আত্মজীবনী : জন্ম ও যোনির ইতিহাস
লেখিকা : জান্নাতুন নাঈম প্রীতি
গ্রন্থ : জন্ম ও যোনির ইতিহাস
প্রকাশকাল : ২০২৩, বইমেলা
রচনাকাল :
তরুণ লেখিকা জান্নাতুন নাঈম প্রীতির “জন্ম ও যোনির ইতিহাস” শিরোনামের এই আত্মজীবনীকা মূলক গ্রন্থটি অনলাইন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য এ গ্রন্থটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকার বিতর্কিত এ গ্রন্থটি ২০২৩ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে।বইটির উৎসর্গে তিনি লিখেছেন, “সত্য কথা লেখা, বলা ও প্রকাশ করার দায়ে অভিযুক্ত প্রতিটি মানবাধিকার কর্মীকে, যারা না থাকলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে ভাবা হতো না আমাদের। যারা না থাকলে দুনিয়ার কারাগারগুলো জানতেই পারত না মত প্রকাশের অপরাধে একজন মানুষ হত্যাকারী আর একজন নিরীহ লেখক একই জায়গায় থাকার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে!এবংসব ধর্মের ঈশ্বরকে যারা কেবল আমাদের যোনির ওপর খবরদারি করতে জন্মেছিলেন”
![]() |
জন্ম ও যোনির ইতিহাস || জান্নাতুন নাঈম প্রীতি |
১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
জন্ম ও যোনির ইতিহাস || জান্নাতুন নাঈম প্রীতি (পর্ব - ০২)
ওয়েলকাম টু প্যারিস!
একইসাথে পূর্ণতা আর শূন্যতার বোধ মানুষের হয়। মানুষের বুকের ভেতরটা এমনই এক বিচিত্র জটিল গোলকধাঁধা। এই গোলকধাঁধায় কখনো কখনো মানুষের মনে হতে পারে সে মেরুবিন্দুতে দাঁড়ানো এক পরাজিত না হয়েও ক্লান্ত ও বিষণ্ণ মানুষ। যুদ্ধে লড়াই করে জেতার পরে যে টের পেয়েছে তার প্রচুর বিশ্রাম প্রয়োজন, যেন পুরো শতাব্দী তাকে ঘিরে ঘুরছে আর সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যুদ্ধে জিতে সে অনুভব করছে সহযোদ্ধাকে হারানোর কষ্ট। বুকের মধ্যে জয়ের আনন্দ আর হারানোর আর্তনাদ মিলেমিশে গেলে এমন হয় হয়তো। তাই আক্ষরিক অর্থেই দেশকে হারানোর কষ্ট আর স্বপ্নকে জেতার আনন্দ মিলেমিশে একাকার হওয়ার অদ্ভুত এক রসহ্যময় অনুভূতি । আর দিব্যদৃষ্টিতে বিশাল দুই বোচকা ভরা পঞ্চাশ কেজির কাছাকাছি ওজনের মালপত্র সমেত আমি এসে দাঁড়ালাম শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্টে। ৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ইউরোপীয় টাইমজোনের হিসাবে মাঝরাতে।
বৃষ্টিভেজা রানওয়েতে বিমান নামার পরে মনে হলো- একী! বাংলাদেশের আকাশ আমার সঙ্গে করে চলে এসেছে নাকি?
বাংলাদেশ থেকে যখন মধ্যপ্রাচ্যগামী বিমানে উঠেছিলাম, তখন দেখেছিলাম ঠিক একইভাবে আকাশ কাঁদছে। যেন সজল চোখে বিদায় জানাচ্ছে আমাকে, বলছে- অন্য দেশে গিয়ে কিন্তু ভুলে যেও না আমাকে! আক্ষরিক অর্থেই তখন কয়েক মিনিটের জন্য আমার মনে হয়েছিল, বিমান থেকে নেমে আমার পরিবারের সদস্যদের হাত ধরে বলি- চলো, বাড়ি যাই!
কিন্তু দুনিয়ায় যেকোনো আবেগতাড়িত ইচ্ছাকে যেমন লাগাম দিতে হয়, সেরকম সজল চোখে ইচ্ছের পায়ে শেকল পরিয়ে আমি ভাবতে চেষ্টা করলাম নতুন দেশ কেমন হবে, কেমন লাগবে সেই জনপদ।
এদিকে তার কিছুক্ষণ আগেই মধ্যপ্রাচ্যগামী শ্রমিকদের একজনকে আবিষ্কার করেছিলাম যে কি না প্লেনের সময় ভুল করেছে। তার জন্য এত খারাপ লাগছিল!
মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে সস্তায় কাজ করে বাংলাদেশের শ্রমিক। এরা কয়টা টাকার জন্য জীবনের ঝুঁকি নেয়, অনেকে কাজের সন্ধানে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যেতে গিয়ে ডুবে মরে, কেউ ধরা পড়ে অন্যদেশের কোস্টগার্ডের হাতে। অথচ দেশে এরা কী পায়? বিমানবন্দরের লোকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর জঘন্য ব্যবহার। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশ নির্ভর করে এদের ওপর। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা বিভিন্ন দেশে, দেশের যে টাকা পাচার করে, বিদেশে দেশের টাকায় বাড়িঘর কেনে সেগুলো মূলত এদের অবদান।
সৌদি আরবে কাজের জন্য যে মেয়েরা যায়, তারা দুটো টাকার জন্য দিনে রাতে ধর্ষিত হয় সৌদি পুরুষদের হাতে। কেউ কেউ ফেরে বাচ্চা নিয়ে, কেউ কেউ ফেরে লাশ হয়ে। কিন্তু থেমে নেই ওদের যাওয়া। কারণ ওরা যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, সেই আল্লাহ অসহায়। কিন্তু যে আল্লাহর কাছে ওরা নিজেদের সমর্পণ করে, সেই আল্লাহর নাম টাকা!
তাই এয়ারপোর্টে দাঁড়ানো সস্তার শ্রমিক লোকটা যখন এসে গ্রাম্য উচ্চারণে জিজ্ঞেস করেছিল- আপা, পিলেন ধরতে কোনদিকে যাইতে হবে? আমি তার জন্য অভয় হতে চেয়েছিলাম। হাত বাড়িয়ে টিকিট চাইতেই সে দিল দোমড়ানো এক টুকরো কাগজ। টিকিটের প্রিন্ট করা এই কাগজটায় দেখি তার প্লেন আরও এক ঘণ্টা আগে চলে গেছে। কাউন্টার দেখিয়ে দিলাম তার এয়ারলাইন্সের। কিন্তু এত মন খারাপ হয়ে গেল!
হয়তো জমি বিক্রি করে দিয়ে টিকিট কেটেছে ভাগ্যের সন্ধানে, গ্রামে থাকা পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে, ঋণের দায়ে জর্জরিত বলে অবশিষ্ট সম্পত্তি বন্ধক রেখে কেবল মাত্র সামান্য লেখাপড়া করেই তুলে নিতে হয়েছে সবকিছুর ভার। এর মধ্যে প্লেন ভাড়ার টাকা থেকে গচ্ছা গেলে কেমন লাগে? সেটাও তো অকিঞ্চিৎকর না!
যা-ই হোক, টানা প্রায় ষোলো ঘণ্টা আকাশে ওড়াওড়ির পর প্যারিসে নামার পর শাটল ট্রেনবিশিষ্ট এয়ারপোর্ট দেখে গ্রামের চাচাতো বোন যে কি না শহরে এসে বিমোহিত হয়ে গেছে। কিংবা ওয়ান্ডারল্যান্ডে এসে পড়া এলিস, তেমন করেই প্যারিসের প্রথম ঝলক চাকচিক্য দেখতে দেখতে ইমিগ্রেশনের ঝামেলা পার করে আবিষ্কার করলাম দূরে কাচের দেয়ালের ওপাশে দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ মিটিমিটি হাসি দিচ্ছিল খয়েরি চুলের যে রূপবতী নারীটি সে এগিয়ে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলছে- “আই কুড নট বিলিভ দ্যাট ইউ উড বি অ্যাবল টু কাম হেয়ার, ওয়েলকাম টু প্যারিস!” (আমি বিশ্বাস করতে পারিনি তুমি আসতে পারবে, প্যারিসে স্বাগতম!)
আরে! এ তাহলে সেই ম্যাগুলন ক্যাথালা!
যার সাথে আমি দিনের পর দিন ই-মেইল চালাচালি করেছি, ভেবেছি খটমটে চেহারার দজ্জাল ধরনের এক নারী চশমার লুকিং গ্লাসের ওপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, খুবই রুক্ষ স্বরে কথা বলবে আর দুরুদুরু বুকে আমি ইংরেজি গ্রামার ভাবতে ভাবতে তার কথার উত্তর দেব! কিন্তু এ তো যা ভেবেছি তার উলটো! এত আন্তরিক হাসিমুখের লোক সে!
মুহূর্তে বুকের মধ্যের সব ব্যথা আর অবসাদ কেন যেন দূর হয়ে গেল, আর আমি নিজেই নিজেকে বললাম- কাম অন প্রীতি, ওয়েলকাম টু প্যারিস!
বলে রাখি- আমি যখন প্যারিসে পা দিই তখন একবিংশ শতাব্দীর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন মহামারিটির তিন নম্বর পর্যায় চলছে, নানানরকম হেলথ রেস্ট্রিকশন চলছে ইউরোপে, চব্বিশ ঘণ্টা আর ছয় ঘণ্টা আগে নাকের মধ্যে লম্বা নল গুঁজে ভাইরাস টেস্ট করিয়ে সেই রিপোর্টের কাগজে সিল মারার নানান দুর্ভোগ চলছে, আমার দেশ বাংলাদেশের নরকতুল্য এয়ারপোর্টে তারচেয়েও চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনার মহড়া চলছে। সবমিলিয়ে আমার আসাই একরকম অনিশ্চিত ছিল। অথচ সেখানে আমি কি না এই সমস্ত ফ্যাঁকড়া পাড়ি দিয়ে 'পারি' নামের যে স্বপ্নলোকের কথা বইতে পড়েছি, মুজতবা আলীর সাথে তাল মিলিয়ে বলেছি 'অর্ধেক নগরি তুমি, অর্ধেক কল্পনা, যে শহরের স্বর্ণতুল্য তার কথা পড়ে আফসোস করেছি- সেই জায়গায় এসে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছি ছাব্বিশটি বসন্ত পার করে!
আসার আগে ইউটিউব নামের অন্ধের যষ্টি ঘেঁটে ফরাসি ভাষার প্রাথমিকেরও প্রাথমিক পর্যায় বিষয়ক নানান মহড়া দিলেও রাস্তায় বেমালুম ভুলে গিয়েছি ফ্রেঞ্চ ভাষায় সাহায্য চাইবার উপায়। ফলে যারপরনাই ইতস্তত হুল ফোটানো ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটার তোড়ে কালবিলম্ব না করে অদ্ভুত ভাঙা উচ্চারণে জিজ্ঞেস করলাম একজনকে- ‘পারলে ভু অংলে?’ এর মানে হলো- তুমি কি ইংরেজি পারো?
সে আমাকে বলল - উই উই! (হ্যাঁ হ্যাঁ)
আমি আক্ষরিক অর্থেই কুকুরের মতো কুইকুই করে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম- তুমি কি বলতে পারো, বের হওয়ার রাস্তাটা কোনদিকে?
সে হাত-পা নেড়ে নেড়ে বলল- মানুষের এই লম্বা সারিকে অনুসরণ করলেই পেয়ে যাবে।
আমি মনে মনে বলছি- আরে ব্যাটা, এই পরামর্শই যদি দিবি, তাহলে জিজ্ঞেস করলাম কেন? আমি তো লোকদের অন্ধ অনুসরণই করছি এতক্ষণ! কিন্তু বিনয়ে গলে যাওয়ার ভান করে বললাম ফ্রেঞ্চ ভাষায় আমার শেখা দ্বিতীয় শব্দ- ‘মার্সি বকু’! (তোমাকে অনেক ধন্যবাদ!)
কিন্তু যাকে ধন্যবাদ দিলাম তার পরামর্শে এত মানুষের সারির দিকে তাকাব কী! ততক্ষণে দেয়াল জুড়ে দেখি সারি সারি গ্রেট মাস্টারদের আঁকা ছবিময় পোস্টার আঁটা আর মিউজিয়ামগুলোর নাম লেখা!
মন কেবল এদিক-ওদিক তাকিয়ে বাবার হাত ধরে মেলায় নতুন নতুন খেলনার পসরা দেখা ছোট বাচ্চার মতন বলছে- ওই যে ল্যুভর মিউজিয়ামের ইজিপশিয়ান কালেকশন, ওই যে ডি'ওরসে মিউজিয়ামের ইম্প্রেশনিস্টদের আঁকা ছবির আলাদা বিজ্ঞাপন! চতুর্দিকে এত বিশাল সেসব পোস্টার যে মূল ছবি দেখছি বলেই ভ্রম হয়। চলমান রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি এই লেখাই গিলব, ছবিই দেখব নাকি লোকের মাথা ধরে সাঁইসাঁই বেগে এগোব?
দেশে থাকতে দামি দামি দুষ্প্রাপ্য ছবির বইতে ছোট করে ছাপা পোস্টকার্ডের মতো ছবি ছাড়া কখনো চর্মচক্ষুতে গ্রেট মাস্টারদের একজনেরও আঁকা ছবি নিজের চোখে দেখিনি, এমনকি রাজধানী ঢাকার সবেধন নীলমণি শাহবাগের জাতীয় যাদুঘর, সেও এক রেপ্লিকার সমাহার। সেরকম না দেখা চোখের লোককে যে এরা নিরাপদে আঁকা আর লেখার জন্য বছর দুয়েকের আমন্ত্রণ জানিয়েছে, এ তো প্রথমে দেশে বসে বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। আর তাছাড়া ওইসব প্রিন্টের ছবি দেখে কি মন ভরে?
ব্রাশের স্ট্রোক কোনটা কোথায় গেছে কেমন করে বুঝব? এমন অনেক বিখ্যাত ছবি আছে যেগুলোর সাদাকালো ফটোগ্রাফ ছাড়া রঙিন ছবি দেখিইনি কোথাও! এমন দীনহীন আর ক্ষীণ লোককে নিয়ে এসে এরা কী করবে?
এইসব ভেবে শীতে কাঁপতে কাঁপতে জবুথবু হতে হতেই খুঁজে পেলাম কোথা থেকে ব্যাগ-বোঁচকা বুঝে পেতে হয়, কোথায় গেলে গোমড়ামুখো অনুসন্ধিৎসু চোখের পুলিশ সদস্য বলে দেয়- অনেক সয়েছি, এখন তুমি পথ দেখো বাপু!
অবশ্য হাতে ট্যালেন্ট পাসপোর্ট নামের ভিসা থাকায় তুলনামূলকভাবে লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীদের চেয়ে কম সময়ে কাজ হওয়ায় সেই মুহূর্তে আগেকার দিনে কত প্রকার ঝক্কি পোহাতে হতো তা ভেবে প্রমাদ শুনেছিলাম। অথচ সেই ঝক্কি যেমন নেই তেমনই এখনকার দিনের প্রতিটি এয়ারপোর্টে থাকা ওয়াইফাই নামক ইন্টারনেটভিত্তিক জাদুর প্রযুক্তি জানিয়ে দেয়— এই শতাব্দীতে মানুষ কেবল একে অন্যের ওপর বোমাই ফেলছে না, বরং মানুষ মানুষকে একে অন্যের কাছাকাছি পৌঁছেও দিচ্ছে!
যেমন রাস্তার মধ্যে বিমান দাঁড়িয়েছিল দুবাইয়ের শারজাহতে। তখনও এইসব ভাবতে ভাবতেই সমস্ত বিজ্ঞানী আর গবেষককে ধন্য ধন্য করতে করতে মরুর দেশ দুবাইয়ের এয়ারপোর্ট থেকে যাত্রাবিরতির সময়ে বিমানবালার দেখানো পথে দৌড়ে উঠেছিলাম ফ্রান্সের বিমানে। বিমান থেকে পাখির চোখে দেখে নিয়েছিলাম রৌদ্রময় উঠান ঘেরা একই ধাঁচের খড়রঙা সারি সারি বাড়ি, খেজুর গাছের সারি, চমৎকার খেলনার মতো গাড়িগুলোর দোতলা-তেতলা রাস্তা ধরে সাইসাই করে চলা। এদিকে বিমানের মধ্যের এক বিদেশিনী ক্যামেরা বের করে কটাস কটাস ছবি তুলছে দেখে আমি পাখির চোখে আবিষ্কার করলাম বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু দালানগুলোর একটা বুর্জ খলিফার পেটমোটা অবয়ব। খুব রুচিশীল ঠেকল না অবশ্য। অথবা এ নিছকই আমার মনের সমস্যা।
যেকোনো 'অতি টাকাওয়ালা' বিষয়েই আমার বিবমিষা পুরাতন। মধ্যপ্রাচ্যের যে তেল বিক্রির টাকার তেলতেলে পুঁজিতান্ত্রিক অবয়ব, তাতে এ যেন নিজেকেই বুদ্ধের বাণীসমেত বলা- অতি অর্থে সর্বনাশ!
যা-ই হোক, আমার সর্বনাশের শুরু হয়েছিল বই পড়ার হাতেখড়ি কিংবা চোখেখড়ি থেকেই! বই পড়ার কারণেই অল্প বয়স থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল বিশ্ব ভ্রমণের। কিন্তু গরিব দেশের গরিব এক কমবয়সি মেয়ে চাইলেই দেশ- বিদেশ ঘুরতে পারবে কীভাবে?
আমি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত এক পরিবারের ছোট সন্তান। তার ওপর মেয়ে। সাধ ও সাধ্যের টানাটানির মধ্যিখানে আমি পেন্ডুলামের মতো দুলেছি, আধুনিক মন নিয়ে পশ্চাৎপদ সমাজে বেড়ে ওঠার কণ্টক ও নুড়ি বিছানো পথে আমি হেঁটেছি, হোঁচট খেয়েছি। কিন্তু সেই পথ তো কখনোই ভ্রমণের প্রয়োজনে চলিনি, বরং জীবনের প্রয়োজনে পথ খুঁজে নিয়েছি। অথচ বিমানের জানালার কাচে নিজের চোখের প্রতিফলনে যে জীবনের নতুন রূপ আমি দেখলাম, তাতে সম্মোহিত হয়ে গেলাম খানিকক্ষণের জন্য। এই যে নতুন আরেক জীবন আমাকে তার সমস্ত রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চারের ডালা খুলে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে, আমি তাকে ফেলি কী করে?
অবশ্য অতি নাদান বয়সে স্কুলে যাওয়ার আগে থেকে যে গল্পের বই নামের জাদুর পাটির দেখা আমি পেয়েছিলাম। তাতে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে আফ্রিকা মহাদেশ, লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ, বসফরাস অথবা জিব্রাল্টার প্রণালির মাঝ বরাবর। মিশর নিয়ে অতি আগ্রহ থাকায় অনেক কষ্টে উদ্ধার করতে শিখেছিলাম হায়ারোগ্লিফিক নামে মিশরের প্রাচীন চিত্রভাষার সামান্য অংশ।
মনে আছে কোনো এক সুহৃদ ব্রিটিশ মিউজিয়ামের হায়ারোগ্লিফিক শেখার বই এনে দেওয়ায় বর্তে গিয়েছিলাম! এরপর অতি উৎসাহে ইউরোপের কোন মিউজিয়ামে কী কী চিত্রকর্ম আছে, কোন দেশের কোন শহর কীসের জন্য বিখ্যাত, কোন শহরে কী খনিজ আর প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, কোথায় গেলে মিলবে দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান হীরের খণ্ড তা বইয়ের প্রতি বুভুক্ষু থাকার কারণে সবই আমার নখদর্পণে। কেউ বিদেশ থেকে এলে আমি এমন গল্প করতে জানি যে পিকাসো আমার বাড়ির পাশের আত্মীয় আর ভ্যান গগ আমার মায়ের দিকের আত্মীয়দের মধ্যের এক নিষ্কর্মা গরিব এক ভবঘুরে। এরকম একজন মানুষ টাকার অভাবে কোথাও যায়নি, তাইই বা কে বলবে?
কৈশোরে বাড়ন্ত শরীর আর উড়ন্ত মনে তাই প্রতিদিন টিভিতে দেখা সাবানের ফেনায় মাখা নারীদের দেখতে দেখতে অভ্যস্ত চোখে আর কৌতূহলী মনের মিশ্রণে বাথরুমের পানির কল খুলে আমি কখনো মিশরের রানি ক্লিওপেট্রা, কখনো দিল্লির সিংহাসনের প্রথম সম্রাজ্ঞী নারী সুলতানা রাজিয়া, কখনো নূরজাহান নামের সেই পারস্য সুন্দরী। এরকম একজন বুভুক্ষু কিশোরী দেশের গণ্ডি পেরিয়ে হয়তো সর্বোচ্চ ভারত পর্যন্ত যেতে পারে, কিন্তু সমুদ্র পাড়ি দিয়ে একলা নারীর বাউন্ডুলেপনার কুসংস্কারকে স্বাচ্ছন্দ্যে নিজের ঘাড়ে তুলে নিতে জানবে একদিন, বিদ্রোহ করবে নিজের রাষ্ট্রের সাথে, যুদ্ধ করবে চরিত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এক অদ্ভুত ট্যাবুতে ভরা সমাজের সাথে তাইই বা কে জানত?
আমি জানতাম না। শুধু কম বয়সে লেখালিখি করে সামান্য নাম আর বই বাবদ কিছু টাকা কামানোর বহু আগে থেকেই আমার মনে হয়েছিল- এবার লেখা যাক সমাজের কথা, দেশের কথা। কিন্তু কখনো সেই লেখা দিনে দিনে প্রিয় থেকে বিতর্কিত, বিতর্কিত থেকে অতি বিতর্কিত হয়ে উঠবে তাই বা কে ভেবেছিল?
আমি ভাবিনি। আমার ধারণা কোনো লেখকই ভাবে না সে বিতর্কিত হয়ে উঠবে। অথচ আজকাল খুব মনে হয়, জগতে বিতর্কিত না হয়ে ওঠাই সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যাপার হওয়া উচিত ছিল। কারণ বিতর্কিত মানুষ ছাড়া আজ পর্যন্ত জগতের কিছু উদ্ধার হয়নি।
যেহেতু বিতর্কিত হতে চাইনি (কিংবা কে জানে, হয়তো অবচেতনে চেয়েছিলাম)। আমি কেবল ভেবেছিলাম লেখকের একটা দায় আছে, সেই দায়টা সময়ের কাছে, সময়ের প্রয়োজনের কাছে। যে দায় আমাকে সাহস দিয়েছিল কাউকে তোয়াক্কা না করে সত্য বলতে, কাউকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ভাবনা বলতে। এই যে তোয়াক্কা না করার বিষয়টা এখানে আমার মায়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তিনি শিখিয়েছিলেন— কেবল পেটে ভাত জোটাই ক্ষুধা মেটা না। আত্মাকেও খাবার দিতে হয়। তিনি শিখিয়েছিলেন- মানুষ ততদিনই বেঁচে থাকে যতদিন তার আত্মা বেঁচে থাকে! আর আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় ছবি এঁকে, বই পড়ে, গল্প লিখে। কবিদের ভাষায় সুন্দরের চর্চা করে। অবশ্য সেই চর্চাটা, সেই লেখালেখিটাও একদিনে জন্মায় না, তার জন্য জানতে হয়, বুঝতে হয়, অনুধাবন করতে হয় নিজের ক্ষুদ্রতা আর দুনিয়ার বিশালতাকে।
কম বয়সে যে রক্ত গরম থাকে তা তো সকলেরই জানা। কিন্তু মানুষ জানে না সেই গরম রক্ত সত্যের স্পর্শ পেলে হয়ে ওঠে পরশপাথর, যে পরশপাথরের ট্র্যাজেডি হলো- তাতে করে লেখক নামের অভাগাটা নানান বিপদে পড়ে, কিন্তু সর্বক্ষণ মাথার ভেতর থেকে কেউ সর্বনাশ জেনেও সত্য বলতে মন্ত্রণা দেয়, বারবার বলে বিপদের তোয়াক্কা না করতে। ফলে আমার এত লোকরা বিপদে পড়ে, কেউ কেউ ভাগ্যবান না হাওয়াতক লেগে থাকে, কেউ কেউ জীবনের মাঝ সমুদ্রে এসে ডুবে যায় টাইটানিক জাহাজের হতভাগ্য যাত্রীদের মতো।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে কী ঘটবে তা না জানা যেমন স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলে, তেমনই জেনেশুনে বিপদে পড়তে পারা জীবন শেষতক শূন্যে মিলিয়ে যাবে জেনেও জীবনকে জীবনের মতো করে যাপন করার বাসনা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না। আর আধা ঘুম আর জাগরণে ভরা জীবনের কাছে এজন্য মৃত্যু সম্পর্কে কিছু না জানা মানুষরা মাথা নত করে। মাথা নত করে বলেই তারও অনেক সময় রবীন্দ্রনাথের মতো করে বলতে মন চায়-
জীবন যখন ছিল ফুলের মতো
পাপড়ি তাহার ছিল শত শত
বসন্তে সে হতো যখন দাতা
ঝরিয়ে দিতো দু চারটি তার পাতা,
তবু যে তার বাকি রইতো কত।
বাকির হিসেব পেরিয়ে তাইই মূলত আমি আমার ভুলেভরা ফুলের মতোন জীবনটি আবার নতুন করে শুরু করলাম শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টিভেজা ডিসেম্বরের কনকনে শীতের কাঁপুনিতে হাতে থাকা ছোট্ট ব্যাগ থেকে আমার একমাত্র জ্যাকেটটি বের করতে করতে। জ্যাকেটের সাথে বেরিয়ে এলো জ্যাকেট দিয়ে মুড়িয়ে রাখা অতি প্রিয় বাঙালি লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'ছবির দেশে কবিতার দেশে' বইটি। আমি নিজেই নিজেকে সেই ঠান্ডায় আমার জন্য পার্ক করে রাখা চকচকে কালো গাড়িতে উঠতে উঠতে বললাম- প্রীতি, ছবির দেশে কবিতার দেশের নতুন করে পুরনো মনের মতো জীবনটির নতুন বোতলে তোমাকে স্বাগতম!
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
০৩ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
জান্নাতুন নাঈম প্রীতি এসময়ের স্বাধীনচেতা তরুণ লেখক। পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও শিল্পী। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পাশাপাশি ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট, সিআরআই (ইয়ং বাংলা), তরুণ স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন হিমু পরিবহণ ও জাতীয় পাঠাগার আন্দোলনের সাথে। জন্ম সেপ্টেম্বর ৪, ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ, মাগুরা জেলায়।তিনি একাধারে ছোটোদের ও বড়দের জন্য উপন্যাস, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা লেখেন। পাশাপাশি চিত্রাংকন, বিতর্ক, আবৃত্তি ও সংগীতে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। মাত্র সাত বছর বয়সেই ‘Anchor - প্রথম আলো গল্পলেখা প্রতিযোগিতা’য় সেরা গল্পকারের খেতাব জেতেন। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে আত্মজীবনী উনিশ বসন্ত'র জন্য সাহিত্যে 'বিপ্লবী চে গুয়েভেরা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড, ২০১৫ সালে সংবাদ প্রতিবেদনের জন্য দ্বিতীয়বারের মতন ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড লাভ, 'জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ডে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের জন্য সমগ্র সাহিত্যকর্মের উপর প্রথম পুরস্কার পাওয়া, ২০১৪ সালে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড এর সৃজনশীল লেখা শাখার প্রথম পুরস্কার, Anchor - প্রথম আলো গল্পলেখা প্রতিযোগিতায় সেরাদের সেরার খেতাব; ২০০৫, ২০০৬, ২০০৮, ২০১০, ২০১১তে ঐতিহ্য আয়োজিত জাতীয় গল্পলেখা প্রতিযোগিতায় পাঁচবার অন্যতম সেরা গল্পকারের সম্মাননা, ব্রিটিশ কাউন্সিল আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতা ও আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভসহ চিত্রকলা, আবৃত্তি, বিতর্ক ও সংগীতে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।পড়াশুনায় কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের সম্মাননা 'এসো বাংলাদেশ গড়ি'-এর জাতীয় পর্যায়ে কৃতী শিক্ষার্থী এ্যাওয়ার্ড, বিভাগীয় পর্যায়ে মেয়র পদকসহ বেশকিছু পুরস্কার। বেশকিছু চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রেও তাঁর ভূমিকা রয়েছে- ২০১৪ সালে দিল্লির দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার জেতা 'পোস্টার' উল্লেখযোগ্য।তাঁর প্রথম গ্রন্থ শিশুদের জন্য লেখা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই- 'বাংলাদেশ নামটি যেভাবে হল। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- আত্মজীবনী “উনিশ বসন্ত', গল্পগ্রন্থ 'এইসব উড়ে আসা দিন ও শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ 'পেন্সিলে আঁকা গল্প।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন