উপন্যাস : বজ্রমেঘ
লেখিকা : ফাবিয়াহ্ মমো
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১৩ই এপ্রিল, ২০২৪ ইং
লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমোর “বজ্রমেঘ” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২৪ সালের ১৩ই এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো |
৯ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো (পর্ব - ১০)
প্রথমাংশ
চরম আশ্চর্যে দ্রবীভূত হয়ে বাকরুদ্ধ অবস্থা!বিশ্বাস করতে পারছে না কী দেখছে সে। দরজার সরু ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকা চোখদুটি স্থিরবিদ্ধ হয়ে আছে। ধীর কদমে পায়ে পায়ে পিছাতে লাগল সেলিম। তারপর হঠাৎ করেই তড়িৎ গতিতে চম্পট দেবার জন্য তাড়াতাড়ি জায়গাটা থেকে কেটে পড়ল। এমন সময় সেই আধ ভেজানো দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিল শ্রেষ্ঠা। ভ্রুঁ কোঁচকানো চোখদুটো দুদিকের ডানে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে কী যেন পরোখ করল। এরপর দরজাটা খট্টাশ করে বন্ধ করতেই সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
- বাইরে তো কাউকে দেখলাম না। পুরো করিডোরটা ফাঁকা। একটা মাছি পর্যন্ত নেই। তুই কোন বেসিসে সন্দেহটা করলি বল তো? কিছু কী হয়েছে?
শাওলিন তখন চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত। পরনের জামাটা নিয়ে শঙ্কা হচ্ছে। এ জামাটা যখনি পরেছে, তখনি একটা না একটা খারাপ ঘটনা ঘটেছে। নিজের এই অন্যমনষ্ক ভাবটা দূরীভূত করে কিছুটা উদ্বেগ স্বরে বলল,
- উহুঁ। কেন জানি মনে হচ্ছিল দরজার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এরকম মনে হবার পেছনে যদিও বিশেষ কারণ নেই। কিন্তু ...
কথাটা বলতে গিয়ে তেমন তাৎপর্য রাখল না শাওলিন। ইচ্ছে করেই অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গটা উহ্য রাখল ও। বড্ড চিন্তা হচ্ছে ওর। মনের ভেতরটা অজানা অদ্ভুত দুরাশায় এইটুকু হয়ে যাচ্ছে। উদ্ভট এক অস্থিরতায় বুকের ভেতরটা অশান্ত জমিনে পরিণত। তবে বাইরে থেকে পুরোপুরি স্বাভাবিক দেখাচ্ছে ও। শ্রেষ্ঠা সিল্কের খুব সুন্দর একটি মাখন রঙা শাড়ি পড়েছে। হাতভর্তি সাদা ঝলমলে রেশমি চুড়ি। সেমিনার উপলক্ষ্যে শাড়িটার রঙ ও পরন খুব চমৎকার হলেও মনে মনে বেচারির বিরাট আফসোস। শত জোরাজুরি সত্ত্বেও শাওলিন তার কথা শুনল না। এই পরিবেশ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে শাড়ি পরতে রাজি হয়নি। পরতে চেয়েছিল খুবই সাদামাটা এবং সাধারণ একটি জামা। তবে শ্রেষ্ঠা সেকথা শুনে কঠিন এক ঝাড়ি মেরে মানানসই একটি জামা পছন্দ করে দিয়েছে। শ্রেষ্ঠা বয়সে ও পড়াশোনায় শাওলিনের চেয়ে বড়। ফলে কিছু কথা ও কাজ শাওলিন সহজে ফেলতে পারে না। শ্রেষ্ঠা ঝটপট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানে ঝুমকা পরছিল তখন। অস্থির চোখদুটো হঠাৎ আয়নার বাঁদিকে পরলে ঝুমকার হাতদুটো থমকে যায়। চুপ করে বিমোহন সরল চোখদুটো দেখতে থাকে ওকে। আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আপাদমস্তক বারবার বিস্ময়ভরা চোখে দেখতে থাকে শ্রেষ্ঠা। বিশ্বাস হয় না . . বিশ্বাস হতে চায় না! ওর ছিপছিপে গায়ে হালকা গোলাপি বর্ণ জামা। স্বল্প ঘেরবিশিষ্ট, কিছুটা লম্বা। গলার ডানপাশ থেকে ডানকাঁধ বরাবর সাদা ওড়না ঝুলছে। দুটো মসৃণ সুন্দর পা সাদা পাজামায় শালীনভাবে আবৃত। ওর মুখজুড়ে যে অপার্থিব, ঐন্দ্রজালিক, মায়াকুহকী সৌন্দর্যটা ফুটে উঠেছে, তা অবর্ণনীয় সুন্দর। আজও স্পষ্ট মনে আছে, ঠিক এভাবে . . এ ভূষাতে . . এমনই বাহুল্যবর্জিত সাজে ওকে দেখেছিল শ্রেষ্ঠা। ভার্সিটির নতুন শিক্ষার্থীদের বরণ করতে আয়োজন করা হয়েছিল অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানের দক্ষ উপস্থাপক ছিল শ্রেষ্ঠা। সেদিন শ্রেষ্ঠার জন্য ছিল চরম দূর্ভাগ্যময় দিন। অত্যধিক গরমের দরুন বারবার প্রেশার ফল করছিল ওর। দ্রুত স্যালাইন আনানোর জন্য মানুষ পাঠাতেই হঠাৎ একটি অল্পবয়সি মেয়ে কাছে এল। চেহারায় অহংকারমুক্ত ছাপ, চোখে বিনীত সম্ভ্রম দৃষ্টি। হাতের বোতলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
- এতে স্যালাইন পানি আছে। সম্পূর্ণ ফ্রেশ। এখনো পানিটা খাওয়া হয়নি। আপনি এটা খেতে পারেন আপু। কিছুটা খেয়ে নিন।
ঘর্মাক্ত করুণ মুখটা তুলে একপলক শুধু চাইল শ্রেষ্ঠ। দুর্বল চোখে কী বুঝল কে জানে, কাঁপা কাঁপা হাতে বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিল। অনুভব করল কিছুটা ভালো বোধ হচ্ছে। উপস্থিত এতোগুলো মেয়ের মাঝে তাৎক্ষণিক যে সাহায্যটুকু পেয়েছিল, তা আজও স্মৃতির পাতায় রঙিন অক্ষরে লিপিবদ্ধ করা আছে। শ্রেষ্ঠা ভোলেনি। সেদিনের সেই সাক্ষাতের পর আর কক্ষনো শাওলিনের সৎসঙ্গ ছাড়েনি শ্রেষ্ঠা। অসম বয়সি সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক এখনো পূর্ণমাত্রায় বহাল। মনে মনে এসব নিয়ে ভাবতেই ফের আয়নার দিকে তাকাল শ্রেষ্ঠা। কানে পুনরায় পরতে লাগল ঝুমকা। ঠোঁটে বিমুগ্ধ হাসি নিয়ে সরস কণ্ঠে বলল,
- তুই যে আমার কতো ছোট, মাঝে মাঝে আমি ভুলে যাই জানা। তোর সঙ্গে রুম শেয়ার, কথা শেয়ার, দুঃখ শেয়ার করতে গিয়ে আমি ভুলেই যাই তুই যে আমার ছোট বোন নিপার বয়সি। আমার মনে-ই থাকে না আমি যে তোর ভালোই সিনিয়র। তোকে যে কতটা আদর করি, ওই সম পরিমাণ আদর আমি নিপাকেও করি না। অথচ নিপা আর তুই কিনা ব্যাচমেট। তুই কী জানিস তোদের ফ্রেশারস্ প্রোগ্রামের পর থেকে তোকে ছোট বোনের মতোই ভালোবাসি?
হঠাৎ নিখাদ মনের বাক্যগুলো অকপট সুরে বলে ফেলল শ্রেষ্ঠা। চোখ তুলে দেখল, শাওলিন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মৃদু হাসিতে হাসছে। দীঘল কালো চোখদুটি হাসির ঝিলিকে বড় অপূর্ব লাগছে। একটা হাত শ্রেষ্ঠার হাতের উপর রেখে মোলায়েম কণ্ঠে বলল শাওলিন,
- তুমি জানো আমি তোমাকে কতটুকু সম্মান করি শ্রেষ্ঠা। আমারও যে বড় ভাই, বড় বোন কেউই নেই, তুমি তো সব জানো। আজ তোমাকে নাম ধরে ডাকি শুধু তোমার কারণে। তুমি আমার মুখে আপু ডাক শুনতে চাও না। আর চাও না বলেই ভার্সিটির অনেকেই ভাবে আমি তোমার সমবয়সি ফ্রেণ্ড। সেলিম ভাইদের মতো একই ব্যাচমেট। আমার স্কুল, কলেজের কোনো বন্ধু নেই। তুমি ব্যতীত আর একটা মেয়েকেও দেখলাম না আমার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো শোনার পর ভালো ব্যবহার করেছে। সবাই পিঠ পেছনে নানান রকম কথা রটিয়েছে। হাসাহাসি করেছে। একমাত্র তোমাকেই দেখলাম বড় হয়ে বড়দের মতো শালীন আচরণ করেছ। এখান থেকে চলে গেলে আজকের এই দিনগুলো খুব মিস করব জানো? হয়তো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই কথাগুলো ভুলব না। আমার জীবনের সবচাইতে সুন্দর সিদ্ধান্ত ছিল তোমার কথা মেনে কাউকে না জানিয়ে এখানে চলে আসা। একটা স্বাধীন ট্যূর দেওয়া। একটা চিন্তাহীন সময় কাটানো। একটা বিশ্বাসযোগ্য মানুষের কাছে বিশ্বাস রেখে অনেক কিছু শেখা। তোমার কাছে রাজনীতি ছাড়া সবই শিখেছি। হয়তো সেটাও একদিন সঙ্গদোষে শিখে যাব। কী বলো?
কথাটা বলেই প্রাণবন্ত হাসি দিল শাওলিন। নিঃশব্দ, নীরব, বর্ণনাতীত সুন্দর। কণ্ঠের ওই শান্ত বিনীত গাম্ভীর্যটুকু আচ্ছন্ন করে দেয় মন। আজ আরো একবার শ্রেষ্ঠা স্বীকার করতে বাধ্য হলো, ওর কথার ভেতরে, শব্দের ভাঁজে, অনুভূতির সিন্দুকে অতলস্পর্শী এক সৌন্দর্য লুকোনো আছে। যে সৌন্দর্য ওর রূপ-স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের চেয়ে বড্ড বেশি সরস। হাতের উপর থাকা ওর হাতটা আপন মুঠোয় পুড়ল শ্রেষ্ঠা। সদাহাস্য ভঙ্গিতে নেত্রী নেত্রী ভঙ্গি দেখিয়ে বলল,
- আমি থাকতে তোর রাজনীতি শেখা লাগবে না। কোনো প্রয়োজন নেই। তোর ব্যক্তিগত বিষয়ে কেউ কাউন্টার করলে সোজা আমার নাম বলবি। কেউ যদি এরপর থেকে নতুন নাটক চালু করে, সেটা দেখার দায়িত্ব আমার। এখন চল, অনেক ফাঁকা কথায় সময় নষ্ট হয়েছে। ওরা বোধহয় এতোক্ষণে চলেও গেছে। আমরা এবার নামি, নাকি?
- হ্যাঁ, চলো। যাওয়া যাক।
দুই অসমবয়সি বান্ধবি হোটেলের সমস্ত চেকআউট শেষে হোটেলের বাইরে বেরোল। আজ রৌদ্রের দাপট ভয়াবহ রকম বেশি। আবহাওয়া জরিপে জানা গেছে, আগামিকাল বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সূয্যিমামা আজ রেহাই দিবেন না। দেহের চামড়া দগ্ধ করা রোদ্দুর মাথায় নিয়ে শ্রেষ্ঠা ও শাওলিন হোটেলের বাইরে গাড়ির কাছে আসে। গাড়িটি ফাঁকা। হোটেলেল দারোয়ান জানায় বাকিরা একটু আগে বেরিয়ে গেছে। তবে এই গাড়িটি যিনি ড্রাইভ করবেন, তিনি ওদের দুজনকে সিট গ্রহণ করতে জানিয়ে গেছে। এক্ষুণি ফিরে আসবেন। শাওলিন আজ দেখল ড্রাইভারের পাশের আসনটি সম্পূর্ণ ফাঁকা এবং ড্রাইভার মানুষটি যেহেতু ওই তিন যুবকের কেউ হবে না, তাই শাওলিন নির্ভারচিত্তে সিটবেল্ট বেঁধে সামনেই বসল। শ্রেষ্ঠা অবশ্য বসলো পুরো ব্যাকসিটের ফাঁকা আসনজুড়ে। এমন সময় ড্রাইভিং ডোর খুলে বসে পড়ল সেলিম। গায়ে ঝটপট সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে একনজর বাঁদিকে চাইল। অমনেই দেখতে পেল শাওলিনের বড় বড় চক্ষুদুটি বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে। একবার মাথা ঘুরিয়ে পেছনে মোবাইল টিপতে থাকা শ্রেষ্ঠার দিকে চাইল, আরেকবার চোখ তুলে চাইল সেলিমের দিকে। দুর্বোধ্য ক্রোধে ওর চিকন সুন্দর ভ্রুঁদুটি কপালে কুঞ্চন রেখা ফেলেছে। সেলিম একটা তেলতেলে হাসি ছুঁড়ে গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে বলল,
- গুড চয়েস।
বাঁকা সুক্ষ্ম ইঙ্গিতটা ড্রাইভারের পাশের সিটে গাঁধার মতো বসার জন্য ছুঁড়ল। শাওলিন নিজেও বুঝতে পারছে না আসল গলদটা কোন জায়গায় হয়েছে। এই গাড়ি তো চালানোর কথা ছিল ড্রাইভার চাচার। কিন্তু চাচার পরিবর্তে সেলিম কীভাবে? সেলিম কী তাহলে ইচ্ছাকৃত এখানে অদলবদল ঘটিয়েছে? ও আসলে চাচ্ছে কী! অসহ্য! একটা অসভ্য অভদ্র আদবহীন যুবকের সঙ্গে তর্ক চালাতে ইচ্ছেও করছে না ওর। আপাতত শ্রেষ্ঠার সামনে শ্রেষ্ঠার দোস্তকে অপমান করার মতো কাজটা করতে চাইছে না। তবে শাওলিন এর একটা জবাব অবশ্যই দিবে। কিন্তু সেটা এই মুহুর্তে নয়। অন্যদিকে সেলিম গাড়িতে বসতে না বসতেই মেঘ না চাইতে জলের আর্বিভাব দেখছে। বারবার প্রত্যাখাত হবার মতো মনমানসিকতা সেলিমের ধাঁতে নেই। কিন্তু পাশে বসা এই হিসেবি জবানের মেয়েটা খুবই নাচাচ্ছে। আর নয়। কাল পর্যন্ত সময়, কাল পর্যন্ত হিল্লে। নইলে শ্রেষ্ঠার সঙ্গে কঠিন একটা বোঝাপড়া চলবে। এই শাওলিন যে শক্ত ধাতের ধাতুর দিয়ে গড়া, তা পরতে পরতে বুঝতে পেরেছে সেলিম। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রতিবারই এই মেয়ে খুব দক্ষতার সাথে গভীর পর্যায়ের অপমান করে যাচ্ছে; যে অপমান তৃতীয় পক্ষের ধরা বা বোঝা সাধ্য না। পাহাড়ি মসৃণ পথ মাড়িয়ে উচ্চগতিতে ড্রাইভ করছে সেলিম। ড্রাইভের ফাঁকে ফাঁকে চোরাভাবে চোখ ঘুরাচ্ছে বাঁয়ে। ওই নিঃশব্দ মুখটা জানালার দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। বাতাসে চুলের ঝাপটায় মুখের এপাশটা দেখা যাচ্ছে না। শ্রেষ্ঠা সেই শুরু থেকেই কানে হেডফোন গুঁজে প্রেমালাপে মগ্ন। সেলিম দেখল, শাওলিনের কোলের উপর থাকা হাতদুটো ওর চামড়ার হ্যাণ্ডব্যাগটাকে খামচে যাচ্ছে। নিষ্ফল ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ দেখে সেলিম টিটকারির সুরে বলল,
- তুমি চাইলে আমার হাতটা টিপে দিতে পারো। আমি মাইণ্ড করব না জানা।
কথাটা শোনার পর আস্তে আস্তে মুখটা জানালা থেকে এপাশে ঘুরাল শাওলিন। চোখদুটো মানুষের মতো দেখতে এক অমানুষের মুখে স্থাপন করে বলল,
- নিজের মান, সম্মান, খাসলত এরকম কথাবার্তা বলে খোয়াবেন না। শিক্ষিত চেহারায় এইসব কথাবার্তা খুবই দুর্গন্ধ লাগে। চুপ থাকবেন।
শ্রেষ্ঠা পেছনে না থাকলে তর্জনী তাক করে কথাগুলো বলতো শাওলিন। তবে শক্তদৃষ্টিতে শক্তভাবে কথাগুলো শুনিয়ে ছাড়ল সে। ভারি একবুক দম সশব্দে ছেড়ে আবারও মুখটা জানালার বাইরে ফেরাল। কিন্তু সেলিমের মুখটা কেমন টকটক হয়ে গেল তা আর লক্ষ করেনি। গাড়িটা থামিয়ে সরাসরি পেছনের সিটে বসা যেতে পারে, কিন্তু শাওলিন শ্রেষ্ঠার সেমিনারের আগে সন্দেহজনক কিছু করতে চাচ্ছে না। একবার সন্দেহ ঢুকলে তুলকালাম কাণ্ড করবে শ্রেষ্ঠা। তার চেয়ে বুদ্ধি করে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করল শাওলিন। নাম্বার ডায়াল করে ঝটপট মণির কাছে কল বসিয়ে কানে ফোন চাপলো। মণিরও খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন।
.
সুবিশাল বাংলো বাড়িটা তাপীয় রৌদ্রে দুপুর স্নান করছে। গাছের কোনো এক মগডালে বসে 'বউ কথা কও' পাখিটি ডাকছে। ঘুম জড়ানো দুপুরে শরীর-মন আলস্যে নুইয়ে যায়। তেমনি খাওয়া-দাওয়ার পর ভাতঘুমের আয়োজন করেও জানালা দিয়ে আবার চাইছেন ফাতিমা। তার অপেক্ষা ব্যাকুল চক্ষু আর তর সইছে না। সাতসকালে জানিয়েছিল ওরা দুপুরের মধ্যে পৌঁছুবে। প্রায় পাঁচ-ছয়জনের একটি দল বোধহয় এখানে আসবে। কিন্তু কোথায় ওরা? এখনো আসছে না কেন? অধৈর্য, ব্যাকুলিত, প্রতীক্ষিত মন আরো একটু আঁট বেঁধে এবার জোরপূর্বক শয্যায় নিবিষ্ট হলো। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা এঁটে দুহাতে ডায়েরিটি মেলে ধরলেন তিনি। দমকা বাতাসে গাছের মটমট ডালের শব্দ শুনতে শুনতে পড়তে লাগলেন ডায়েরিটি,
রবিবার।
শরৎকাল।
'They made me weak.
But they ask me, why are you so weak? '
আমাকে তারা দুর্বল বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারাই আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি কেন এতো দুর্বল?
[Shawl33n] .
.
মঙ্গলবার।
শরৎকাল।
বেশ জ্বরে ভুগছি। বোধহয় দুঃস্বপ্নটার দরুন জ্বর হাজির হয়েছে। তবে আজ কিছুটা ভালো অবস্থা লক্ষ করছি। অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেটগুলো সময়মতো কাজে দিচ্ছে। একটা দুঃসংবাদ লেখার জন্য অকল্পনীয় সাহস নিয়ে এসেছি। লিখব লিখব করে সাহস হয় না। ভয় হয় . . খুব অদ্ভুত রকমের গা শিরশিরে ভয়। মণির শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। লিভার এবং হার্ট দুটোই আমার কাছ থেকে মণিকে ছিনিয়ে নেবার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র করছে। ব্যয়বহুল চিকিৎসায় সে ষড়যন্ত্রগুলো থামতে পারে। দুশ্চিন্তায় ঘুমোনো যায় না, খাওয়া যায় না, সহ্য করা অসম্ভব।
পৃথিবীর ষড়যন্ত্রগুলো কবে থামবে? একজন একজন করে সবাই বুঝিয়ে দিচ্ছে এই পৃথিবীর স্রেফ ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য। যারা ষাঁড়যন্ত্র বুদ্ধি নিয়ে চলাচল করে তাদের জন্য এ পৃথিবী বাসযোগ্য নয়। কী নিষ্ঠুর পর্যায়ের সহিংসতা . . !
.
এটুকু পড়ে ডায়েরিটা বন্ধ করলেন ফাতিমা নাজ। কথাগুলোর নীচে যে ভারি ভারি কথাগুলো বুঝিয়েছে, তা পড়ে প্রবল আশ্চর্যে চুপ রইলেন তিনি। এমন এমন বাক্য এখানে লিখেছে, যা জীবনের সম্পূর্ণ ঘটনা লিপিবদ্ধ নয়, আবার লিপিবদ্ধও। বহিরাভূত মানুষ এসব পড়তে বসলে রাগে বিরক্তিতে ডায়েরি ছুঁড়ে ফেলবে। কেমন এক আশ্চর্য দহনে দগ্ধ হয়ে ফোনটা বালিশের তলা থেকে নিলেন তিনি। একদণ্ড না ভেবে সরাসরি কললিস্টের প্রথম নাম্বারটিতে কল দিলেন ফাতিমা। কিছুক্ষণ পর কলটা রিসিভ হতেই পরিষ্কার মার্জিত কণ্ঠে সালাম জানিয়ে বললেন,
- অফিসার সাহেব, বাসায় ফিরছেন কখন? আপনাকে জানিয়েছিলাম আপনার ভূতের কেল্লায় আজ গুটিকয়েক মেহমান আসবে। আপনার রুমটাও আজ লাগবে। মেহমানরা থাকবে। আপনি আসছেন কখন? . . .
.
মানুষ সমাগম সেমিনারে শ্রেষ্ঠা বড্ড ব্যস্ত। উপস্থাপনার কাজ সুচারুরূপে করলেও শাওলিন একদণ্ড থাকতে পারছে না। ডানদিকের চেয়ারে গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছে সেলিম। একটু পরপর অসংলগ্ন হাত বিভিন্ন বাহানায় ঘুরছে। পায়ের কাছেও থেমে নেই অবাধ্য পায়ের বিচরণ। দু হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে সটান সামনে তাকিয়ে আছে শাওলিন। চর্তুদিক থেকে মানুষের ঘনবেষ্টিত উপস্থিতি এই লোলুপ প্রবৃত্তিকে আরো বেশি আশকারা দিচ্ছে। চেয়ারটা সর্বোচ্চ সীমায় সরিয়ে শরীরটা চূড়ান্ত রকম চাপিয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে শাওলিন। তবু পাশের পাশবিক পাষণ্ডটা আবারও পায়ের কাছে পা ঠেকিয়ে এবার অপ্রীতিকর কাজটাই করল! জুতোসমেত পা'টা শাওলিনের পায়ে ছুঁয়ে আস্তে আস্তে সেটা উপরের দিকে তুলতে থাকল। একটা অসহ্য ঘেন্নার অনুভূতি সমস্ত শরীরে রি রি করে উঠল। আর একদণ্ড সেখানে বসে রইল না শাওলিন। শ্রেষ্ঠাকে সেখানে রেখেই নিঃশব্দে চেয়ার ছেড়ে সোজা বাইরে চলে গেল। দ্রুতপায়ে সামনের একটি লেকের কাছে যেতে নিলে হঠাৎ দুম করে পথ আঁটকালো সেলিম। দুই হাত দুই দিকে মেলে জান্তব কাকতাড়ুয়াটার মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। শাওলিন একটুও থেমে থাকল না। দুই হাতে প্রচণ্ড শক্তিতে সেলিমকে বুক বরাবর ধাক্কা দিয়ে আগুনচোখে চাইল শাওলিন। ডানহাতের তর্জনীটা সোজা তাক করে কঠোর ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠল,
- আমি এরপর থেকে মুখ দিয়ে জবাব দেব না মহাশয়। এখনো বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শেষ সুযোগ দিচ্ছি, সরে যান। আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করুন। আমার পিছনে ঘুরঘুর করা কমান। আমি আপনার চেহারাটাও দেখতে চাই না। শ্রেষ্ঠার বন্ধু বলে ওই অর্থে শেষ ওয়ার্নিং দিলাম। এরপর থেকে আর নয়।
অমন এইটুকুনি মেয়ের আগুন ঝলসানো কথা শুনে তোপে ফেটে পড়ে সেলিম। ক্রোধের ক্রুদ্ধশিখায় জর্জরিত হয়ে গরম চক্ষুতে বলে,
- বয়সের চাইতে বেশি বড় বড় কথা বলতে নেই সোনা। জানোই তো, তোমাকে ভদ্রভাবে নানা উপায়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সুযোগ দিয়েছি। ফ্যাকাল্টির সামনে গিয়ে অপেক্ষাও করেছি। বড়লোকি দেমাগ দেখিয়ে যেই রঙ্গতামাশা তুমি করেছ না, ওটার পাট আমি তিলে তিলে শুষব। আমার ক্ষমতা মনে হয় ভুলে গেছ। শ্রেষ্ঠার বান্ধবি বলে এটা ভেবো না, ওর দোহাই দিয়ে তোমার রফাদফা আমি ছাড় দিব। কী, বুঝছ না হিসাব?
এতোক্ষণ, এতোদিন, এতোমাস, হয়তো আর দুটো মাস পেরোলে একটা বছর হবে। এই গোটা সময়জুড়ে একটা অসভ্য অভদ্র ফাজিল মস্তিষ্কের ছেলেকে বুঝিয়ে গেছে শাওলিন। কোনোকিছু জোরপূর্বক না হলে জোর জবরদস্তিতে হবে না। আর শাওলিনের রুচি সেদিনই এই অসভ্যটার উপর বিষিয়ে উঠেছে, যেদিন জেনেছে ওর চাচাতো বোন রোজা হায়দারের সঙ্গেও গভীর প্রেম ছিল। অথচ, সে সম্পর্ক তিন মাসের বেশি টেকেনি। পোশাক বদলানোর মতো যদি মন বিনিময় সম্পর্ক ঘটে, তবে বলা বাহুল্য সেটি জঘণ্য পৈশাচিক খেলার সমতুল্য। শাওলিন ভীষণ ধৈর্য পুষে আবারও ঠাণ্ডাভাবে বুঝিয়ে বলল,
- দেখুন, আপনাকে আমি চিনি না। চিনলেও চিনতে চাই না। এই ট্যূরে আসার পেছনে শুধু শ্রেষ্ঠা আর সোহানার অবদান আছে। ওদের একজন আমার ফ্যাকাল্টির সিনিয়র। আরেকজন সম পর্যায়েরই অন্য ফ্যাকাল্টির সিনিয়র। তাদের কথা মেনে এই ট্যূরে এসেছি ঠিকই, কিন্তু এখানে কোথাও বলা নেই আপনার প্রস্তাব আমার মানতে হবে। শুধু শুধু আমার পেছনে সময় বরবাদ করছেন।
সেলিমও কোনো অংশে থেমে নেই। এক কদম এগিয়ে বিদ্রুপ হাসিতে জানাল,
- তোমার কথায় চিঁড়া ভিজছে না যে! চালাও চালাও।
কথার ধরণ শুনে ঠোঁট গোল করে ক্রোধশ্বাস ছাড়ল শাওলিন। গরম ও ক্রোধে ঘেমে উঠেছে মুখ। গভীর এক শ্বাস নিয়ে সেলিমের দিকে শেষবারের মতো বলল,
- আপনাকে জবাব দেবার জন্য আমার হাত উঠবে সেলিম। আমি রোজা, শ্রেষ্ঠা, সোহানার মতো আপনাকে দু পয়সারও মূল্য দিই না। বুঝতে পেরেছেন আপনি কেমন নিকৃষ্ট? নোংরা মুখটা নিয়ে এখান থেকে সরে দাঁড়ান।
প্রতিটি বাক্যবাণে ফুঁসলে ওঠা পশুর মতো ফোঁস ফোঁস করছিল সেলিম। যেকোনো মুহুর্তে প্রচণ্ড ভীতিকর অবস্থা ঘটিয়ে ফেলবে! শাওলিন কথাগুলো পাশ কাটিয়ে যেই সামনের দিকে এগোতে নিচ্ছিল, ঠিক তখনই ওর চুলের মুঠিতে হাত বাড়াতে উদ্যত হয়েছিল সেলিম। কিন্তু পারল না। হঠাৎ সেখানে ভোঁ ভোঁ বাইকের আগমনে ঘটনাভঙ্গ হলো! সেলিম দ্রুত নিজেকে সামলে নিতেই দেখল শাওলিনের একটু সামনে বাইকটা থেমেছে। বাইক আরোহি আর কেউ নয়, স্বয়ং শ্রেষ্ঠার প্রেমিক পুরুষ! মাথা থেকে হেলমেট খুলতেই একগাল হাসি ছুঁড়ে বলল রাহাত,
- ওরে বাব্বা! জানা আপু দেখি বান্ধবির মতোই মারদাঙ্গা অপ্সরী সেজে বেরিয়েছে। তা আপনার শ্রেষ্ঠা বান্ধবি কোথায় আছে আপু? ওর নাকি সেমিনার তিনটায় শেষ হবে? তিনটা পাঁচ বাজে তো।
শাওলিন এই দেবদূত মানুষটার কাছে মনে মনে চরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। এমন এক দুর্বিনীত পরিস্থিতিতে এসেছে যে সেলিমও এখন শান্ত। শাওলিন ধীরপায়ে রাহাতের দিকে এগোতে এগোতে শুধোল,
- আপনি এখানে কী . . হঠাৎ . . বুঝলাম না! শ্রেষ্ঠা কী জানে আপনি চট্টগ্রামে এসেছেন?
- আরে না না, ওকে জানাইনি। আজ আমার জন্মদিন ছোট আপু। ওকে সারপ্রাইজ দিতে সোজা বাইক নিয়ে এসেছি। তোমার যদি কোনো সমস্যা না হয়, একটা রিকোয়েস্ট আছে।
শাওলিন কিছুটা উজবুক দৃষ্টিতে শুধোয়,
- কী রিকোয়েস্ট?
- রিকোয়েস্ট হচ্ছে আমি শ্রেষ্ঠাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। বার্থডে সেলিব্রেশনটা একসাথে করব। তোমার এতে কোনো আপত্তি আছে? সেলিব্রেশন শেষে আমিই ওকে তোমাদের ঠিকানামতো পৌঁছে দেব। এখন বার্থডে গিফট হিসেবে এইটুকু রিকোয়েস্ট রাখা যায় জানা?
কথাটা শোনার পর গলায় কাঁটা আঁটকে গেছে শাওলিনের। মুখ ফুটে স্বর আসছে না। পেছনে যমদূত, সামনে দেবদূত, শাওলিন পরেছে মাঝামাঝিতে। কী করে এখন বলবে শ্রেষ্ঠা নিয়ে গেলে ও একা হয়ে যাবে! সেলিমের গাড়িতে একা একা ফিরতে হবে! কিছুক্ষণ আগে যে সমস্ত আচরণ ও দুর্ব্যবহার সে করেছে, এর ভিত্তিতে একটুও মনে সাহস পাচ্ছে না শাওলিন। আবার এদিকে বেচারা এই মানুষটার জন্মদিন। কর্মজীবনে অতিব্যস্ত থাকায় শ্রেষ্ঠার সঙ্গে দেখাও হয় তিন মাস অন্তর অন্তর। পুরো এক গোলকধাঁধায় ফেঁসে থমকে গেল শাওলিন। কিছুক্ষণ মন দিয়ে ভেবে মনের উপরেই পাথর বসিয়ে শান্তস্বরে জানাল,
- ঠিকআছে। শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে গেলে ও নিজেও খুশি হবে। আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। সেমিনার সম্ভবত শেষ। ওদিকটায় দাঁড়ালে শ্রেষ্ঠাকে দেখতে পাবেন।
আঙুল দিয়ে দূর ওদিকে ইশারা বুঝাতেই অবশেষে বিদায় নিল শাওলিন। সেমিনারও শেষ, শ্রেষ্ঠাকেও দূর থেকে দেখা গেল। শ্রেষ্ঠা বিদায় জানিয়ে বাইকে উঠতেই এক ঝটকায় বাইক স্টার্টটা হয়ে বহুদূর চলে গেল। বিষয়টা অবশ্য ওর কাছে মর্মান্তিক সুন্দর। পায়ে পায়ে এবার গাড়ি পার্ক করা জায়গাটায় পৌছুঁতেই তৎক্ষণাৎ সটান দাঁড়িয়ে পরল শাওলিন। চোখের সামনে দেখল, সেলিম গাড়ির ব্যাকসিটগুলোতে বোতল উপুড় করে ঝপঝপ পানি ঢালছে। নরম তুলতুলে গদিগুলো পুরোপুরি শেষ। জবজবে অবস্থা। . . . মস্তিষ্ক কাজ করছে না . . .
দ্বিতীয়াংশ
চিন্তার আকাশে ধূলোর ঝড়। ভাবনার দুয়ার বন্ধ। শাওলিন জানে না কী হতে চলেছে। ভয়ে বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে। চোখমুখ বড্ড শান্ত ওর। নিজেকে অবলা, নিঃস্ব, পাণ্ডুর ভাবাতে চায় না ও। পায়ে পায়ে আবারও এগোতে লাগল সামনে। সামনে শূন্য বোতল হাতে নির্লজ্জ এক পাষণ্ডের মতো আদনান আবীর সেলিম হাসছে। বড় বিদঘুটে, খারাপ, কুৎসিত ওই হাসিটা। শাওলিন জানে গাড়িটার ব্যাকসিটে আর বসা যাবে না। এখানে উবার বুক করার মতো আধুনিক পদ্ধতিটি নেই। সেলিমের গাড়িতে চুপচাপ উঠে বসা ছাড়া আর কোনো পন্থা খোলা নেই। নিজের ভাগ্যকে অগ্নি দুয়ারে ছেড়ে দিয়ে গাড়ির সমুখ সিটে বসে পড়ল ও। পেছন থেকে শুনতে পেল পুরুষালি কণ্ঠের বিদ্রুপ কলহাস্য। হো হো করে দুনিয়া কাঁপিয়ে হাসছে সেলিম। যেন হাতের মুঠোয় ইদুঁর ধরার মতো জংলী আনন্দে সে মত্ত। ধড়াম করে ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাটা খুলে ফেলল। বিকট তীক্ষ্ম শব্দে শাওলিনের বুকটা মোচড়ে উঠল। ব্যাগের চেইন গলিয়ে ওর ছোট্ট হাতটা আঁতিপাতি করে আত্মরক্ষার জন্য কিছু খুঁজছে। কিন্তু আফসোস, পেল না! আসার সময় শ্রেষ্ঠার অনুরোধে শ্রেষ্ঠার একটি হ্যাণ্ডব্যাগ সঙ্গে নিয়েছে। পাশ থেকে পুরুষ পাষণ্ড মূর্তিটি অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠল,
- এবার কী হবে? খুব তো চোটপাট দেখিয়েছ। গায়ে ফোস্কা মেরে কথা বলেছ। এখন সেই দাপট কোথায়? কার পাশে বসতে হয়েছে এখন? এজন্যই বলেছিলাম ওসব দুনম্বরি চোটপাট, ভড়ং দেখাতে যেয়ো না। নাহলে আমি কী করতে পারি . . .।
প্রতিটি কথা অদ্ভুত ভয় ধরিয়ে বললেও কোনো প্রত্যুত্তর করল না শাওলিন। একদম চুপ করে রইল। পুরোপুরি শান্ত। চোখ তুলে জানালার বাইরে অভ্রান্ত দৃষ্টিতে আকাশের মেঘখণ্ড দেখছে। অবাধ্য ক্রোধে, ক্ষোভে, আক্ষেপে চোখে পানি আসতে চাইছে। তবু অশ্রুশিশির জমতে দিচ্ছে ওর নিষ্পাপ দুটি চক্ষুতারায়। গাড়িটা বেকায়দায় স্টার্ট দিতেই বিপজ্জনক ঝাঁকুনি মেরে রাস্তায় উঠে গেল। আকস্মিক এই বর্বরতায় স্তব্ধ হয়ে শাওলিন পিলে চমকে ডানে তাকায়। সেলিমের চোখমুখে ভীতিকর ছাপ, বিপজ্জনক মূর্তিটি ফুটে উঠেছে। হাতটা তখনো ব্যাগের ভেতরে খড়কুটোর মতো কিছু খুঁজে চলেছে। হঠাৎ মনে ওর হলো, হাতের কাছে কলমের মতো কিছু ঠেকল। সেটাই পাঁচ আঙুলে মুষ্টিবদ্ধ করে আঁকড়ে ধরল শাওলিন। মুখটা ডানপাশ থেকে সরিয়ে সামনের রাস্তার দিকে ফেলতেই চোখদুটো আশ্চর্যে ছানাবড়া! সামনে থেকে একের পর এক উচ্চগতির গাড়ি আসছে, আর সেলিম সেগুলো টেক্কা দিচ্ছে বিপজ্জনক গতিতে! শাওলিন সঙ্গে সঙ্গে গলা তীক্ষ্ম করে বলে উঠল,
- গাড়ি সাবধানে চালান সেলিম। এটা আপনার হাইওয়ে রুট নয়। আপনি বেমালুম স্পিড তুলে ড্রাইভ করছেন। সেলিম, আপনি কিন্তু অস্বাভাবিক স্পিড তুলছেন, গাড়ি থামান বলছি!
মিনিটের ভেতর এক ধাক্কায় স্পিড তুলে দিয়েছে সেলিম। ভয়ে বিস্মিত চোখদুটি বিস্ফোরণে ডুবো ডুবো শাওলিনের। স্পিডের কাঁটা অত্যধিক মাত্রা ছুঁয়ে ফেলেছে! শাঁই শাঁই গতিতে বাতাস তেড়েফুঁড়ে অস্বাভাবিক অবস্থায় চলছে। শাওলিন তৎক্ষণাৎ বিপদটি আঁচ করতে পেরে ক্রুদ্ধ সর্বস্ব গলায় ধমকে উঠল,
- গাড়ি থামান বলছি! আপনি বাড়াবাড়ি করছেন সেলিম.. থামান! গাড়ি স্লো করুন, নাহলে এক্ষুণি . . .
হঠাৎ ভয়ংকর তীব্র যন্ত্রণায় চোখমুখ খিঁচিয়ে ফেলল শাওলিন। প্রথম ক'মিনিট বুঝতেই পারল না কী হয়েছে ওর সাথে! গলায় নিঃশ্বাসের গতি বিপজ্জনকভাবে আঁটকে আসছে! শাওলিন বুঝতে পারল, ওর থুতনির নীচে গলার উপর জান্তব এক হাত ওর গলাটা টিপে ধরেছে। নিঃশ্বাস, কণ্ঠ, ফুসফুসের ব্যাকুলতা সমস্ত আঁটকে যাচ্ছে ওই কঠোর তীব্র হাতের চাপে। দেহের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ওই হাতটা খামচে খাবলে বারবার সরাতে চাচ্ছে শাওলিন। কিন্তু অসম শক্তির জোরে কোনোভাবেই পারছে না। ডানহাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বাঁহাতের পাঁচটি আঙুল শাওলিনের গলাটা টিপে রেখেছে সেলিম। বিগত ক'টি মাসের একটানা প্রত্যাখ্যান, ট্যূরের সমস্ত খরচ নিজের ঝুলিতে নেয়া, প্রতিটি পদে পদে তাকে যথেষ্ট অগ্রাহ্য করা ... আর সহ্য হচ্ছিল না সেলিমের। এই যৎসামান্য অতি অল্প বয়সি মেয়েটাই তাকে অবমাননা করছে, এটা তার পুরুষ সত্তায় বরদাস্ত হচ্ছে না। সেলিম ক্ষিপ্ত ক্রোধিত চোখদুটি একপলকের জন্য বাঁয়ে ঘুরিয়ে দেখে। নিঃশ্বাসের যন্ত্রণায় কাতর সেই রক্তাভ মুখটির পানে তাকায়। পাঁচ আঙুলের চাপে ছটফট করা ক্ষুদ্র গলাটা অতিশয় নরম ও কোমল। আরেকটু টিপে ধরলেই বুঝি কণ্ঠার হাড্ডিটা মট করে ভাঙবে। অথচ এই সুদৃশ্য গলাটা দিয়েই উচ্চারিত হয় অপমান! এমন ভঙ্গুর নরম গলাটা দিয়েই আস্পর্ধার কথাগুলো বলে! কীভাবে বলে ঠাস ঠাস প্রত্যাখানগুলো? উজ্জ্বলবর্ণের চামড়াটা ভীষণ রক্তাভ হয়ে উঠছে। ঠোঁটদুটো ফাঁক করে নিঃশ্বাস নিতে আকণ্ঠ ব্যাকুল! সেলিম মুচকি একটা হাসি দিয়ে পুনরায় স্টিয়ারিং ঘুরাতে প্রবৃত্তি দেখাল। তখনো জানে না সামনে কী ভয়াবহ দৃশ্যপট মুখিয়ে আছে। এক্সিলেটরে পা চেপে ব্যগ্রভাবে গাড়ি ছুটাতে শুরু করলে হঠাৎই সামনে থেকে একটি গাড়ি আসতে দেখে। সেলিম বুঝতে পারে এক্ষুণি গাড়িটা সোজাসুজি না চালানে ঘোর অঘটন ঘটবে! তাড়াতাড়ি স্টিয়ারিংটা ঝড়ের গতিতে ঘুরাতে থাকলে চটজলদি বাঁহাতটা শাওলিনের গলা ছেড়ে দিল। দুই হাতে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও পারল না সেলিম! চারধার কাঁপিয়ে বিকট তুমুল শব্দ তুলে চোখে ঝাপসা ছেনে এলো। এক লহমার ভেতর কী হলো বুঝতে পারল না! শুধু টের পেল, শাওলিন বোধহয় স্থিতিতে নেই! ভয়ার্ত করুণ চিৎকারে আর্তনাদ করে উঠেছে!
.
ভুবন রাঙানো রৌদ্রদগ্ধ পাহাড়ি ভূমি। যেখানে আবাল্য সুন্দর প্রকৃতি রূপ চোখ জুড়িয়ে দেয়। কখনো মেঘ ফুঁড়ে উঁকি দেয় অগ্নিপিণ্ড সূর্য; কখনো মেঘের সাম্রাজ্যে হারিয়ে যায় স্বর্ণাভ সূর্যালোক। এই বনভূমি জানে তার আকাশে বাতাসে কেমন শান্তিছায়া জড়িয়ে আছে। মারুতি কালো জিপে করে কাঙ্ক্ষিত জায়গাটায় হাজির হয় নাযীফরা। মুখ উঁচু করে আকাশপটে তাকিয়ে দেখে গাছগাছালির ছায়াবেষ্টিত ছাদ। রৌদ্রের আলো পাতার ফাঁক গলে চুরি করে ঢুকছে। জায়গাটা বড্ড ছিমছাম ও শান্ত। বড় একটি লোহার গেট নিশ্ছিদ্র সুরক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গেটের ডানদিকে দেয়ালের উপর বড়সড় একটি নামফলক। সোহানা ভ্রুঁদুটো খানিক কুঁচকে ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে পড়তে লাগল। হঠাৎ পড়া অবস্থাতেই আচমকা চ্যাঁচানো সুরে ডাকল,
- এ্যাই নাযীফ! অ্যাই দ্রুত এইদিকে আসো। দেখে যাও এখানে কী লেখা। কী অদ্ভুত! কী আশ্চর্য!
সোহানার অমন কৌতুহলবিদ্ধ স্বরে সবাই ত্রস্ত পায়ে ছুটে গেল। সোহানার তর্জনী ইশারার দিকে তৎক্ষণাৎ তাকাল সবাই। উৎসুক দৃষ্টিতে চুপচাপ সেই লেখাটা পড়লে সবাই একসঙ্গে একতরফায় চিৎকার দিয়ে বলল,
- শোয়েব ফারশাদ!
প্রত্যেকে চূড়ান্ত আশ্চর্যের সাথে একে অন্যের দিকে তাকাতে থাকে। বিশ্বাস করতে পারে না সত্যিই কিনা সেই বন কর্মকর্তার ডেরায় এসেছে! সবাই সোহানার দিকে দৃষ্টি ছুঁড়লে সোহানাও হ্যাঁ সূচকে মাথাটা নাড়িয়ে দিল। সমস্ত অস্থিরতা গোপন করে বলল,
- হুঁ। যা দেখছ তা-ই সত্যি! এটা শোয়েব স্যারের বাসা। আমরা স্যারের বাসাতেই এসেছি। শ্রেষ্ঠারা হয়তো এখনো জানে না আমরা কার বাসায় পৌঁছুলাম! জানার ডায়েরিটা তাহলে স্যারের বাসায় আছে! কী আশ্চর্য না?
ব্যাপারটার প্রবল ধাক্কা পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি কেউ। কেউই ভাবতে পারেনি যে মানুষটার সঙ্গে শেষবার হাসপাতালে দেখা হয়েছিল, আজ তারই বাড়িতে অতিথি হয়ে ফিরল। তড়িৎগতিতে সোহানাকে এক ধাক্কা দিয়ে নামফলকটা দেখতে লাগল রোজা। না, ঠিকই দেখেছে। সেই সুদর্শন লোকটিরই বাসস্থান! বড় বড় অক্ষরে যার নাম অক্ষর লেখা রয়েছে, F.O. SHOYEB FARSHAD. রোজা অস্ফুট একটা ঢোক গিলে মুখটা উচুঁ করে দেখল। সাড়ে সাত ফিট উচুঁ দুর্ভেদ্য পাঁচিলটা লক্ষ করে বলল,
- উনি কী জানতেন সবাই ডায়েরি নিতে আসব? তার মানে.. তার মানে উনি কী নিজেই আমাদের জন্য সারপ্রাইজিং কাজটা করল? কী মনে হয় সবার? আমার তো এমন কিছুই মনে হচ্ছে! মনে হচ্ছে স্যারই....
হঠাৎ কণ্ঠে অদম্য উল্লাসটা ঝরে পরতেই থমকে গেল রোজা। তড়িৎগতিতে বুঝতে পারল এমন প্রতিক্রিয়া দেওয়া ঠিক হয়নি। ঠোঁটে দ্রুত একটি কপট গাম্ভীর্য ধারণ করে মুখটা পিছু ফিরিয়ে দেখল। তিনজোড়া ভ্রুঁ কোঁচকানো চোখ ওর দিকেই অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। রোজা তাড়াতাড়ি গলাটা খাকারি দিয়ে একটু পরিষ্কার করে বলল,
- আমি বলতে চাইছি যে, মেবি ডায়েরিটা উনিই খুঁজে দিয়েছেন। বেচারির এতো শখের ডায়েরিটা খোয়া গেছে . . মানে বুঝতেই তো পারছিস এটা কতটা ট্রাজেডিক! আর স্যারের পক্ষে তো তুচ্ছ কোনো ডায়েরি খোঁজা ব্যাপার না।
নাযীফ খিঁচিয়ে রাখা ভ্রুঁদুটো আরো কুঞ্চন করে একদম খেপাটে সুরে বলল,
- তুচ্ছ বলতে? এখানে ছ্যাবলামি করলে ডাইরেক্ট ঝর্ণার পানিতে চুবিয়ে আনব। বুঝতে পারছিস? আমাদের মান ইজ্জত ডুবাস না। এখানে কিন্তু ঢাকার মতো পাওয়ার খাটানো চলবে না। তোর পাপ্পাকে কল দিয়ে হেল্প চাইলে তোকেই সাদা মুরগির মতো চামড়া ছুলে আপ্যয়ন করবে। এরপর পেরি পেরি সস মাখিয়ে শেয়াল কুত্তাকে খেতে দিবে। বুঝছিস উর্দু কথা? হাট্!
কথাগুলো যদিও গম্ভীর মেজাজে উচ্চারণ করছিল নাযীফ। এতে রোজাও কিছুটা জবান বন্ধ শান্তরূপী ছিল। কিন্তু পাশ থেকে জিদান হাসি আঁটকাতে না পেরে নাযীফের কাঁধে হাত রেখে নীচুসুরে বলল,
- মামা, সেলিম এখানে থাকলে এগুলো বলতে পারতে? ও কিন্তু সেলিমের এক্সের খাতায় ঢুকে আছে। বিচার দিলে গর্তে পরবা।
নাযীফ ঝটকা মেরে জিদানের হাতটা কাঁধ থেকে সরিয়ে দিল। রোজাকে শুনিয়ে শুনিয়েই কণ্ঠ উদ্ধত করে বলল,
- ঘাস খেতে খেতে গরুও তো আকাশের দিকে তাকায় জিদান। কিছু মানুষ বোধহয় তাও তাকায় না। কোথায় কতটুকু ঠিক কথাবার্তা চলে সেটা ধরার জ্ঞানটা পর্যন্ত নেই। থার্ড ক্লাস।
নাযীফ যে কার কার চারিত্রিক দিকটা ইঙ্গিত করে কথাগুলো বলল তা বুঝতে পেরেছে জিদান। ওই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠের নীচে লুকিয়ে থাকা গুপ্ত আনন্দটা ঠিকই ধরতে পেরেছে। সঙ্গে বুঝতে পেরেছে নাযীফের তীক্ষ্ম শব্দগুলো। নাযীফের পিছু পিছু গেটটার কাছে এগোল সবাই। ঠক্ ঠক্ আঘাত করল সে।
.
দুচোখ জুড়ে অন্ধকার জড়িত কুয়াশা। ঝিমঝিম করে অদ্ভুত একটা পীড়া সমস্ত শরীরে ছুঁয়ে যাচ্ছে। গলায় ঢোক গিলতে, দম টানতে বেকাবু ব্যথাটা অনুভব করছে শাওলিন। কতক্ষণ পর চোখদুটো খুলেছে তা নিজেরও জানা নেই। সৃষ্টিকর্তার কাছে আশু বিপদের মোকাবেলা নিয়ে অবিরাম প্রার্থনা জানাচ্ছিল, তবে এ কোন্ ধরণের বিপদ? কেমন বিপদ? মাথার বাঁপাশ, বাহুর বাঁদিক টনটন করে ব্যথার জানান দিচ্ছে। আধো আধো দৃষ্টিতে তাকাতেই নিজেকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পেল। গাড়িটাও রাস্তার একপাশে বেকায়দায় থেমে আছে। তবু মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই! কিছু একটা খুবই অস্বাভাবিক! চোখ ঘুরাতেই সেলিমের অস্থির শঙ্কিত মুখটা দেখতে পেল শাওলিন। সাথে সাথে মুখটা পিছু ফিরিয়ে দেখল, অদূরে একটি গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। সেই সফেদ বৃহৎ গাড়িটি থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উঠছে। শাওলিন সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে ' ওহ আল্লাহ্ ' বলে অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠল! সঙ্গে সঙ্গে গায়ের সিটবেল্ট খুলে বাইরে বেরুতে নিবে, ঠিক তখনই খপ করে ওর ডানহাতটা ধরে ফেলল সেলিম। ক্ষিপ্ত অবরুদ্ধ স্বরে ঝাঁ ঝাঁ মেজাজে বলে উঠল,
- কোথায় যাচ্ছ তুমি? কোত্থাও যাবে না! এখানেই বসে থাকো। একদম সিট ছেড়ে...
কথাটা শেষ সবার পূর্বেই গাল বরাবর সর্বোচ্চ শক্তিতে চড় কষালো শাওলিন। ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপিয়ে অশ্রু টলটল চোখে অগ্নিকুণ্ড চেপে বলল,
- [খু]. ন করে ফেলব সেলিম! আল্লাহর কসম এইবার কিন্তু [খু]. ন করে ফেলব! আপনি একটা নিরীহ মানুষকে এক্সিডেন্টের মুখে ফেলেছেন। হাজারবার মানা করা সত্ত্বেও স্পিডটা কামাননি। গাড়িতে কেউ মারা গেলে আমি সত্যিই আপনাকে ছাড়ব না।
তীব্র ঝাঁঝালো সুরে কথাগুলো শুনিয়ে গাড়ি থেকে নামল শাওলিন। মাথার বাঁপাশ প্রচণ্ড ব্যথায় জর্জরিত। আপাতত সেটা ভুলে গিয়ে একছুটে সেই গাড়িটার সামনে পৌঁছুল। রাস্তা ঘেঁষে ধবল গাড়িটি থেমে আছে। সামনের বনেট অংশটা উঁচু হয়ে মিশকালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। শাওলিন মাথার বাঁপাশটা বাঁহাতে চেপে ধরে ব্যথাতুর চোখে ভেতরে চাইল। দেখল ব্যাকসিটে কেউ নেই। আরো দু পা এগিয়ে এবার ড্রাইভিং সিটের জানালা দিয়ে চাইল। দেখল ড্রাইভিং সিটেই কেবল একজন ব্যক্তি রয়েছে। আকস্মিক ধাক্কায় স্টিয়ারিংয়ের উপর মাথা ছেড়ে দিয়েছে লোকটা। শাওলিন ব্যথায় বাঁ চোখটা বন্ধ করে লোকটাকে ডাকা শুরু করল,
- শুনছেন? শুনছেন আপনি? আমার কথা কী শুনতে পাচ্ছেন? শুনলে সাড়া দিন প্লিজ। কথা বলুন।
দুর্বোধ্য খারাপ যন্ত্রণাটা দুপাটির দাঁতে পিষে ধরল শাওলিন। কিছুক্ষণ চোখমুখ খিঁচুনি দিয়ে পীড়াটাকে আত্মস্থ করে নিল। এরপর কিছুটা ধাতস্থ হলে গাড়ির দরজাটা কিঞ্চিৎ খুলে অবনত মাথার উপর হাত রাখল শাওলিন। আঙুলগুলোর নীচে অদ্ভুত রকম নরম চুলগুলো মৃদুস্পর্শ দিল। আস্তে করে দুহাত এগিয়ে মাথাটা তুলে ধরল শাওলিন। ধোঁয়ায় ঢাকা গাড়ির ভেতরটা খুব ঝাপসা। অস্পষ্ট নজরে দেখতে পেল লোকটার প্রকৃত অবয়ব। গৌরকান্তি মুখ, সুপুরুষ সুলভ দৃঢ় কাটালো চোয়াল, ধারালো এক সুপ্রোথিত ছাপ ঠোঁটদুটোয়, তবু অদ্ভুত ধরণের এক মায়া আকর্ষণ আছে সেই ঠোঁটযুগলে। চোখের বন্ধ পাতার নীচে নিভু নিভু করে ফুটছে বিরল মণির তারা দুটো। তবু অস্পষ্ট . . খুব অস্পষ্ট সেই চোখের চাহনিযুগল। চওড়া সুদৃশ্য পৌরুষ-দৃঢ় কপাল, যার বৃহৎ অংশজুড়ে নরম খেলো চুলগুলো বিরাজমান। বাঁ ভ্রুঁটা কেটে সেখান থেকে টলটল করে ঝরছে রক্ত। সেই রক্তপাত দৃশ্য দেখে শাওলিন আশপাশে রুমাল জাতীয় কিছু খুঁজল। কিন্তু পেল না কিছুই। ডানহাতে পরনের ওড়নাটা টান দিয়ে সেটাই একমুঠ করে ক্ষতস্থানে চেপে ধরল। ধীরস্বরে ডাকতে লাগল ও,
- শুনতে পাচ্ছেন? কথা বলুন। কষ্ট করে একবার জবাব দিন।
এবার কর্ণগোচরে ধীরে ধীরে কথাটুকু প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় সচল সক্রিয় হলো। ঠোঁটদ্বয় কিছুটা মুক্ত শ্বাসে নড়ে উঠলে জানান দিল কর্তব্য-কঠিন মানুষটি,
- বেঁচে গেছি হয়তো..
ওইটুকু উত্তর শুনে চোখ বুজে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল শাওলিন। যেন বুকের উপর থেকে ভারিক্কি চিন্তার খণ্ডটা সরে গেছে। ওড়নাটা তখনো সম্পূর্ণ অচেনা লোকটার ভ্রুঁতে চেপে শাওলিন বলে উঠল,
- আল্লাহ্ অশেষ কৃপায় বাঁচিয়েছেন।আর কোথাও গুরুতর আঘাত লেগেছে?
চোখের আবেগ-বর্জিত চাহনি কেমন অভেদ্য ঠেকছে শাওলিনের। শাওলিন তখনো জানে না ওই প্রত্যক্ষ-বৎ চোখদুটো কী বিষয়ে জরিপ করতে ব্যস্ত। শুধু মনে মনে খচখচ করে উঠল, এভাবে এই লোকটা কী দেখছে? কী পরোখ করছে? শাওলিন ব্যাপারটা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে যাবে, ঠিক তখনই হেঁচকা টানে দৈহিক ভারসাম্য হারাল ও। আকস্মিক এমন কাণ্ডে প্রচণ্ড ভড়কে গেলে থমকে গেল শাওলিন। কী হলো নিজের সাথে তখনো বুঝতে পারেনি ও। হঠাৎ বুঝতে পারল ও গাড়ির ভেতর, ড্রাইভিং সিটের উপর, অজ্ঞাত কিছুর তপ্তশ্বাস ডান কানের কাছে লাগছে। বুকের ভেতর দম আঁটকে ব্যাপারটা একটু একটু করে বুঝতে চেষ্টা করল শাওলিন। মাথাটা ধীরে ধীরে নীচু থেকে সোজা করতেই থমকে তাকাল ও। মুখের অত্যন্ত বিপদসীমার কাছে আরেকটি মুখ, চকচকে নীল চোখ ওর কৃষ্ণ চোখে বিদ্ধ, নাকে নাক স্পর্শ করে শাওলিনের ওষ্ঠযুগলে অবিরাম তপ্তশ্বাস পড়ছে। ঠিক সে সময়ই অত্যন্ত সংকীর্ণতায় বলে উঠল শোয়েব,
- উল্টোদিক থেকে গাড়ি আসছে।
কথাটা শেষ করতে দেরি, তার সঙ্গে সঙ্গে শাওলিন জানালা ঘেঁষে উক্ত গাড়িটিকে যেতে দেখল। কখন কোনসময় হাত বাড়িয়ে ড্রাইভিং সিটের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে, তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না শাওলিন। পুরো ব্যাপারটাই উদ্ভট কর্মের মতো তাজ্জব লাগছে। এমন সময় চোখ সরু করে প্রশ্নটা করল শোয়েব,
- তুমি কী শাওলিন? কেবিন ওয়ান জিরো সেভেনের পেশেন্ট?
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
১১ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমো সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন