গল্প : ল্যাংড়া মজিদ
গল্পকার : সিকদার ডায়মন্ড
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
তরুণ গল্পকার সিকদার ডায়মন্ড'র “ল্যাংড়া মজিদ” শিরোনামের এই ছোট গল্পটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্ট থেকে নেয়া হয়েছে। তবে অনবদ্য এ গল্পের অবস্থান ও প্রেক্ষাপট এখন অবদি জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হবে।
![]() |
ল্যাংড়া মজিদ || সিকদার ডায়মন্ড |
ল্যাংড়া মজিদ || সিকদার ডায়মন্ড
মজিদ। গ্রামের আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো তারও একদিন স্বপ্ন ছিল নিজের পায়ে দাঁড়াবার। একটু ভালো রোজগারের আশায় সে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিল ড্রাইভিং ভিসায় ভাগ্য অন্বেশনে। কিন্তু কপালের ফেরে গাড়ি একসিডেন্টে তার পা কাটা যায়।
বাড়ি ফিরে আসতে হয় তাকে, শুন্য হাতে। ঘরে তার সুন্দরী বউ ও বয়স্কা মা। মজিদ যেন তবুও থেমে যাবার পাত্র নয়। সম্পদ বলতে এক টুকরো জমি ও ভিটেবাড়ি।
মজিদের ফিরে আসার পর, তাদের পরিবারে স্বাভাবিকভাবেই অভাব নেমে আসে। ক্র্যাচে ভর দিয়ে মজিদের পক্ষে কৃষিকাজ ও কায়িক শ্রম কঠিন হয়ে পরে। তার বউ সংসারের হাল ধরতে চায়, মজিদের তাতে আপত্তি। মজিদের কথা, আমি তো মরিনাই এখনও। তবুও বাস্তবতা মজিদকে বউয়ের সিধান্তে সায় দিতে বাধ্য করে। মজিদের বউ নানা ধরনের কাজ করে সংসারের অভাব থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু জিবন এতো সহজ নয়। মজিদ বউকে ঘরোয়া কাজে সহায়তা করে। তাদের সংসারে অভাব আছে, কিন্তু সদাহাস্য মজিদের চুটকি ও মজিদের বউয়ের সংসারে একাগ্রতায় সংসারে সুখের অভাব হয়নি কোনদিন।
মজিদের মা মাঝেমধ্যে সংসারে অশান্তি করে, বারান্দায় বসে বসে বউকে বকে। বলে তার জন্যেই ছেলের আজ এই দশা। সে যদি এতো বড় হবার জন্যে তাগাদা না দিতো তাহলে মজিদের বিদেশ গিয়ে পা হারাতে হতো না। মজিদের বউ সেসব কথা গা করেনা। কিন্তু মজিদ এসব কথার প্রতিবাদ করে। মাকে বোঝায় কপালের ফেরে তোমার এই পা কাটা ছেলের সংসার যে করতেছে সে এটাই অনেক। অন্য কেউ হলে এতোদিনে ফেলে রেখে চলে যেত। মজিদের মা এইবার অন্য বায়না ধরে বলে, মরনের আগে আমারে নাতির মুখ দেখা; নইলে মইরাও শান্তি পামুনা।
মন্ডলের বাড়িতে মাঝেমধ্যে নকশী কাথা জমা দিতে যায় মজিদের বউ। মন্ডলের মেয়ে শহরে এই কাথা বেঁচে বড় বড় শো রুমে। সে মজিদের বউয়ের অভাবের কথা শুনে মজিদের বউয়ের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু বউমরা মন্ডলের নজর ভালো না। মজিদ অবশ্য মন্ডলের চরিত্রের কথা ভেবেই বউকে নিষেধ করেছিল, কিন্তু মন্ডলের মেয়ের অনুরোধে সে রাজি হয়। সে ভাবে, মেয়ে যেখানে জড়িত মন্ডল হয়ত সেখানে নাক গলাবে না।
মজিদ ও বউয়ের হাসি তামাশা সুখ দুখের সংসারে একদিন হটাত করে বিষাদ আসে। বউ অসুস্থ হয়ে পড়লে মজিদ তার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেয়। পরদিন কিছুটা সুস্থ্য হলে বউ তার কাছে ক্ষমা চায়। বলে- কোথায় আমি আপনার সেবা করব, আপনাকে রাতজেগে আমার জন্যে কষ্ট করা লাগলো। এরপর তারা একে অপরকে জরিয়ে ধরে কান্না করে, এই কান্না যেন তাদের অপার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।
সেদিন সন্ধ্যায় মন্ডলের বাড়ি যায় বউ, মজিদ অপেক্ষা করে। রাত বাড়ে, মজিদ টর্চ নিয়ে মন্ডলের বাড়ির দিকে যায়। খিল দেয়া ঘরের বাইরে থেকেই মজিদ শুনতে পায় বউয়ের কাকুতি মিনতি। সে শুনতে পায় - দেখেন আমি পোয়াতি, আমার স্বামী সংসার আছে। আমাকে এইভাবে নষ্ট কইরেন না। আল্লায় আপ্নারে গজব দিবো, আপনার না নিজের মাইয়া আছে?
মজিদ বউ পোয়াতি শুনে একটু খুশি হয়, আবার পরক্ষনেই বউ এর চিন্তায় ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এর মাঝেই দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসে বউ, পেছনে পেছনে মন্ডল। বাইরে বেরিয়েই বউ মজিদকে দেখতে পেয়ে তার পায়ে পরে। বলে আমাকে আপনি ভুল বুইঝেন না, আমারে আপনি মাফ করে দেন। আমি আর বাড়ির বাইরে কামে যামুনা, আপনার অবাদ্য হমুনা। মজিদ ঝাড়া দিয়ে বউকে ফেলে ক্র্যাচে ভর দিয়ে এগিয়ে যায় মন্ডলের দিকে। চোখে তার খুন চেপে আছে। মন্ডল তাকে টিটকারি করে, কি রে ল্যাংড়া তুই আমার কি করবি? তারচেয়ে আমি তোর বউরে দেইখা রাখুম। অভাব থাকবোনা সংসারে। মজিদ যেন কোন কথাই শুনতে পায়না, শরীরে তার চরম প্রতিশোধ। মন্ডল এগিয়ে এসে মজিদকে ক্রস করে বউয়ের দিকে আগাতে গেলেই মজিদ প্রথমে তাকে লাইট দিয়ে আঘাত করে ও পরে ক্র্যাচ দিয়ে ইচ্ছেমতো পেটায়। মোটাসোটা মন্ডল মাটিতে পরে যায়, কাতরাতে থাকে। ক্লান্ত মজিদ যেন মনের ক্ষেধ মিটিয়ে মন্ডলকে পিটিয়ে থামে।
মন্ডলের মেয়ে এতক্ষণ শহর থেকে ফিরে এতক্ষণ পেছনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব দেখছিল। সে এগিয়ে এসে মজিদের বউকে উঠিয়ে মজিদের কাছে নিয়ে আসে। বাবার দিকে একদলা থুথু ছুড়ে বলে - থামলেন কেন মজিদ ভাই? পিটিয়ে পিটিয়ে উনাকে পঙ্গু করে দেন। আমি আমার বাবাকে সারাজীবন বসায় বসায় খাওয়াবো। সবাই আপনাকে বলে পঙ্গু, বলে ল্যাংড়া মজিদ। ল্যাংড়া তো আপনি না, ল্যাংড়া তারাই যারা মনের মধ্যে ময়লা নিয়ে ঘোরে।
মজিদ ক্র্যাচটা চট করে ফেলে দেয়, বউ তাকে জাপটে ধরে। বউয়ের কাধে ভর দিয়ে মজিদ বাড়ির দিকে রওনা দেয়। পেছনে ঘুরে মন্ডলের দিকে তাকিয়ে বলে - তোর মেয়ের কথাই ঠিক, আমার পা নাই ঠিক; কিন্তু পায়ের নিচের মাটি আছে; শক্ত মাটি। ক্র্যাচ আমার নয় তোর মতো নড়বড়ে মানসিকতার লোকদের দরকার। এইটা তোরে দান করে গেলাম আজ থেকে তুই ক্র্যাচ নিয়ে চলবি। বউয়ের চোখের পানি মিটিয়ে দেয় মজিদ, বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
লেখক সংক্ষেপ :
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন