উপন্যাস : কপোত কপোতীদের গল্প
লেখিকা : আনআমতা হাসান
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১০ নভেম্বর, ২০২২ ইং
লেখিকা আনআমতা হাসানের “কপোত কপোতীদের গল্প” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখ থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
কপোত কপোতীদের গল্প || আনআমতা হাসান |
৮৩তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
কপোত কপোতীদের গল্প || আনআমতা হাসান (পর্ব - ৮৪)
দেখতে দেখতে কেটে গেল সত্তর ঘন্টা আর মাএ দুটো ঘন্টা বাকি। ওই দুই ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে কোমায় চলে যাবে কাব্য। মিষ্টার আতিক, কিরণ, মিষ্টার সফিক আর মিষ্টার রাহুল হসপিটালের পাশের মসজিদে নামাজ পড়ছে। অভ্রের হসপিটালের ছাদে একটা বেডরুম, একটা কিচেন আর একটা ওয়াসরুম আছে। বেড রুমে আছে একটা খাট, একটা আলমারি, একটা ডিভান আর ডিভানেত সামনে একটা আয়তাকার টেবিল। রান্নাঘরে আছে একটা চুলা আর একটা ছোট ফ্রিজ। এই রুমগুলো আর জিনিসপত্রগুলো সব মিষ্টার আসাদ বানিয়েছিল, যখন মিসেস মিতালী প্রেগন্যান্ট ছিল তখন। বউকে নিয়ে প্রচুর টেনশন হতো তার। তাই বউকে নিজের কাছে রাখার জন্য এখানেই রুম করে রেখেছিল। মাঝে মাঝে ইমারজেন্সিতে হসপিটালে রাতে থাকতে হলে অভ্র এখানে এসে রেস্ট নেয়। তাছাড়া তূবা অসুস্থ হয়ে গেলে, এখানেই এসে থাকে। কাব্যের মা যখন ছেলেকে রেখে বাড়ি যেতে চাইছিল না। তখন তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এখানে এনে রাখে অভ্র। কিন্তু কুহুকে কেউ আনতে পারেনি। সে কাব্যের কেবিনের দরজার সামনে আর কেবিনের দরজার সামনে রাখা চেয়ারেই বসে থেকে রাত দিন কাটাচ্ছে। কুহু এখনও কাব্যের কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে, দরজা ঠিক মাঝ বরাবর গোল করে কেটে লাগানো স্বচ্ছ কাচের গ্লাসের মধ্যে দিয়ে কাব্যের দিকে চেয়ে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে তূবা। প্রাণ প্রিয় বান্ধবীর এতো দুঃসময় তাকে একা ছেড়ে যেতে পারে না সে। মিসেস সোনালী আর মিসেস মিতালী রান্না করে প্রতিবেলাই খাবার পাঠায়। কিন্তু যাদের প্রিয় মানুষটি জীবন মৃত্যুর মাঝে পড়ে আছে, তাদের গলা দিয়ে কি আর খাবার নামে। তাও তূবার জোড়াজুড়িতে সবাই অল্প করে খেয়েছে আর ঘুম, ওই একটু চোখ লেগে আসলে যতটুকু ঘুম হয় আর কি। কাব্যের কেবিনের ভিতরে অভ্র আর একজন নার্স আছে। আগামী দুই ঘন্টা অভ্র কাব্যের কাছেই থাকবে বলে ঠিক করেছে। কাব্য ছেলেটাকে সে নিজের ছোট ভায়ের মতোই আদর করে, কুহুকেও সে নিজের বোনের মতন স্নেহ করে। ভালোবাসার মানুষদের এতো বড় বিপদের সময় কি তাদের থেকে দূরে থাকা যায়।
এদিকে,
কাব্যদের বিল্ডিংয়ের ফাস্ট ফ্লোরে দারোয়ানদের রুমে গায়ে একশো দুই ডিগ্রি জ্বর নিয়ে, কাথা গায়ে দিয়ে সুয়ে আছে লতিফ মিয়া। লতিফ মিয়ার ডান হাত নিজের দুই হাত দিয়ে ধরে, তার পাশে বসে আছে স্কুলের সাদা রঙের শার্ট আর নীল রঙের প্যান্ট পরা স্কুল পড়ুয়া কাব্য। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই লতিফ মিয়া জড়ানো কন্ঠে বললো
- কাব্য বাবা।
- হ্যাঁ, চাচা। কি লাগবে বল?
- কিছু লাগবে না কাব্য বাবা। মানুষ বলে না, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। মিনা যখন আমাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। ভবঘুরের মতো ঘুরতে থাকি। পেটের তাগিদে তোমাদের এখানে চাকরি নেই। ভাগ্যিস তোমাদের এখানে চাকরি নিয়েছি। না হয় মা'র পরে এতো ভালোবাসার মানুষটির সাথে দেখা হতো না।
একটু থেকে কাব্যের দিকে তাকিয়ে লতিফ মিয়া পুনরায় বললো
- দোয়া করি আল্লাহ যেন তোমাকে অনেক বছর হায়াত দেয়। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরে লতিফ মিয়া। কাব্য তার দুই হাতের মধ্যে থাকা লতিফ মিয়ার ডান হাত নাড়াতে নাড়াতে ডাকে
- লতিফ চাচা। লতিফ চাচা। চোখ খোল চাচা। চাচাআ,,,,
ডাকতে ডাকতে কান্না করে দেয় কিশোর কাব্য।
----------------
অভ্র কাব্যের প্রেসার চেক করার জন্য তার কাব্যের বেডের কাছে যায়। এসব কাজ অন্যন্য পেসেন্টেরটা নার্সরা করলেও, কাব্যর ক্ষেত্রে সবকিছু অভ্র নিজেই করছে। নার্স শুধু তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কাব্যের কাছে গিয়ে আনমনেই কাব্যের মুখের দিকে তাকায় অভ্র। কাব্যের কাছে যেতেই খেয়াল করে কাব্যর চোখের পাপড়ি নড়ছে। কাব্য ঠোঁট দুটো নাড়াচ্ছে কিন্তু কোন আওয়াজ হচ্ছে না। অভ্র কাব্যের মুখের কাছে গিয়ে বললো
- কাব্য কেন ইউ হেয়ার মি? কাব্য।
আস্তে ধীরে চোখ খুলে কাব্য। জানালার বাহির থেকে তা দেখে কুহু আর তূবা। তূবা ছলছল চোখে হাসি মুখে কুহুর দিকে তাকিয়ে বললো
- কুহু কাব্য ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফিয়েছে।
কুহু চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বললো
- আল্লাহ কাছে লাক্ষ লাক্ষ শুকরিয়া।
বলেই জ্ঞান হারিয়ে ডোলে পড়ে তূবার উপরে। কুহুর ভার রাখতে না পেরে আস্তে আস্তে কুহুকে নিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে তূবা। অজ্ঞান কুহুর মাথাটা নিজের কোলের উপর রেখে, কুহুর গালে আস্তে আস্তে চপড় মেরে তূবা ডাকে
- কুহু এই কুহু। চোখ খোল, কুহু।
কিন্তু কুহু চোখ খুলে না। তূবা কান্না করে দেয়। কন্দনরত কন্ঠে অভ্রকে ডাকে
- অভ্র, এই অভ্র দেখ না কুহু চোখ খুলছে না কেন। এই অভ্র।

রাতের বেলা। সেদিনের মতো আজও গ্রামের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র। আবছা অন্ধকারে জোনাকির মতো দেখাচ্ছে শুভ্রের হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা। ফর্সা গায়ে কালো শার্ট-প্যান্ট পরা তার। শুভ্রের ফর্সা গায়ে কালো রঙটা খুব সুন্দর মানায়। তাই তো আজকে বিকেলে অনুর হবু শশুর বাড়ি থেকে আসা, অনুর হবু বর মানে পারবেজের ছোট কিশোরী বোন পারু মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল শুভ্রের দিকে। সেই সময়টার কথা মনে হতেই এখনো খুব বিরক্ত লাগে, শুভ্রের পিছন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার অনুর। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পিছনে না ঘুরেই শুভ্র অনুকে জিজ্ঞেস করল
- এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি লাভ?
অনু কিছু বলে না। চুপ করেই দাঁড়িয়ে থাকে। শুভ্র কিছুটা বিরক্ত হয়ে পুনরায় বললো
- আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি অনু।
এবার অনু শান্ত কন্ঠে উত্তর দিল
- অনেক লাভ আছে।
কুচকুচে কালো ভ্রু যুগল কুঁচকে এবার শুভ্র অনুর দিকে ঘুরে তাকায়। কিন্তু ঘুরে তাকাতেই তার কুঁচকানো ভ্রু যুগল সোজা হয়ে যায়। বিরক্ত মাখা দৃষ্টি হয়ে যায় মুগ্ধ। স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্যামাঙ্গিনী অনুর দিকে। শ্যামা গায়ে কালো খয়েরি রঙের শাড়ি, ঠোঁটে টকটকে লাল রঙের লিপস্টিক, গলায় সোনার লকেট, কানে সোনার দুল, হাতে কালো খয়েরি রঙের কাচের চুড়ি। অনুর হাতের চুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে শুভ্র পুনরায় ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বিকেলে যখন পারবেজরা এসেছিল তখন অনুর হাতে এই চুড়িগুলো ছিল না। কাচের চুড়ির বদলে তখন অনুর দুই হাতেই সোনার চিকন চুড়ি ছিল। যদিও অনুকে স্বর্ণের চুড়িগুলোর থেকে এই কাচের চুড়িগুলোতে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। কিন্তু যেখানে বাকি সব সাজ তো আগের মতোই আছে। সেখানে অনু হঠাৎ চুড়ি চেন্স করলো কেন? কিন্তু শুভ্র এখন অনুকে সেই সম্পর্কে প্রশ্ন না করে, আগের কথার রেশ ধরে বললো
- বাহ! বাহ! বিয়ে না হতে বিয়ের কথা চলতেই দেখি বেশ বড় হয়ে গিয়েছিস। মুখে মুখে জবাব দিতেও শিখে গিয়েছিস! ভালো, ভালো। বেশ ভালো।
অনু মলিন কন্ঠে বললো
- জীবন মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়ালে মানুষ অনেক কিছুই শিখে যায়।
শুভ্র নিজের কুঞ্চিত ভ্রু আরও একটু কুঁচকে বললো
- আমার জানা মতে তোর তো বড় কোন অসুখ হয়নি। তাহলে জীবন মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়ালি কিভাবে?
- মনের অসুখের তুমি কি বুঝবে। তুমি না বুঝ মনের অসুস্থতা আর না বুঝ কষ্ট।
অনুর কথা শুনে শুভ্র তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো
- হ্যাঁ, একদম ঠিক কথা বলেছিস। আমার জীবনে তো কোন কষ্টই নেই। আমি কিভাবে বুঝবো তোর কষ্ট। ছোটবেলায় আমার বাবা-মা তো আমাকে আনন্দ দিতেই মরে গিয়েছে। তোর নানি বাড়ির লোকেরাও তো আমাকে আনন্দ দিতেই চাচিকে বলতো আমাকে যেন কোন এতিমখানায় দিয়ে দেয়।
অনুর খুব কষ্ট হয় শুভ্রের কথাগুলো শুনে। চোখ দুটো ছলছল করে উঠে। খুব রাগ হয় নানি বাড়ির মানুষগুলোর উপর। তারও খুব কষ্ট হয় নানি বাড়ির লোকেরা যখন শুভ্রর সম্পর্কে খারাপ কথা বলে। কিন্তু শান্ত সৃষ্ট মেয়ে সে, রাগ হলেও কোন প্রতিবাদ করতে পারে না। তাই নিরবে চুপচাপ চোখের জল ফেলে। অনু মলিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল
- ওদের শাস্তি আমাকে কেন দিচ্ছ শুভ্র ভাইয়া?
- আমি কারো শাস্তি তোকে দিচ্ছি না অনু। আমি শুধু চাইছি না, ওদের কথা সত্যি হোক। ওরা বলেছিল এতিম ছেলেমেয়েরা নাকি কালসাপ হয়, যতই দুধকলা দিয়ে পোষ ছোবল ঠিকই দেয়। আমি শুধু তা ভুল প্রমাণ করতে চাচ্ছি।
করুণ মুখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে অনু প্রশ্ন করল
- আর আমার অসুখটা?
স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অনুর ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে শুভ্র। তারপর আকাশের থাকা সরু বাঁকা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে শুভ্র বললো
- দেখ আকাশের চাঁদটা কতো সুন্দর। চাইলেই কি তুই তা ধরতে পারবি?
অনু মাথা তুলে চাঁদের দিকে তাকায়। তারপর শুভ্রের দিকে একনজর তাকিয়ে ছাদের দরজা দিকে পা বাড়ায়। শুভ্র এখনো চাঁদের দিকে তাকিয়ে মেঘেদের সাথে তার লুকোচুরি খেলা দেখছে। ছাদের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় অনু। পিছনে না ঘুরেই শুভ্রের উদ্দেশ্য বললো
- চাঁদ ছোয়াটা দূর্লভ হলেও অসম্ভব না।
শুভ্র অবাক হয়ে অনুর দিকে তাকায়। চিরচেনা মেয়েটাকে আজ তার বড্ড অচেনা লাগছে। অনু ঘুরে শুভ্রের দিকে না তাকিয়েই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
৮৫তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা আনআমতা হাসান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন