উপন্যাস        :         বজ্রমেঘ
লেখিকা        :          ফাবিয়াহ্ মমো
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১৩ই এপ্রিল, ২০২৪ ইং

লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমোর “বজ্রমেঘ” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২৪ সালের ১৩ই এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন। 
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো

১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো (পর্ব - ২)


আগুন গরম গা। মাথা উঠানো যাচ্ছে না। কুসুম্ভরাগ নরম ঠোঁটদুটো ভীষণ লাল হয়ে উঠেছে। থরথর করে কেঁপে ওঠা চক্ষুপল্লবে ঝিলিক দিচ্ছে তপ্ত অশ্রু শিশির। ভারি কাঁথাটার নিচ থেকে আস্তে করে ডানহাতটা বের করতেই দুঠোঁটের আগল থেকে থার্মোমিটারটা বের করল। গলাজুড়ে খুশখুশে বিশ্রী কাশিটা জানান দিলেও ফোলা ফোলা চোখদুটো অনেক কষ্টে খুলল শাওলিন। চোখের সামনে ধরা চ্যাপ্টা থার্মোমিটারে দুর্বল দৃষ্টি ফেলেও স্পষ্ট কিছু দেখা গেল না। জ্বরে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আছে। কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করে ডিজিটাল সংখ্যায় দেখতে পেল ১০২.৪°। ধুপ করে ডানহাতটা বিছানার ওপর নামাতেই ভারি একখণ্ড দম ছাড়ল শাওলিন। শরীরের তাপমাত্রা নামছে না। মাথার উপর থাকা ফ্যানটার দিকে চেয়ে একসেকেণ্ডের জন্য ভাবল— আজই যদি ওর মৃত্যু ঘটে যায়? এই জ্বরে? যদি এই উছিলায় চলে যায় আজ? কেমন হবে কাউকে কিছু না জানিয়ে দুনিয়া থেকে চলে গেলে? জীবনের অমোঘ সুখটা দেখার বড় ইচ্ছে! না জানি সেই তুলতুলে নরম সুখটা কতই না সুন্দর . . . কতই না রঙিন! সে কী কল্পলোকের কল্পনা, নাকি ওর মতো হতভাগিণীর ভাগ্যে এক অসম্ভব স্বপ্ন? শাওলিন জ্বরতপ্ত শ্বাসগুলো ছেড়ে দিতেই বালিশের কাছ থেকে সেলফোনটা টেনে নিল। ঝাপসা ক্ষীণ দৃষ্টি দিয়ে ডায়াল প্যাডে আঙুল ছোঁয়াতেই ‘Moni’ নামে কল পাঠাল একটা। কবার টুট টুট রিংদুটো পৌঁছে যেতেই এক সম্ভ্রম নারীকণ্ঠ ভীষণ রাগারুণ তেজে গর্জে উঠল যেন,
- শাওলিন, তুমি কল ধরছ না কেন? কী সমস্যা হয়েছে? জ্বরটা আসলো কেন, বলা যাবে?
বাঁকানে চেপে ধরা ফোনটি চোখের সামনে আনলো শাওলিন। লাউডস্পিকারে তর্জনী বুলাতেই চোখদুটো বন্ধ করে বলল,
- সুস্থ আছি মণি। টেনশন করে অসুস্থ হবেন না প্লিজ। তাপমাত্রা সামান্য একটু বেড়েছে। আমি ঠিক হয়ে যাব। আপনি কি হার্টের ঔষুধটা খেয়েছেন?
গম্ভীর সেই নারীকণ্ঠ কেমন যেন নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ঝাঁজালো কঠিন সুরটা কেমন গলে যায় শুভ্র নরম মোমের মতো। তিনি জানেন পৃথিবীর বুকে নিঃস্বার্থ সরল সঙ্গী স্রেফ এই মেয়েটিই রয়ে গেছে। যার সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক, মানসিক সম্পর্ক, স্নেহের অটুট এক হৃদ-বন্ধন। শাওলিন পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরে স্তিমিত স্বরে শুধিয়ে উঠে,
- বললেন না যে, আপনি কী ঔষুধটা নিয়েছেন? জোহরা আন্টি পাশে থাকলে ফোনটা তার কাছে পাস করুন। আন্টির সঙ্গে কথা বলব।
সদাতেজি শাওলিনের ভাবগম্ভীরতা বুঝতে পেরে ফিক করে হেসে উঠেন রেবেকা নেওয়াজ। মার্জিতসুলভ ঝকঝকে হাসিটি ঠোঁটে জিইয়ে রেখে বলে উঠেন তিনি,
- শাওলিন, শোনো। তুমি বড্ড বেশি খামখেয়ালী আচরণ করছ। শ্রেষ্ঠার কাছ থেকে শুনলাম তুমি কালরাত থেকে ঘুমোওনি। ওভাবে জ্বর নিয়ে শুয়ে থাকলে আমার পক্ষে ট্যাবলেট গেলা সম্ভব? বাড়ি ফিরো তুমি। দরকার পড়লে তোমার জন্য গাড়ির পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি আসো।
শুষ্ক খরখরে গলায় ঢোক গিলল শাওলিন। দিঘির মতো কাজল-কালো চোখদুটো থেকে টুপ টুপ করে দুফোঁটা তপ্ত শিশির পড়ল। কোমল-কাতর মুখটি জ্বরে লালবর্ণ, মলিন। একটুও বুঝতে দিতে চাইছে না কতটা অসহনীয় খারাপ লাগছে ওর। মণি নামক অভিভাবক তুল্য নারীটি ছাড়া আর কাউকে শাওলিন বুঝতে শেখেনি। আজও মনে পড়ে নিজের একমাত্র ভাইটির হাত ধরে লাল টুকটুকে বউটি ওদের বাড়িতে এসেছিল। চেহারা ছিল দুধে বরণ ফরসা, হাত দুখানা অপরূপ সুন্দর, হাসিটি ছিল হৃদয় জুড়োনো মিষ্টি। নিজের বয়স থেকে বিশাল ব্যবধানে বড় ছিল আপন ভাইটি। ভাইকে কোনোদিন ভাইয়া বলেনি শাওলিন। বড় অদ্ভুত কারণে ছোট্ট শিশু শাওলিন দাদা বলে ডাকতো। দাদার কাঁধে উঠে ঘরময়, ছাদময়, ছোট্ট উঠোন জুড়ে ঘুরতো। দাদা আর নেই। তবে দাদার সেই হাতে ধরা লাল টুকটুকে বউটি আজও ওর কাছে রয়ে গেছে। সেই সুহাসিনী রমণী, সেই দুধে বরণ অপরূপা নারীটি আজ ওর ‘মণি’। একমাত্র দাদা ছোটবেলায় শিখিয়েছিল ভাবীকে সবসময় ভাবীমণি ডাকতে। ভাবী নয়। শাওলিন সেই অনন্য সম্বোধনটি ডেকেছিল বহুদিন; তবে কালের আবর্তনে আজ সে সম্বোধনটি কাটছাঁট হয়ে ‘মণি’ হিসেবে স্থির হয়ে গেছে। কবে কখন কোথায় হয়েছে তা আজ মনে পড়ে না। রেবেকা নেওয়াজের স্নেহ-ছায়ায় বড় হয়ে আজ এতদূর পথ, এতদূর অবধি জীবনস্রোতে চলা। আর বাবা-মা নামক মানুষ দুটি . . . ? পিছু ফেলা আসা দিনগুলো ভাবতে ভাবতে অন্যমনষ্ক ছিল শাওলিন। এতোক্ষণ ওর রেবেকা মণি কী কী সব কথাবার্তা বলেছে সেসব কিছু কানে পৌঁছুয়নি। মৃদু একটা কাশি দিয়ে নিজের দগ্ধশ্বাস ছাড়ল সে। হঠাৎ খেয়াল হলো ডানহাতটা ওর কাঁপুনি দিয়ে কাঁপছে। যান্ত্রিক ভাইব্রেশনটা অনুভব করতেই চকিতে চোখ খুলে মোবাইল স্ক্রিনে দৃষ্টি ফেলল শাওলিন। কী আশ্চর্য! একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে কেন? এই নাম্বার তো গুটিকয়েক ব্যক্তি ছাড়া কেউ জানে না! অদ্ভুত একটা কৌতুহল নিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল শাওলিন,
- মণি, আপনাকে দশ মিনিট পর কল দিই? একটা জরুরি কল এসেছে। মনে হচ্ছে কলটা এক্ষুণি রিসিভ করা দরকার।
কণ্ঠস্বরে অদম্য ঝোঁকটা টের পেয়ে রেবেকা বলে উঠলেন,
- শাওলিন, তাহলে তুমি কলটা ধরো। আমাকে আর দশ মিনিট পর কল দিতে হবে না। তোমাকে রাতে কল করব। রাখি। আল্লাহ হাফেজ।
- আল্লাহ হাফেজ।
চট করে কলটা কেটে দিতেই আননোন নাম্বারে ডায়াল বসালো শাওলিন। তড়িৎবেগে কলটা রিসিভ হতেই ব্যস্ত একটি পুরুষ কণ্ঠ অকপটে বলে উঠল,
- হ্যালো, শেহজানা আলম শাওলিন বলছেন?
স্বাভাবিক কপালটা ধীরে ধীরে কুঁচকে যেতেই প্রচণ্ড অবাক হয় শাওলিন। একটি অজ্ঞাত অচেনা ব্যক্তি সম্পূর্ণ নামটা জানে কী করে? কী ঘটছে এসব! শাওলিন মহাবিরক্তির আঁচটা গোপন করে শান্ত স্বরে বলে উঠল,
- জ্বী, শাওলিন বলছিলাম। কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না। পরিচয়টা জানা যাবে স্যার?
- সার্টেনলি মিস শাওলিন। কিন্তু মনে হচ্ছে এক্ষুণি আপনার রওনা দেওয়া দরকার। ফরেস্ট এরিয়ার নর্থলেন রোডে একজন মেয়ে পরে আছে। বেহুঁশ। আপনি কি মেয়েটার রিলেটিভ কেউ?
বুকটা কেমন ধড়াস করে উঠল শাওলিনের! বলছে কী! ওদিকটার রাস্তায় আজ শ্রেষ্ঠাদের যাবার কথা। সেলিমের ভ্লগের একাংশ শ্যূট আজ ওদিকে হবে। তাহলে কী ওদের কোনো ভয়ংকর বিপদ হয়েছে? নর্থলেন কী সেই জঙ্গুলে রাস্তাটা না? তুফানের ভেতর কে অমন করে রাস্তায় পড়ে আছে! অজানা বিপদের আশঙ্কায় শোয়া থেকে উঠে বসলো শাওলিন। সমস্ত শরীর জ্বরের দহনে বিষিয়ে এলেও কণ্ঠ স্থির করে শুধালো,
- শুনুন, মেয়েটার পড়ণে কী আছে বলবেন? আশেপাশে কোনো দলবল নেই? কোনো ক্যামেরা বা ইন্সট্রুমেন্ট দেখা যাচ্ছে না? দেখুন তো।
একঝাঁক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেই ওপাশটা ঘোর নীরবতায় আচ্ছন্ন হলো। একমাত্র বৃষ্টির সেই ঝমঝমানি আওয়াজ ব্যতিত আর কোনো শব্দ কানে আসছে না। কিছুক্ষণ পর আবারও সেই পুরুষ কণ্ঠটি সপ্রতিভ স্বরে জানান দিয়ে বলল,
- স্যরি মিস শাওলিন। আশপাশ শূন্য। মেয়েটার পড়ণে সী-গ্রীন ড্রেস। নেভি ব্লু জিন্স। হোটেল প্যারাডাইস লাউঞ্জের মানি রিসিট তার হাতে। সেখানে আপনার তথ্য ছাড়া কিছুই নেই। ক্যান ইয়্যু কাম?
চরম বাকরুদ্ধ হয়ে উত্তরদিকের জানালায় চাইল শাওলিন। থাইগ্লাসের ওপাশে ক্ষুদ্ধ প্রকৃতি প্রলয়ংকরী তাণ্ডব চালাতে ব্যস্ত। জানালা ঘেঁষা নিমগাছের শাখা-প্রশাখাগুলো থাইগ্লাসের কাঁচে বেদম চাবুক পিটিয়ে যাচ্ছে। আকাশ ফেটে তীব্র বিকট গর্জনে কেঁপে উঠছে দালানকোঠা। শাওলিন বুঝতে পারল বেহুঁশ মেয়েটি আর কেউ নয়, স্বয়ং রোজা। ও-ই আজ সী-গ্রীন ফতুয়ার সাথে জিন্স পরে বেরিয়েছে। নিশ্চয়ই ওদের সাথে কোনো জঘণ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে। নয়ত এরকম পরিস্থিতি . . . আর ভাবতে পারল না শাওলিন। অজ্ঞাত লোকটির কাছ থেকে রোজার নির্দিষ্ট তথ্যটুকু জেনে তখুনি গায়ে বাইরের পোশাক জড়াতে শুরু করল। শুভ্র রঙের ভূমি স্পর্শ করা একটি স্কার্ট, সম্পূর্ণ গা আবৃত শালীন একটি টপ, টপের ওপর আলাদা করে লালবর্ণের একটি কটি পরে রেডি হলো। চুলগুলো বাঁধার ফুরসত একদমই হাতে অবশিষ্ট নেই। তন্মধ্যে রুমের দরজায় নব্ মোচড়ানোর আওয়াজ পেতেই তৎক্ষণাৎ মাথাটা পিছু ঘুরায় ও। দুচোখ শান্ত করে ভদ্রভাবে শুধোল,
- রোজা কোথায়?
সামান্য একটি প্রশ্নে বির্বণ হলো পাঁচটি মুখ। পাঁচটি চোখের তারায় ভয়, লজ্জা, উৎকণ্ঠা, তীব্র অপরাধবোধ যেন একসঙ্গে খেলে যাচ্ছে। থরথর করে কাঁপছে সোহানা। হাতে হাত কচলে যাচ্ছে সে। শ্রেষ্ঠা মাথা নীচু করে সাদা টাইলসের ওপর পায়ের বৃদ্ধাঙুল দিয়ে নখ কুটছে। একপলক জিদান, সেলিম ও নাযীফের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে বলল শাওলিন,
- তোমাদের লজ্জা নেই। একটা মেয়েকে তোমরা তুফানের মধ্যে ফেলে দিয়ে চুপচাপ চলে এসেছ। আগে জানলে কখনোই তোমাদের সঙ্গে আসতাম না। তোমরা দায়িত্ব পালনে এতো গ [র্দ] ভ, এতো মিথ্যুক! সরো সামনে থেকে।
শেষের কথাটা ধমকের সুরে বলতেই সোহানা কেমন মিইয়ে গেল। থতমত খাওয়া কণ্ঠে আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলে নাযীফ চট করে বেচারিকে থামিয়ে দেয়। চোরা ইশারায় বোঝাল একদম কথা নয়। মুখ বন্ধ সোহা। শাওলিন ওদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেছে। মাথা ঘুরছে ওর। পা টলছে। তবু রাগের হলকায় ক্ষোভ যেন একটুও কমছে না। হোটেল থেকে বাইরের পথে ছুটে আসতেই দুদিকের পথঘাট শূন্য দেখল। দেখল, রাস্তায় একটা গাড়িও নেই। হোটেল পাহারা দেওয়া দারোয়ানটি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে এগিয়ে এসে বলল,
- গারি তোয়াইতো এস্সুদে? এন্ডে তো গারি তোয়াঁয় ন পেইবে।
মুখটা বাঁয়ে ঘুরিয়ে প্রৌঢ় বয়সি দারোয়ানকে দেখতে পেল শাওলিন। স্থানীয় ভাষাটা কিঞ্চিত বুঝতে পেরে অসহায় দৃষ্টিতে জানালো,
- একটা গাড়ি বা অন্যকিছু পাওয়া যাবে না কাকা? ব্যবস্থা করতে পারবেন?
কাকা সম্বোধন করা লোকটি নিজ ভাষাতে জানালো সম্ভব নয়। উত্তর শুনে মুষড়ে পড়ল শাওলিন। হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে ফোন বের করে কীভাবে কী করবে বুঝতে পারছে না। ঘড়িতে সন্ধ্যা ছয়টা বিশ। মুষলধারার বৃষ্টিতে দূর-দূরান্তের পথঘাট ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা ধারণ করেছে। বজ্রকম্পনে গমগম করে গর্জে উঠছে প্রকৃতি। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে হাতের ফোনটায় ঢোক গিলে তাকাল ও। বুকের মাংশলযন্ত্র ধড়ফড় করে ছুটছে। তৎক্ষণাৎ ফোনটা চালু করে ক্ষিপ্র হাতে অজ্ঞাত নাম্বারটায় কল বসালো সে। দুটো টুটটুট শব্দে রিসিভ হতেই আবারও সেই বজ্রগম্ভীর পুরুষকণ্ঠ,
- হ্যালো। বলুন মিস শাওলিন।
শাওলিন হড়বড় করে দ্রুত কথাটা বলে বসলো,
- একটা হেল্প করা সম্ভব? আপনি কী একটা ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? আমি হোটেল প্যারাডাইস লাউঞ্জে অবস্থান করছি। এদিকটায় কোনো যানবাহন নেই। আশপাশ সম্বন্ধে কিছু জানি না। আমি একজন ট্যুরিস্ট মানুষ।
কথাগুলো বলার পর আবারও সেই অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করল। শাওলিন জানে না তার মতো অপরিচিত একটি মেয়েকে আদৌ সেই দেবদূত লোকটি সাহায্য করবে কিনা! ভয় হচ্ছে ...। হঠাৎ ফোনের ওপাশ থেকে মার্জিত স্পষ্ট স্বরে জানান দিল লোকটা,
- হোটেল প্যারাডাইস লাউঞ্জে গাড়ি পৌঁছে যাবে। আপনি হসপিটালে চলে আসুন। রিসেপশনে এসে ওয়ান-জিরো-ফোর রুমের ডাইরেকশনটা বুঝে নিবেন।
আকাঙ্ক্ষী কথাটুকু শুনতে পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল শাওলিন। ঠোঁট গোল করে চাপা শ্বাসটুকু ছাড়তে ছাড়তে কল কাটল সে। মাথা ঝিমিয়ে আসছে। চট করে ডানদিকে থাকা দেয়ালে সমস্ত ভরটা ডানহাতে চেপে দাঁড়াল ও। দ্রুত গাড়িটা চলে আসুক . . . দ্রুত।
ঠিক দশ মিনিটের মাথায় নিঝুম অন্ধকার ফুঁড়ে ছুটে এলো গাড়িটি। থামল ঠিক প্যারাডাইস লাউঞ্জের দোরগোড়ায়। হোটেল-রুম থেকে চাতকপাখির মতো শাওলিনের যাওয়াটা দেখছে দলবল। জানালা দিয়ে জিদান ডাক দিতে গেলে পেছন থেকে ওর কাঁধটা ধরল সেলিম। সবাই জানে এই মুহূর্তে রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে পারে শাওলিন। ওর রাগ ভয়াবহ। বৃষ্টির অঝোরধারায় গাড়ির রঙ, নাম কিছুই বোঝা সম্ভব নয়। শাওলিন তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠে পরতেই ড্রাইভার গোছের লোকটি শোঁ করে বেদম স্পিডে গাড়িটি স্টার্ট দিয়ে ছোটাল। গাড়ির ব্যাকসিটে গা এলিয়ে জানালার বাইরে আধো অন্ধকার পথটা দেখতে দেখতে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যেতে লাগল শাওলিন। বুঝতেও পারেনি জীবনতরী কোন সুমোক্ষম দিকে চাল ছেড়েছে। মাথাটা পিছনদিকে হেলিয়ে দিতেই সুনিবিড় শান্তিতে বুজে এলো চোখ। গভীরভাবে দম নিতেই অজানা অচেনা মন নরম করা প্রখর সৌরভটুকু টের পেল সে। কেমন যেন মন ছুঁয়ে যাওয়া কোনো পরশ, কোনো তুলতুলে নরম ঘুম জাগানি আবেশ, বাতাসে মিশে থাকা শীতল আচ্ছণ্ণ শিরশিরানি অনুভূতি . . . হঠাৎ গায়ে বেজায় ঠাণ্ডা অনুভব করল শাওলিন। মনে হচ্ছে এই গাড়ির বাতাস কোনো অনুপস্থিত ব্যক্তিকে আঁকড়ে রেখেছে। গভীর নিঃশ্বাসে যাকে অনুভব করা যাচ্ছে এই প্রখর সুঘ্রাণটুকু মাঝে। এমন সময় কান ফাটানো দুটি হর্ণ বাজাতেই গাড়িটি প্রবেশ করল ফটফটে আলোর রাজ্যে। শাওলিন একদণ্ড দেরি না করে সোজা হাসপাতালের রিসেশপনে ছুট লাগিয়ে শুধোল,
- শুনুন, রুম নম্বর ওয়ান-জিরো-ফোর কোথায়? কোন দিকে?
রিসেপশনে থাকা মহিলাটি ত্রস্তস্বরে বলল,
- ম্যাম, আপনিই কি শেহজানা শাওলিন?
উত্তর দেবার দেরিটুকুও সহ্য হচ্ছে না ওর। তবু মনের উপর পাথর চেপে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠল,
- জ্বী, শেহজানা শাওলিন। আপনাদের এখানে একজন এডমিট হয়েছে, একটু আগে, একজন লোক বলল. . .
চট করে ওর কথাটা মাঝপথে থামিয়ে রিসেপশনিস্ট মহিলাটি বলল,
- বুঝেছি। স্যারের কেস। আমার সঙ্গে আসুন। এই যে, এদিক।
শাওলিন একটুও বুঝতে পারল না 'স্যারের কেস' শব্দটা দিয়ে কী বোঝাল। এটা কী বিশেষ, ব্যতিক্রম, বিচিত্র কিছু? মহিলাটির পিছু পিছু হাঁটা দিতেই দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল শাওলিন। একটি নির্দিষ্ট কেবিনের দিকে তর্জনী ইশারা করলে শাওলিন চুপচাপ ভেতরে গিয়ে ঘুমন্ত মেয়েটিকে দেখল। কপালের কোণে একখণ্ড ব্যাণ্ডেজের নীচে ক্ষত ঢাকা, সী-গ্রীণ ফতুয়ার ডানহাতাটার কনুইয়ের দিকটা ছিঁড়ে গেছে, পায়ের একটি আঙুল বেশ যত্ন করে ব্যাণ্ডেজ করা। নিশ্চিন্তের শ্বাসটুকু বুক-ভেদ করে ছেড়ে দিতেই রোজার কাছে বসলো শাওলিন। ইনজেকশনের ডোজে রোজা এখন ঘুমন্ত। টিমটিমে ফরসা আলোয় রোজার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের হাতদুটোর পানে চাইল শেহজানা আলম। উজ্জ্বল বর্ণ রঙ যেন কঠিন লালবর্ণ ধারণ করেছে। চিকন বাঁশপাতার মতো থরথর করে কাঁপছে গরম ঠোঁট। সমস্ত স্নায়ুশক্তি ফুঁ দেওয়া মোমের মতো নিভে আসতেই অতলস্পর্শী তন্দ্রায় হারিয়ে গেল শাওলিন। শেষ স্নায়ুর সুঁতোয় আবছা মতোন শুনতে পেল এক আগন্তকের ডাক। অস্পষ্ট, ভারি, বজ্রনিনাদী কণ্ঠস্বর. . .আর মনে নেই।

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

 Follow Now Our Google News

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

৩য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমো সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন