আত্মজীবনী : জন্ম ও যোনির ইতিহাস
লেখিকা : জান্নাতুন নাঈম প্রীতি
গ্রন্থ : জন্ম ও যোনির ইতিহাস
প্রকাশকাল : ২০২৩, বইমেলা
রচনাকাল :
তরুণ লেখিকা জান্নাতুন নাঈম প্রীতির “জন্ম ও যোনির ইতিহাস” শিরোনামের এই আত্মজীবনীকা মূলক গ্রন্থটি অনলাইন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য এ গ্রন্থটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকার বিতর্কিত এ গ্রন্থটি ২০২৩ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে।বইটির উৎসর্গে তিনি লিখেছেন, “সত্য কথা লেখা, বলা ও প্রকাশ করার দায়ে অভিযুক্ত প্রতিটি মানবাধিকার কর্মীকে, যারা না থাকলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে ভাবা হতো না আমাদের। যারা না থাকলে দুনিয়ার কারাগারগুলো জানতেই পারত না মত প্রকাশের অপরাধে একজন মানুষ হত্যাকারী আর একজন নিরীহ লেখক একই জায়গায় থাকার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে!এবংসব ধর্মের ঈশ্বরকে যারা কেবল আমাদের যোনির ওপর খবরদারি করতে জন্মেছিলেন”
![]() |
জন্ম ও যোনির ইতিহাস || জান্নাতুন নাঈম প্রীতি |
জন্ম ও যোনির ইতিহাস || জান্নাতুন নাঈম প্রীতি (পর্ব - ০১)
লেখকের কথা
এটা হতে পারত একজন সাধারণ মানুষের ডায়েরি, এমন এক ডায়েরি যেখানে মানুষটি নিজের মতো নিজের জীবন কাটাতে পারে, নিজের মতো করে ভালোবাসতে পারে, কথা বলতে পারে স্বাধীনভাবে।
এমনকি এটা হতে পারত একটা রূপকথা, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহরটিতে (বেশিরভাগ লেখক আর শিল্পীদের ভাষায়) এসে পৃথিবীর অন্য এক দেশের অন্য এক ভাষার লেখক আবিষ্কার করতে পারত। নিজেকে ল্যুভর মিউজিয়ামের মর্মর মূর্তিগুলোর মতো, দুষতে পারত। কেমন করে আমাদের অখণ্ড ভারতবর্ষ থেকে আনা জিনিসপত্র এইসব বড় জাদুঘরে হাজার বছর পরে বিরাজ করছে, সাম্রাজ্যবাদের পালে হাওয়া দিতে গিয়ে। আগের শতাব্দীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো করে বলতে পারত- প্রত্যেক শিল্পীরই দুটি দেশ, একটি তার জন্মস্থান, অন্যটি প্যারিস!
কিন্তু এটি তা নয়। এটা এমন এক জীবনের ইতিহাস যে জীবনের জন্য লড়তে হয়, যে জীবনের জন্য ছেড়ে আসতে হয়, যে জীবনের জন্য মাশুল দিতে হয় প্রতি পদে। কারণ যে মানুষটির কথা আমি বলছি সেই মানুষটির আরেকটি পরিচয় সে নারী। প্রকৃতির দেওয়া এই নারীত্বে তার ভূমিকা নেই, কিন্তু কেবলমাত্র নারী হওয়ায় প্রতিটি পদে পদে ভূমিকা আছে যুদ্ধ করার। এই যুদ্ধগুলোর জন্ম ঠিক তখনই হয়েছে যখন সেই মানুষটি কেবল 'সে' হয়ে উঠতে চেয়েছে!
সে অন্যদের কারও মতো হতে চায়নি, চেয়েছে কেবল নিজের মতো হতে! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যেকোনো সমাজেই অন্যের মতো হয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া সহজ আর নিজের মতো করে জীবন কাটানো কঠিন! অবশ্য কঠিনকে ভালোবাসা যায়, যদি তাতে সততা থাকে।
আর নিজের মতো হয়ে ওঠার সেই লড়াইয়ে দাঁড়িয়েও তাই মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমি এসেছি মূলত তিনটা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। প্রথম যুদ্ধটা একজন নারীবাদী নারী হিসেবে একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সাথে, দ্বিতীয় যুদ্ধটা একজন নাস্তিক হিসেবে এর আগামাথা না বোঝা একটা সমাজ আর রাষ্ট্রের সাথে, সর্বশেষ যুদ্ধটা একটা দুর্নীতিবাজ অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেমন করে তিলে তিলে ধ্বংস করে সবকিছুকে তার সাথে।
ছাব্বিশ বছর বয়সে পৃথিবীর যে রূপ আমি দেখেছি, সেই রূপ আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে- ন্যায়ের পক্ষে লেখালিখি করা একজন লেখকের আসলে কোনো দেশ নেই। শুধুমাত্র একটা ফেসবুক পোস্টের জন্য আমাকে প্রাণের ভয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে চার মাস, আদালতে দাঁড়িয়ে শুনতে হয়েছে- আমি কেন লিখলাম? কেন আমি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করলাম?
অথচ আমি সাজানো নাটকের মতো সেই আদালতকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাইনি একটা দেশ কি কখনো তার একজন লেখককে লেখার জন্য আদালতে দাঁড় করাতে পারে?
কিংবা সরকারি দলের লোকেরা, তারা কখনো দেশপ্রেমের ধুলো তুলে বিরোধী আখ্যা দিয়ে জনসম্মুখে আমাকে ধর্ষণ করার, আমার যোনি ধারালো ব্লেড দিয়ে কুচিকুচি করে ফেলতে চাওয়ার আকুতি জানাতে পারে?
আমার আরেক যুদ্ধ মৌলবাদের সাথে। মূলত ধর্মের নামে চলা হত্যাকাণ্ড আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে। যে মৌলবাদ শুধুমাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে লেখার জন্য জঙ্গিদের মন্ত্রণা দেয় একে একে মুক্তচিন্তার মানুষদের খুন করতে, মেয়েদের ঘরে বন্দি করার ফতোয়া জারি করতে, মেয়েদের যোনি আর মস্তিষ্কের ওপর কর্তৃত্ব করতে।
আমি খুব ভালো করে খেয়াল করেছি একটা নড়বড়ে পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের সাথে যুদ্ধ করতে পারাটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কারণ এই যুদ্ধ তরবারির সাথে মস্তিষ্কের, যুক্তির সাথে পেশিশক্তির, মুক্তবুদ্ধির চর্চার সাথে অন্ধত্বের, নারী হিসেবে রাষ্ট্র, সমাজ আর পরিবারের সাথে। এই অসম যুদ্ধে আমি আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু এই যুদ্ধে দাঁড়াতে আমি বাধ্য হয়েছি কেবল নিজের অস্তিত্বের জন্য। আর যারা এই যুদ্ধে আমাকে দাঁড় করিয়েছে তাদের নেতা মূলত অজ্ঞতায় ভরা জনপদ আর সেই জনপদের গালভরা শাসক। আমার কষ্ট নেই, কিন্তু অভিমান আছে। আমার বিদ্বেষ নেই, কিন্তু বিতৃষ্ণা আছে তাদের প্রতি।
একজন লেখক হিসেবে আমি আদালতে দাঁড় করাতে চাই সেই সমাজব্যবস্থাকে- যে সমাজ ডানা কেটে দিয়ে উড়তে বলার প্রতারণা করে, যে সমাজ অন্যায় করে বুক ফুলিয়ে চলে, যে সমাজ মেয়েদের আধা মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে, যে সমাজ ধর্ষককে ছেড়ে দিয়ে ধর্ষিতার কাপড়ের দৈর্ঘ্য মাপে, যে সমাজ ধর্ষককে ছেড়ে দিয়ে ধর্ষিতার গায়ের চামড়ায় মহামূল্যবান সম্মানের তুলাদণ্ড রাখে সুনিপুণ তামাশা করতে।
আমি বিশ্বাস করি- ইতিহাস বলে যা লেখা হয় সেটা বিজয়ীর হাতে লেখা বাকোয়াজ। কিন্তু ইতিহাস লেখার ইতিহাস লিখতে পারেন একজন লেখক যিনি নিজেই একটা জীবন্ত দলিল। কারণ তার হৃদয়ে জমা ব্যথা, দাগ আর নির্যাতনের চিহ্নগুলোই মূলত সেই ইতিহাস যা শাসকের চোখ এড়িয়ে লিখে রাখে মহাকাল। সেটাই মানবাধিকারের পক্ষে একমাত্র মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস ।
তাই যেকোনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মেয়েদের মতো আমি আমার সম্মান আমার পোশাকে, চামড়ায় বা যোনিতে রাখিনি। যদি সম্মান কাউকে করতেই হয়, তবে সে সেটা পাবে তার বিদ্যা, বুদ্ধি, সাহস আর সৃজনশীলতার জন্য।
লেখক এবং শিল্পী হিসেবে বাংলাদেশের মতো প্রতিটি পুরুষতান্ত্রিক দেশের পতাকা হিসেবে আমি দেখি নারীর যোনিকে, মূলত হাইমেনকে যার ওপর কর্তৃত্ব করতেই ধর্মগুলোর জন্ম, যার একটা রাষ্ট্রীয় কাঠামো বানাতেই দুনিয়ার প্রায় সমস্ত সংবিধানেরই প্রাণান্তকর চেষ্টা!
পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
০২ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
জান্নাতুন নাঈম প্রীতি এসময়ের স্বাধীনচেতা তরুণ লেখক। পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও শিল্পী। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পাশাপাশি ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট, সিআরআই (ইয়ং বাংলা), তরুণ স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন হিমু পরিবহণ ও জাতীয় পাঠাগার আন্দোলনের সাথে। জন্ম সেপ্টেম্বর ৪, ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ, মাগুরা জেলায়।তিনি একাধারে ছোটোদের ও বড়দের জন্য উপন্যাস, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা লেখেন। পাশাপাশি চিত্রাংকন, বিতর্ক, আবৃত্তি ও সংগীতে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। মাত্র সাত বছর বয়সেই ‘Anchor - প্রথম আলো গল্পলেখা প্রতিযোগিতা’য় সেরা গল্পকারের খেতাব জেতেন। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে আত্মজীবনী উনিশ বসন্ত'র জন্য সাহিত্যে 'বিপ্লবী চে গুয়েভেরা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড, ২০১৫ সালে সংবাদ প্রতিবেদনের জন্য দ্বিতীয়বারের মতন ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড লাভ, 'জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ডে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের জন্য সমগ্র সাহিত্যকর্মের উপর প্রথম পুরস্কার পাওয়া, ২০১৪ সালে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড এর সৃজনশীল লেখা শাখার প্রথম পুরস্কার, Anchor - প্রথম আলো গল্পলেখা প্রতিযোগিতায় সেরাদের সেরার খেতাব; ২০০৫, ২০০৬, ২০০৮, ২০১০, ২০১১তে ঐতিহ্য আয়োজিত জাতীয় গল্পলেখা প্রতিযোগিতায় পাঁচবার অন্যতম সেরা গল্পকারের সম্মাননা, ব্রিটিশ কাউন্সিল আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতা ও আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভসহ চিত্রকলা, আবৃত্তি, বিতর্ক ও সংগীতে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।পড়াশুনায় কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের সম্মাননা 'এসো বাংলাদেশ গড়ি'-এর জাতীয় পর্যায়ে কৃতী শিক্ষার্থী এ্যাওয়ার্ড, বিভাগীয় পর্যায়ে মেয়র পদকসহ বেশকিছু পুরস্কার। বেশকিছু চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রেও তাঁর ভূমিকা রয়েছে- ২০১৪ সালে দিল্লির দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার জেতা 'পোস্টার' উল্লেখযোগ্য।তাঁর প্রথম গ্রন্থ শিশুদের জন্য লেখা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই- 'বাংলাদেশ নামটি যেভাবে হল। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- আত্মজীবনী “উনিশ বসন্ত', গল্পগ্রন্থ 'এইসব উড়ে আসা দিন ও শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ 'পেন্সিলে আঁকা গল্প।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন