কালামের মা ।। শাহাদাত রাসএল
কালামের মা ।। শাহাদাত রাসএল

কালামের মা ।। শাহাদাত রাসএল

 

‘দশমাস গর্ভে ধইরা যেই পোলারে জন্ম দিলাম। পাইলা বড় করলাম হেই পোলার মরামুখ আমারে দেখতে দিবোনা এইডা কেমুন বিচার’

এই ভাবনাটাই কালামের মায়ের মাথা থেকে যাচ্ছেনা। কালামের মা মানে কালামের মা। কালামের জন্মের পর থিকা এই নামের বাহিরে কেউ তাকে অন্য কোন নামে ডাকেনি কখনো। কালামের বাপ জমির মিয়া অনেকবার বুঝাইছে

এইগুলা ভুইলা যাও কালামের মা। এইসব চিন্তা মাথায় আইনো না। 

কিন্তু কালামের মা ভুলতে পারেনা। কালামের বাপও মুখে যাই বলুক সেও কি ভুলতে পারছে? ভুলতে পারলে কি আর সেই সকাল থিকা গঞ্জের থানায় গিয়া বইসা আছে। বদরগঞ্জ থানার ওসি আফসার সাহেব বলছে ঢাকায় যোগাযোগ করে চেষ্টা করবে কিছু একটা করার। কালামের মা ঘরের মাটির দাওয়ায় বসে আছে। সামনে সিলভারের থালায় কিছু মুড়ি। দুইবার আঙুলে বাঁধিয়ে কয়েকটা মুড়ি মুখে তুলেছিলো। শেষ ভাত খেয়েছিলো দুইদিন আগে শরীফের মায় এসে জোর করে খাইয়ে দিয়েছিলো। তারপর থেকে আর কেউ এ বাড়িতে আসেনি। আশ্চর্যজনক ভাবেই সবাই কেমন চারপাশ থেকে না হয়ে গেলো। যেনো এক নির্জন দ্বীপে বনবাসে আছে কালামের মা। এমন সময় দূর থেকে হেঁটে আসতে দেখা যায় জমির মিয়াকে। কালামের মা দাওয়ার থাম ধরে উঠে দাঁড়ায়। জমির মিয়া এসে কালামের মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দাওয়ায় বসে পড়ে

একটু পানি খাওয়াইবা কালামের মা  

জমির মিয়া হাঁপাচ্ছে। দুদিন যাবত রোদেরও দেমাগ বেড়েছে খুব। মনে হয় যেনো আকাশ থেকে কেউ আগুন ঢাইলা দিছে। কালামের মা ঘরের ভেতর চলে যায়। ফিরে আসে একটা কাঁসার মগে পানি নিয়ে। জমির মিয়ার হাতে দিতেই একবারে ঢকঢক করে পুরোটা পানি খেয়ে নেয়

দারোগায় কি কইলো ?

জমির মিয়া একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে

কি আর কইবো। একই কথা। সরকার দিবোনা

কেন দিবো না ? ওয় আমার পোলা

তোমার পোলা আর তোমার পোলা নাই কালামের মা। ও এহন সরকারেরওর লাশ সরকার আমাগো দিবোনা

তাইলে আমি আমার পোলারে শেষ দেহা দেখতে পারমু না

ধুর চিল্লাইও না তো কালামের মা... খালি একই প্যাচাল 

জমির মিয়া কাঁধের গামছাটা দিয়ে মুখটা একবার রগড়ে মুছে নেয়। তারপর উঠে দাঁড়ায়

        এহন আবার কই যান

        ঘরে তো কিছু নাই। দেহি বারেক মিয়ার কাছে যাই। গাড়িডা লইয়া বাইরাই। বাঁচতে হইবো তো

জমির মিয়া আর কোন কথা না বলেই বেড়িয়ে যায়। কালামের মা আবার দাওয়ায় বসে পরে।

 

        বারেক মিজির তার রিকসা ভ্যানের গ্যারেজে বসে আছে। লুঙ্গিটা ঊরুর উপরে তুলতে তুলতে উরুসন্ধিতে এনে জড়ো করেছে। হাতপাখাটা দিয়ে একবার শরীরে বাতাস করছে আবার ঊরুতে বাতাস করছে। গ্যারেজের সামনে বসে নয় বছরের বাট্টু একটা রিকসার টায়ারের লিক সারাচ্ছে। এমন সময় ক্লান্ত ধীর পায়ে গ্যারেজের সামনে এসে দাঁড়ায় জমির মিয়া। জমির মিয়াকে দেখেই বারেক মিজি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। জমির মিয়া একদম বারেক মিজির সামনে এসে দাঁড়ায়

        বারেক ভাই

বারেক মিজি না দেখার ভান করে জমির মিয়ার দিকে ঘুরে তাকায়

        ওহ জমির মিয়া দেখি, কি খবর তোমার

        ভালো বারেক ভাই

        তা কি মনে কইরা আইলা

         অনেকদিন তো হইলো ঘরে বসা। এমনে আর কয়দিন চলমু। ভাবলাম ভ্যানডা লইয়া বাইরাই দেহি যদি কয়ডা ট্যাকা আহে

        ভ্যান লইয়া বাইরাইবা ভালো কথা কিন্তু একটা সমস্যা আছে জমির মিয়া। তুমি যেই ভ্যানডা চালাইতা ওইডা তো এহন আরেকজনে চালায়

        এইডা কেমন কথা বারেক ভাই। আমি এতোদিন ধইরা এই ভ্যানডা নিজের মতো যত্ন কইরা চালাইলাম

        তোমারে আর ভ্যান দেওয়া যাইবো না জমির মিয়া। বোঝোই তো আমি ঠান্ডা মানুষ, কোন ঝামেলাত পড়তে চাইনা। তুমি অন্য কারো গ্যারেজের ভ্যান নেও 

        আমার কি দোষ আমারে ভ্যান দিবা না কেন! আমি কি তোমারে দিনের ভাড়া দিনে দিয়া দেইনা বারেক ভাই ? আমার কাছে কোন ট্যাকা পাইবা ?

        না আমি তোমার কাছে টাকা পাইনা। তুমি আমার কাছে পাইবা

কথা মাঝপথে থামিয়ে বারেক মিজি কাঠের বাক্সের ভেতর থেকে তিনশ টাকা বের করে টেবিলের উপর রাখে

        এই নেও তিনশ টাকা। তুমিই আমার কাছে পাইবা। আমি সব হিসাব নিকাশ কইরা রাখছি। টাকা লইয়া যাও। কিন্তু তোমারে আমি ভ্যান দিতে পারুম না। তোমার পিছে এহন পুলিশ গোয়েন্দা সব ঘোরে। তোমারে ভ্যান দিয়া আমি কখন ফাইসা যামু

বলেই বারেক মিজি উঠে দাঁড়ায়

ওই বাট্টু গ্যারেজে খেয়াল রাহিস, আমি একটু আইতাছি

বারেক মিজি বেড়িয়ে যায়। জমির মিয়া বারেক মিয়ার চলে যাবার দিকে একবার তাকায়। তারপর গ্যারেজের ভেতরে রাখা ভ্যানটার দিকে একবার তাকায়। টেবিলে রেখে দেয়া তিনশ টাকা তুলে নিয়ে ধীর পায়ে রাস্তায় নামে জমির মিয়া।

        রাতের এই সময়টা শহুরে জীবনে হয়তো কর্মক্লান্ত মানুষের ঘরে ফেরার সময় কিন্তু প্রান্তিক গ্রামীণ জীবনে রাতের এই সময়টাই গভীর রাত। বেশীরভাগ মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছেএখন যদিও বর্ষাকাল নয় তবুও একটা ব্যাঙ দীর্ঘসময় ধরে ডেকেই যাচ্ছে।

বিছানার উপর বসে আছে কালামের মা। পাশেই বা হাতে চোখ ঢেকে শুয়ে আছে জমির মিয়া। কালামের মায়ের হাতে একটা ছবি। কালামের সাদাকালো একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি। কালামের মা ছবিটা দেখছে। শাড়ীর আঁচল দিয়ে ছবিটা আলতো করে মুছে নেয়। তারপর জমির মিয়ার দিকে তাকায় 

        কি হইলো কিছু কইলা না... পুলিশ কি কইলো...

        কিছু কয় নাই কালামের মা। এহন ঘুমাও

        আমার পোলা মইরা গেছে আমারে কও ঘুমাইতে ? তুমি বাপ নাকি পাষাণ

        হ আমি পাষাণ

এক ঝাটকায় বিছানায় উঠে বসে জমির মিয়া

 মাইনশের কাছে অপমান হইতে হইতে আমি পাষাণ হইয়া গেছি। আমারে সবাই কয় জঙ্গির বাপ। আইজগা বারেক মিয়া আমারে ভ্যান দেয় নাই আমি নাকি জঙ্গির বাপ

কালামের মা একটু চুপ করে থাকে। স্বামীর ক্ষোভ তাকে কিছুটা দমিয়ে দেয়। তারপর আস্তে করে অবাক চোখে প্রশ্ন করে

        আচ্ছা আমারে একটু কইবা জঙ্গি কি ? আমার পোলায় তো শহরে গেলো লেহাপড়া করতে। কইলো বড় অফিসার হইবো

        হ হইছে তোমার পোলা অনেক বড় জঙ্গি হইছে

        জঙ্গি কি ?

        যারা ধর্মের জন্যি অন্য ধর্মের মাইনশেরে মারে তাগোরে জঙ্গি কয়

        আইহায় ধর্মের লাইগা আবার মানুষ মারবো ক্যা

জমির মিয়া আবার আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ে। কালামের মায়ের বিপরীত দিকে পাঁশ ফিরে শোয়

        ঘুমাইয়া থাহো কালামের মা। তুমি এইগুলা বুঝবা না

জমির মিয়া চোখ বন্ধ করে রাখে। কালামের মা কালামের ছবির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কথা বলে

        মানুষ জঙ্গি হয় কেমনে ? আমার কালাম মানুষ মারবো ক্যামনে ওয় তো মুরগী জবাই দিতেও ভয় পাইতো

        আহা এইগুলা বাদ দেও তো...

        আমি ক্যামনে বাদ দিমু কও। সবাই খালি কয় জঙ্গি মরছে, কেউতো কয়না যে আমার পোলা মরছে... ও কালামের বাপ আমারে একটু শহরে নিয়া যাইবা ? আমি একটু গিয়া পুলিশেরে পাও ধইরা কইমু আমার কালামেরে আমার কাছে দিয়া দিতে

জমির মিয়া কোন জবাব দেয়না। কালামের মায়ের গলা ধরে আসে। হুহু করে কান্না পায়। কাঁদতে শুরু করে কালামের মা। কান্নার শব্দ বাড়তে থাকে। জমির মিয়া হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছে। হাতের পাশ দিয়ে চোখের জলের একটা চিকন চোরাস্রোত হাত বেয়ে বালিশে নেমে গেছে।কালামের মা কালামের ছবিটা বুকে চেপে ধরে কাঁদতে থাকে। ঘরের পেছন দিক দিয়ে কেউ একজন হেঁটে যায়। ঘরের ঠিক পেছনে এসে পায়েও আওয়াজটা একটু থামে। তারপরই একটা ধমকের সুর

        এহহহ একটা জঙ্গি শুয়ারেরবাচ্চা মরছে হের লাইগা আবার কান্দে

জমির মিয়া লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে কালামের মায়ের মুখটা চেপে ধরে

        চুপ একটুও শব্দ করিস না

কালামের মায়ের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ঘরের পেছন থেকে পায়ের আওয়াজটা অন্যদিকে চলে যায়। কালামের মায়ের মুখ থকে হাত সরিয়ে নেয় জমির মিয়া

        কান্দিস না কালামের মা। মাইনসে হুনলে গালি দিবো

        আমার পোলা মরছে আমি কান্দুম না ?

জমির মিয়া অন্যদিকে ফিরে শোয়। কালামের মায়ের এই প্রশ্নের কোন উত্তর তার কাছে নাই।  

 

        সকাল থেকেই গ্রামে একটা চাপা সচেতনতা দেখা দেয়। ঢাকা থেকে দুজন সাংবাদিক এসেছে জঙ্গি হামলা সংক্রান্ত সংবাদের কিছু তথ্য জানার জন্য। বিভিন্ন মানুষকে জিজ্ঞাসা করছে কালামের ব্যপারে। কালাম কেমন ছেলে ছিলো, গ্রামে কাদের সাথে মিশতো, আগে কোন উগ্র কর্মকান্ড করেছিলো কিনা এধরণের হাজারটা প্রশ্ন। সবাই একবাক্যে উত্তর দিয়েছে

        আমরা কালামরে চিনি না। ও এই গ্রামের পোলা হইলেও অগো পরিবারের লগে আমাগো কারো ভাব ছিলো না কোনকালেই

সাংবাদিক সংবাদের জন্য কোন ভাইরাল তথ্য না পেয়ে অনেকটা হতাশ হয়ে যায়। অথচ সম্পাদক বলে দিয়েছে এমন কিছু তথ্য দরকার যা অন্যকোন পত্রিকা খুঁজে পায়নি। একটা চমকে দেয়ার মতো তথ্য না পেলে নিউজের হিট বাড়ানো সম্ভব না। এখন ঘরে ঘরে অনলাইন পত্রিকা তাই বাজার ধরে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। রিপোর্টার আর ক্যামেরাম্যান হতাশ হয়ে চায়ের দোকানে বসে চায়ে চুমুক দেয়। একটু দূর থেকে চায়ের দোকানে সাংবাদিকদেরকে দেখে জমির মিয়া। তারপর পা বাড়ায় গিয়াসউদ্দিনের গ্যারেজের দিকে।

        গিয়াসউদ্দিনের গ্যারেজে যেতে যেতেই জমির মিয়ার মনের মধ্যে একটা কু ডাক দিতেছিলো। গ্যারেজে গিয়া সেটাই সত্যি হলো। গিয়াসউদ্দিন জমির মিয়াকে ভ্যান দেবেনা। জমির মিয়া শেষ পর্যন্ত গিয়াসউদ্দিনের পায়ে ধরে ভ্যান ভাড়া চায় যাতে অন্তত খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে পারে। জমির মিয়া এই একটা কাজই জানে ভ্যান চালানো। লাভ কিছু হয়না। গিয়াসউদ্দিনের শালা হান্নানের দেয়া ঘাড়ধাক্কায় মাথাটা নিচু হয়ে যায় জমির মিয়ার। মাথা নিচু করেই বাড়ির পথে হাঁটা দেয়।

বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। কালামের মা বসেছিলো মাটির বারান্দায়। জমির মিয়াও কালামের মায়ের পাশে বসে। কাঁধ থেকে গামছাটা নিয়ে মুখ মোছে। কালামের মা’ই মুখ খোলে

        আইজকাও নাকি গ্রামে সাম্বাদিক আইছিলো?

হ আইছিলো। তোমার পোলায় তো এই গ্রামরে বিক্খাত বানাইয়া দিয়া গেছে... টিবিতে সারাদিন এই গ্রামের কথাই কয়

        কালামের মা বুঝতে পারেনা এই কথার পর তার কি কিছুটা অপরাধবোধ জন্মানো উচিত কিনা বা লজ্জা পাওয়া উচিত কিনা।

        আইজগা সাম্বাদিক সবাইরে কালামের কতা জিগাইলো

        সবাই কি কইলো আমার কালামের কতা ? মন্দ কিছু কয় নাই তো ?

        তোমার পোলারে নাকি এই গ্রামে কেউ চিনেই না

        চিনেনা মানি ? কালামেরে এই গ্রামের কেডায় না চিনে। পেডেরতে পইড়া তো এইহানেই মানুশ হইলো

        মানুশ হয়নাই কালামের মা। আবার ভুল করলা। তোমার কালাম জঙ্গী হইছে

        কালাম জঙ্গী হইলো ক্যামনে কও দিহি কালামের বাপ

        তোমার পোলায় হাদিস কোরান পইড়া নাকি জঙ্গী হইছে। ইসলামের নামে অন্য মাইনশেরে মারছে। এউক্কা দুজ্ঞা না কালামের মা বোম মাইরা একলগে বত্রিশডা মানুশ মারছে। নিজেও মরছে

        হাদিস কোরান পড়লেই কি মানুশ জঙ্গী হয় ? তাইলে আমাগো মাদ্রাসার হুজুরে জঙ্গী হয়নাই কেন ?

        আমি কিছুই জানিনা। কেউ কয় কালাম যা করছে ভালো করছে। কালাম নাকি শহীদ হইছে। কেউ কয় কালাম নাকি ইহুদী নাসারা গো দালাল। আমি কিছুই বুঝিনা গো কালামের মা

        অনেকক্ষণ কেউ আর কোন কথা বলেনা। জমির মিয়া মুখ খোলে

        এক মগ পানি দেও কালামের মা

        জমির মিয়া বাড়িতে আসার পর কালামের মা ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলো এতক্ষণ। ঘরে খাবার মতো একমগ পানিও নাই।

        ঘরে তো খাওনের পানি নাই

        পানি নাই কেন ?

        কইতারিনা কি জানি হইছে। মনুগো বাড়িতে গেলাম কলের পানি আনতে অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করলাম কিন্তু ওরা গেইট খুললো না

জমির মিয়া বোবা চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে

        সবসমুয় তো ওগো বাড়ি থিকাই পানি আনি। আইজগা কি হইলো কে জানে...

        সবাই সবই জানে কালামের না। খালি তুমিই কিছু জানোনা। তুমি এতো সিধা মানুশ ক্যান ?

কালামের মা স্বামীর কথা বুঝতে পারেনা। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। জমির মিয়া কালামের মায়ের হাতের উপর নিজের হাতটা রাখে

        তুমি এহনো বোঝোনাই কালামের মা এইসমাজে আমরা আর আগের মতো নাই। আইগা সাম্বাদিকগো কাছে গ্রামের সবাই কইয়া দিলো হেরা কেউ নাকি আমাগোরে চিনেনা। আমাগো লগে নাকি কারো কোন ভাব ভালোবাসা নাই... তুমি বোঝো নাই কেন আইজগা মনুর মায় তোমারে গেইট খোলে নাই

কালামের মা আহত দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে

        আমাগো কি অপরাধ কালামের বাপ ? এতো বছরের সব চিনা পরিচয় সব মিথ্যা হইয়া গেলো ! কালামে আমাগো এইডা কি কইরা গেলো...

কালামের মা হুহু করে কাঁদতে শুরু করে। জমির মিয়া কালামের মায়ের মাথাটায় হাত রেখে সন্ধ্যার ছাই রঙার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে

 

 

        এই কি হইছে তালুত উঠছে...

জমির মিয়া কালামের মায়ের কালামের মায়ের পিঠে হাত রেখে হাত বুলিয়ে দেয়কালামের মায়ের কাশির দমক বাড়তে থাকে। ভাত খেতে বসে মাত্র কলমি শাঁক দিয়ে মেখে দুইটা লোকমা মুখে তুলেছে এরই মধ্যে গলায় আঁটকে হেঁচকি। জমির মিয়া সিলভারের মগটা হাতে নিয়ে কলসি  থেকে পানি ঢালতে নেয়। কলসি খালি। কলসিটা

        একটু বহো আমি পানি লইয়া আহি

কলসি হাতে একদৌড়ে ঘর থেকে অন্ধকারের দিকে বেড়িয়ে যায় জমির মিয়া। কালামের মায়ের বুকের কাছটায় ভাত আটকে আছে। নাক দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মিনিট দুইয়ের মধ্যেই জমির মিয়া কলসিতে পানি নিয়ে ফিরে আসে। একমগ পানি এগিয়ে দেয় কালামের মায়ের দিকে। কালামের মা দুই ঢোক পানি গিলে একটু ধাতস্ত হয়। জমির মিয়ার চোখ ছলছল করছে। তবে এই ছলছল ভাবটা কি জেদ থেকে নাকি কষ্ট থেকে সেটা বোঝা যায়না

        পানি কইত্তে আনলা ?

কালামের মায়ের প্রশ্ন শুনে। সোজা কালামের মায়ের চোখের দিকে তাকায় জমির মিয়া

        খাল থিকা...

কালামের মা মাথাটা নিচু করে ফেলে। এক থালা কলমি শাঁক মাখানো ভাতের থালার সামনে বসে এই প্রথম কালামের মা উপলব্ধি করতে পারলো চারদিকের অপার শূন্যতা। জমির মিয়ার চোখ থেকে এক ফোটা জল গাল বেঁয়ে নেমে যায়। গাল থেকে জলের ফোঁটা মুছে নিয়ে

        কালামের মা এইভাবে গলার মধ্যে দম আটকাইয়া আর কতদিন বাচবা ?

        কইতারিনা

        এই সমাজে আমরা যে একঘরে হইয়া বাঁচতে পারমু না। আমাগো মুখের উপরে একে একে সব দুয়ার বন্ধ হইয়া গেছে

        কি করবা অহন

        লও আমরা শহরে চইলা যাই। যেখানে একটা জঙ্গির বাপ মা হিসাবে আমগোর কেউ চিনবো না। কেউ আমাগোরে ঘিন্না করবো না  

        এই বাড়ি ঘর ছাইড়া কই যাইমু...

        কালামের মা ঘরবাড়ীর চেয়ে জীবন দামী জিনিশ। তোমার পোলা মাইনষের জীবন নিতে গিয়া আমাগো জীবনও কাইড়া নিছে

        আমরা এহানেই আমাগো মতন কইরা থাহি...

        পারবা না কালামের মা। মানুশ ছাড়া মানুশ বাঁচতে পারেনা। এইসমাজে আমাগো কোন মানুশ নাই...

কালামের মা জমির মিয়ার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে কোন সিদ্ধান্ত নেই ।

 

 

        তিনদিন পরে একসকালে ফজরের আযান সবে শেষ হয়েছে। মুসল্লিরা কেউকেউ মসজিদের দিকে পা বাড়িয়েছে। এমন সময় একটা নতুন জীবনের দিকে পা বাড়ালেন জমির মিয়া আর কালামের মা। ঘর থেকে আগে বেড়িয়ে আসে কালামের মা। কালামের মায়ের মুখ থমথমে অনুভূতি শূন্য। একবার বাড়ির চারদিকে চোখ বুলায়। ঘরটা দেখে। মাথা নুইয়ে বারান্দার মাটিতে একবার ডান হাতটা ছুঁইয়ে চুমু খায়। ঘরের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে জমির মিয়া। জমির মিয়ার কাঁধে ঝোলানো একটা বড় ব্যাগ। এসেই কালামের মায়ের দিকে কালামের পাসপোর্ট সাইজ ছবিটা এগিয়ে দেয় জমির মিয়া

        ভুল কইরা এইডা ফালাইয়া আইছিলা

কালামের মা একবার ছবিটার দিকে তাকায় ফের জমির মিয়ার মুখের দিকে তাকায়

        ভুল কইরা ফালাই না। ইচ্ছা কইরাই ফালাইছি। যেই কলঙ্কের জন্যি ভিডামাডি ছাড়তে হইছে, সেই কলঙ্ক লগে নিয়া লাভ কি

জমির মিয়া কিছুটা অবাক হয়ে কালামের মায়ের দিকে তাকায়। কালামের মায়ের চেহারার এই অভিব্যক্তি এর আগে কখনো দেখেনি জমির মিয়া। ছবিটা আলগোছে হাত থেকে মাটিতে ফেলে দেয়সেই হাতটা বাড়িয়ে কালামের মায়ের হাতটা ধরে

        চলো কালামের মা জলদি গিয়া বাস ধরতে হইবে

        না। কালামের মা না। আমার বাপ মায়ে শখ কইরা আমার একটা নাম রাখছিলো, তুমি ভুইলা গেছো। আমার নাম জয়নাব বিবি।  



গল্পটি শাহাদাত রাসএল'র "জীবন এক সুস্বাদু হেমলক" গল্পগ্রন্থ ‍থেকে সংগৃহিত

কবিয়াল

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন