলে দেখা করার সাহস পাচ্ছে না। কুসুমকে দেখানোর মত মুখ নেই তার। দরজার একটা পাল্লা খোলা। ঘরের কাছাকাছি এসে পা যেন আটকে যায়। তা হলেও মেয়েকে দেখার জন্যই এগিয়ে যায় ।
নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে হাসান। মেয়ে শুয়ে আছে ঠিক বিছানার মাঝখানে। এক পাশে রেহানা। আরেক পাশ খালি। বোধহয় কুসুম শুয়েছিল। বাইরেই গেল কিনা।...হাসান মেয়ের কাছে গিয়ে বসে। গায়ে কাঁথা মেয়ের। কী নরম আর তুলতুলে দেখাচ্ছে। নাক মুখ বোঝা যায় কী যায় না। হাসানের সাড়া পেয়েই যেন আধবোজা চোখ মেলে চাইল। আবার সাথে সাথে বন্ধও করে ফেলল। ঘুমিয়েই গেল নাকি। তার মেয়ে! হাসান এত সুন্দর একটা মেয়ের বাপ এখন। ঠিক যেন বিশ্বাস হতে চায় না। কী নিস্পাপ দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। শ্বাসের তালে ছোট শরীরটা একটু একটু কাঁপছে। ...যে কেউ এক পলক দেখলে বুঝবে, মেয়ে দেখতে হাসানের মত। নিজের চেহারা আয়নার কমতো আর দেখেনি হাসান। অথচ কুসুমকে ও... মনোয়ারা বোধহয় মেয়ে বিয়ে দিতে না পারার শোধ নিল।
আলতো করে মেয়ের গালে হাত ছোঁয়ায় হাসান। মুখ বিকৃত করে মেয়েটা কেঁদে উঠে। কুসুম এতক্ষণ কী করছে বাইরে? মেয়ের ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই। না হলে কাঁদবে কেন! ফোঁপানির শব্দেই বোধহয় রেহানা জেগে উঠে।
কিরে হাসান, তুই। কুসুম মেয়ে রাইখ্যা গেল কই?
আমি আসলাম মাত্র। কুসুমরেত দেখলাম না আইস্যা।... বাথরুমেই গেল কিনা।
কচি বাচ্চা রাইখ্যা এতক্ষণ বাইরে থাকলে হইব। তুই যা একটু দেখ, গেল কই। রেহেনা পাশ ফিরে নাতনীকে মৃদু থাবড়ে থাবড়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে।
হ যাই। বললেও হাসান উঠে না। একদিকে মনে কেমন শঙ্কা, কুসুমের সাথে দেখা হবে ভেবে। অন্যদিকে মেয়েকে ছেড়ে উঠতে মন চাইছে না।
কিরে, গেলি না হাসান। মেয়ে এখনই উইঠ্যা কাঁনতে শুরু করব। দুধ খাওনের সময় হইছে।
মায়ের তাগাদায় বের হয় হাসান। চারদিক ভালমত ফরসা হয়ে গেছে। তা হলেও মানুষজন তেমন একটা জাগেনি। বাড়ির পেছন দিকটায় এমনিতেই লোক চলাচল কম থাকে। সকাল বলেই বোধহয় কেউ নেই। ঝোপাল আম গাছটায় কাকরা কী নিয়ে যেন ঝগড়া করছে। চিৎকারে কান পাতা দায়।...আনমনে একবার আমগাছটার দিকে তাকায় হাসান। পেঁপে গাছ দু‘টায় ঠেসে পেঁপে ধরেছে। কলাগাছটা কাঁদির ভারে পড়ো পড়ো, ঠেকনা দিতে হবে। ...আম গাছটার নিচু ডাল থেকে কী ঝুলছে যেন! চোখের কোণা দিয়ে দেখা যায়। ঘুরে ভালমত তাকাতেই সারা শরীর কেঁপে উঠে হাসানের।...ম্যাক্সি পরা শরীরটা বাতাসে দুলছে একটু একটু। ফরসা পায়ের পাতা দুটো কী নীল!
ঘরের ভেতর থেকে কচি গলার কান্নার শব্দ শোনা যায়। শব্দে বেশ জোর। কেঁদে কেঁদে মাকেই খুঁজছে বুঝি অবুঝ শিশুটা।
ঘ.
আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে কখন যে! হাসানের চারপাশের সব কিছু কেমন আধারে হারিয়ে যেতে থাকে। শুধু নীল পায়ের পাতা দু‘টা মৃদু মৃদু দুলে। বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হাসান, কুসুমের নীল পায়ের পাতার দিকে।...কখন বৃষ্টি নামে অঝোরে। হাসান বৃষ্টিতে ভিজে। হাসান কাঁদে। চোখের জলের সাথে মিশে যায় বৃষ্টির জল।
লেখক সংক্ষেপ :
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন