উপন্যাস : বজ্রমেঘ
লেখিকা : ফাবিয়াহ্ মমো
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১৩ই এপ্রিল, ২০২৪ ইং
লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমোর “বজ্রমেঘ” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২৪ সালের ১৩ই এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো |
২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো (পর্ব - ৩)
হাসপাতাল চত্বরে যেন কবরের মতো নিস্তব্ধতা! কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। স্তব্ধ চোখে বিপজ্জনক দৃশ্যটি দেখার পর ঢোক গিলছে ওয়ার্ড-বয় এবং নার্সগুলো। যেন এক্ষুণি কিছু বলে ফেললে মহাদুর্যোগটি ওদের ওপর দিয়ে বয়ে যাবে। মানুষটি নিজের রক্তাক্ত ডানহাত ঝাড়া দিতেই অসংখ্য বিন্দু বিন্দু রক্ত-শিশির পরিস্কার টাইলসের ওপর ছিঁটকে পড়ল। সেদিকে একপলক দৃষ্টি দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটের ওপর জিভ বুলিয়ে মানুষটির দিকে এগিয়ে যায় নার্স রেহানা। সম্ভ্রমসূচক সম্মান প্রদর্শন করে বলল,
- আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। একটু আগে কলের সেই মেয়েটি হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে স্যার। আপনার গাড়িটা পার্কিং এরিয়ায় রাখা। আসুন।
‘স্যার’ সম্বোধন করা সুচৌকশ মানুষটির দিকে তাকাতে পারছে না রেহানা হানিফ। সাহস হচ্ছে না। বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে। কণ্ঠনালী শুকিয়ে আসছে। অনুভব করতে পারছে এই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় সামনে দাঁড়ানো এই ঠাণ্ডা সম্ভ্রম মানুষটি স্বল্প সিক্ত হয়ে এসেছে। কালো জুতোজোড়া ভেজা। কালো প্যান্টটি আধভেজা। পড়ণের ওই শার্ট আর স্যূট . . আর কল্পনা করতে পারল না রেহানা হানিফ। ঝুপ করে উড়াল পঙ্খির মতো লুকিয়ে পড়ল ওর চোরা মনটা।
- নার্স হানিফ, সেই বাচ্চা পুতুলটার ব্যাপারে চাই। কেমন আছে? আমি কী একবার দেখা করতে পারব?
বিনম্র কণ্ঠের কাছে ভূয়সী চমকে ওঠে রেহানা হানিফ। মুখ তুলে মানুষটার ঘোর সম্মোহন চোখদুটিতে আকৃষ্ট হয়ে তাকায়। রিমলেস কাঁচ চশমাটি তার দুচোখে জড়িয়ে আছে। কাঁচের ওপারে দমবন্ধ করা দুটি সুনীল শান্ত চোখ . . চোখের সমুদ্র-নীল মণিদুটো, ঠোঁটে সুনিবিড় প্রখরস্পর্শী সম্ভ্রম ভাব। গায়ের শার্টটা . . শার্টটা ভারী দুকাঁধের কাছে ভিজে আছে। রেহানা বুকের সমস্ত হাঁসফাঁস অবস্থা গোপন করে শান্তমুখে জানাল,
- নিশ্চয়ই। কেন নয়? তবে এই মুহুর্তে আপনার বাচ্চা পুতুলটি ঘুমিয়ে পড়েছে শো. .শোয়েব স্যার।
নাম ধরে তাকে ডাকতে গিয়ে জিভটা কেমন আড়ষ্ট হয়ে আসে। নিঃশ্বাসে কঠিন কড়া টান লাগে। তবু নিজেকে সর্বোত্তম উপায়ে আঁটকে রেখে বাকি কথাটুকু সম্পূর্ণ করল রেহানা,
- বাচ্চাটা আপনার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়ল। ওর মা আপনার কাছে ভীষণ কৃতজ্ঞ। অনেক করে বলেছে, যদি সম্ভব হয় ওদের বাড়িতে দুমুঠো ডাল-ভাতের নিমন্ত্রণটা রক্ষা করবেন। ওরা গরীব মানুষ। তবে মনটা ভীষণ বড়। আপনি ওদের বাড়িতে গেলে খুব খুশি হবেন স্যার।
মেয়েলি মনের অশান্ত অস্থির অবস্থার ওপর প্রাণবন্ত হাসির মুকুট পরাল রেহানা। তিলবিন্দু পরিমাণ বুঝতে দিল না তাঁর মুখোমুখি দাঁড়াতে গিয়ে কতটুকু অসহন পর্যায়ে অস্থিরতা অনুভব করছে। মনের আগল থরথর করে কাঁপছে প্রচণ্ড। এই উদার মনষ্ক পুরুষটি কেন বৃষ্টির পবিত্র ছোঁয়া গায়ে মেখে এভাবে এল? সে কী এখনো বুঝতে পারছে না এই বৃষ্টি তাকে ছুঁয়ে দিলে কতটা বিপজ্জনক রকম আকর্ষণীয় দেখায়? কতটা উজ্জ্বল হয়ে যায় পুরুষ দেহের অপ্রতিরোধ্য সম্পূরণ? রেহানা দেখল তার কথাগুলোর প্রতি বিশেষ কর্ণপাত করেনি শোয়েব। বরং মেঝেতে পড়ে থাকা র [ক্তা] ক্ত বেহুঁশ লোকটার দিকে তর্জনী ইশারা করে তুলতে আজ্ঞা করল। একজন ওয়ার্ড বয় সঙ্গে সঙ্গে মনিব-ভক্ত প্রজার মতো দৌড়ে এসে ধরাধরি নিয়ে গেল। বেহুঁশ লোকটার মুখ থেকে অবিরাম রক্তের ঢল যেন বাঁধ মানছে না। ফ্লোরের ওপর চারটে রক্তমাখা দাঁত এখনো ভাঙা অবস্থায় পরে রয়েছে। কী বিভীষিকা সেই দাঁতের দৃশ্যটা! একটা জলজ্যান্ত মানুষ কতটা মারাত্মক পর্যায়ে আঘাত পেলে দাঁতের মাড়ি থেকে দাঁত শুদ্ধো উঠে আসে! রেহানার মনে হলো, স্যার কাজটা পুলিশকে দিয়েও করাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এমন এক জা [নো] য়া [র] কে হাসপাতাল এনে জব্দ করলেন, যে কিনা ভরদুপুরে ন র[পি] শা চে র মত ভয়াবহ কর্মটি করতে যাচ্ছিল। সাত বছর বয়সি ছোট্ট একটি মেয়ে, যার বয়স এখনো শৈশব ছোঁয়া অবুঝ পৃথিবীতে ছুঁয়ে আছে, সেই ছোট্ট মেয়েটির ওপর জা [ন্ত] ব নি [ষ্ঠু] র চাহিদা মেটাতে ঝাঁ [পি] য়ে পড়েছিল লোকটা। বাচ্চাটার মা ছিল বাইরে। পড়ণের ছোট্ট জামাটা ওই জঘণ্য দাঁতগুলো দ্বারাই ছিঁড়েছিল, কাঁধে বসিয়েছিল ওই চারখানা ন [র] পি শা [চে] র দাঁত। কিন্তু বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি লোকটা। মেয়েটির মা আচানক কী এক দরকারে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলে সেই ভয়াবহ দৃশ্যটি দেখে ফেলে। হইচই চিৎকার করে তৎক্ষণাৎ রা [ম] দা তুলে দৌড় ছুটালে সরব পরিস্থিতি টের পেয়ে গা ঢাকে। তবে . . তবে স্যার এই [জা] নো [য়া] র টা কে আকাশ-পাতাল ফুঁড়ে কীভাবে খুঁজে আনেন? তাও ঝড়-বাদলার দিনে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে? কই আগের অফিসারটা তো এরকম যোগ্য তৎপর ছিল না! কোনো কান্নারত মায়ের অভিযোগ তো শুনতো না! ঘুষ, গালি, মেয়েমানুষ ছাড়া কিচ্ছু তোয়াক্কা করেনি আগের দু [ষ্ট] অফিসারটা! তবে এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে এই মানুষটির ডানহাত মুষ্টিবদ্ধ করার দৃশ্য। চোয়াল শক্ত করা শাণিত-দৃঢ় ক্ষোভ। কাঁচ চশমাটি চোখ থেকে খুলে বাঁহাত বাড়িয়ে ওয়ার্ড বয় নিজামের কাছে সেটি রাখতে দেওয়া। এরপর . . এরপর সেই রূহ কাঁপানো বেগতিক এক আঘাত! মুখ থেকে ভকভক করে [র] ক্ত বেরোনোর সাথে চারটা দাঁত রক্তের সাথে বেরিয়ে আসে! সঙ্গে সঙ্গে [জা] নো [য়া] র টা সংজ্ঞাহীন। এই প্রথম বুঝি হাসপাতালে এনে হাসপাতালের বাসিন্দা বানানোর কায়দাটা ঘটলো। এমন সময় ঠাণ্ডা নীরবতাকে খান খান করল একটি সুতীব্র চিৎকার! সদ্য ইন্টার্ন করতে আসা নার্স ফাইরুজ প্রচণ্ড উত্তেজিত স্বরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিৎকার করে ডাকছে,
- রেহানা আপু! রেহানা আপু, আপনি কোথায় আছেন? ইটস ইমার্জেন্সী কেস! তাড়াতাড়ি উপরে আসুন। এক্ষুণি প্লিজ!
ফাইরুজের উচ্চকণ্ঠে সবাই কেমন পিলে চমকে সিঁড়ির পানে তাকাল। তাকায়নি শুধু একজন। সে রক্তাক্ত ডানহাতে সাদা রুমাল মুড়িয়ে নিচ্ছে। প্রত্যেকে মাথা পিছু করে দেখল নার্স ফাইরুজ অপ্রতিভ মুখে অস্থিরভাবে এদিকেই দৌড়ে আসছে। বিপদের আশঙ্কা টের পেতেই রেহানা হানিফ একছুট দিয়ে ফাইরুজের কাছে পৌঁছে শুধাল,
- হয়েছে কী? কেন ওভাবে চেঁচাচ্ছ? সমস্যাটা কোথায় হয়েছে?
ফাইরুজ হাঁপ ধরা গলায় অসংখ্য ঢোক গিলতে গিলতে মুখ হাঁ করে দম টানতে লাগল। নিঃশ্বাসে পিণ্ডিটা যেন চটকে আসছে। ডানহাতের দুটি আঙুল উঁচু করে বোঝাতে চেষ্টা করল ফ্লোর নম্বর দুই। অমনেই ব্যাপারটা স্বচ্ছ জলের মতো বুঝতে পেরে দৌঁড় লাগাল সিনিয়র নার্স রেহানা ও সঙ্গে দুজন সহকর্মী। ধপধপ করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতেই প্রশস্ত করিডোর দিয়ে ডানপথে ছুট লাগাল। পেছন থেকে আসতে থাকা ফাইরুজ গলা উঁচিয়ে বলল ওয়ান জিরো সিক্স কেবিনে ঢুকতে। রেহানা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই লম্বা বেডে জ্ঞানশূন্য মেয়েটাকে দেখতে পেল। সমস্ত গা রক্তাভ, চোখদুটি বন্ধ, কাশ্মীরি আপেলের মতো ঠোঁটদুটি তপ্ত লাল। রেহানা ডানহাত এগিয়ে কপাল ছুঁয়ে চমকে ওঠে। চকিতে সহকর্মী মেয়েটির দিকে উদ্বিগ্ন সুরে চেঁচাল,
- থার্মোমিটারটা এক্ষুণি আনো! ফাস্ট!
সেকেণ্ডের ভেতর থার্মোমিটার এসে হাজির। পারদ-কাঠিতে একশো চার ছুঁই তাপমাত্রা স্থির হলো। থমথমে দৃষ্টিতে বুঝতে পারল এই জ্বর অস্বাভাবিক তাপমাত্রা ছুঁতে চাইছে। কিয়ৎক্ষণ নীচের ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে ভাবতে থাকলে সহকর্মীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল রেহানা,
- মেয়েটার সঙ্গে আর কেউ আসেনি? এতো রাতে একা একা . . কীভাবে আসলো এই মেয়ে? বুঝলাম শোয়েব স্যার ভদ্রতার খাতিরে গাড়ি পাঠিয়েছিল। কিন্তু এটাও কী অদ্ভুত বিষয় না? একা একা এই রাতে কেউ আসে? সাহস দেখে মারাত্মক অবাক হচ্ছি।
সহকর্মী মেয়েটা অপ্রস্তুত মুখে বলল,
- বুঝতে পারছি না রেহানা আপু। আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা এই অঞ্চলে একা আসেনি। সঙ্গী-সাথী অবশ্যই এসেছে। হয়তো ওর সঙ্গীরা জানে না এই ঝুমবৃষ্টির সন্ধ্যা-রাতে এই মেয়েটা এখানে এসেছে। আরেক বোন বা বান্ধবিকে উদ্ধার করতে ছুটে এসেছে।
থার্মোমিটারটা খাপে ভরে রেহানা অ্যাপ্রণের পকেট থেকে ফোন বের করল। ডাক্তার রেজাকে এখুনি একটা কল দেওয়া দরকার। বাঁহাতে ফোনটা কানে চেপে ডানহাতে মেয়েটির নিষ্প্রাণ কবজি তুলে হার্টবিট গুণতে থাকল রেহানা। অমন সময় কেবিনের দরজা ঠেলে কেউ একজন জানাল,
- রেহানা আপা, স্যার যে মেয়েটাকে নর্থলেন এরিয়া থেকে উদ্ধার করেছেন, ওই মেয়েটার হুঁশ ফিরেছে। আগের চেয়ে সুস্থ। আপনি কী একবার চেক দিয়ে যাবেন, নাকি স্যারের কাছে ফটাফট আপডেটটা পৌঁছে দিব?
রেহানা কাউন্ট শেষ করতেই প্রেশারটা লো বুঝল। অন্যদিকে ব্যস্ত স্বরে প্রত্যুত্তর করে বলল,
- এ্যাই! শোয়েব স্যারকে এখুনি কিছু বলতে হবে না। চুপচাপ বসো! আমি আগে মেয়েটার সাথে দেখা করব। জিজ্ঞেস করব ওই রোডে কী করতে গিয়েছে। তুমি ডাক্তার রেজাকে এই কেবিনের কাছে আসতে বলো। পেশেন্ট শেহজানা শাওলিন হাই ফিভারে ভুগছেন। পালস্ রেট ফিফটি-ফিফটি ফাইভ। জলদি জানাও ডাক্তারকে।
সম্মতি জানিয়ে চলে যেতেই আবারো কেবিনজুড়ে ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা নামল। বাইরে উত্থাল হাওয়ার তোড় কিছুটা কমে এসেছে। বৃষ্টির মুহুর্মুহু ঝাপটায় থাইগ্লাসের বুকে এঁকেবেঁকে নামছে পানির স্রোত। বাল্বের ঝকঝকে আলোয় পরিশ্রান্ত কেবিনের ঠাণ্ডা নিস্তব্ধতায় নিভন্ত ছোট্ট মুখটা দেখতে লাগল রেহানা। জ্বরের আঁচে গালজুড়ে যেন রক্তজবার লালিত্য . . অদ্ভুত সম্মোহন করা এক লালচে মেদুর আভা! চোখের পাতা বন্ধ রইলেও ছোটবেলার স্বপ্ন-প্রোথিত দিনগুলোর কথা মনে পড়ল রেহানার। মনে পড়ল সেই স্বপ্নচারিণী রাজকুমারী স্লিপিং বিউটির রূপকথা! আজ যেন সাক্ষাৎ ওর সামনে রূপকথার সেই ঘুমন্ত সুন্দরী-ই অসাড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। জ্বরে, অসুখে, দৈহিক অবসাদে। মুখজুড়ে তার মোহবদ্ধ সৌন্দর্যের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কী সুন্দর . . কী স্নিগ্ধ . . কী ঘোর লাগানো রূপ-কুহকী মুখ। হঠাৎ কেবিনের দরজাটা ক্যাচ্ করে উঠলে অপ্রস্তুতভাবে ঘাবড়ে গেল রেহানা। তড়িঘড়ি করে পিছু ফিরতেই বরফের মতো জমে গেল সে। অন্তরাত্মা ধ্বক করে উঠেছে! কেবিনের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছে শোয়েব স্যার। অজানা ভয়ে মন-পাখিটা লাফিয়ে উঠতেই দ্রুত ঘুমন্ত সুন্দরীকে আড়াল করে দাঁড়াল রেহানা। ওর সহজাত হিংসুক মন শাওলিন মেয়েটাকে সহ্য করতে পারছে না। একটুও চাইছে না শোয়েব স্যার এই ঘুমন্ত সুন্দর মেয়েটিকে একনজর দেখুক! তার সমুদ্রনীল চোখদুটো এই অচেনা, অজানা, রূপস্নিগ্ধার ওপর পড়ুক। মনে মনে বিদ্রোহী হিংসার স্ফুরণ ঘটলেও নিজেকে শান্ত রাখল রেহানা। ঠেলেঠুলে হেসে বলল,
- স্যার . . আপনি . . মানে এখানে কেন? আপনি কাউকে বলে দিলেই তো আমি নীচে চলে আসতাম। খামোখা কষ্ট করলেন। আপনার বাচ্চা পুতুল মেয়েটা এদিকে নেই। ওকে রাখা হয়েছে কেবিন ওয়ান ...
হঠাৎ কথার ফুলঝুড়িতে দৃঢ়প্রোথিত বাঁধ সাধল শোয়েব। চোখদুটো রেহানার কপট নিগূঢ় দৃষ্টিতে স্থাপন করে বলল,
- দাঁড়ান। আপনি সোজা কথার জবাব বাঁকা জায়গায় দিচ্ছেন নার্স হানিফ। এখানে ওয়ান জিরো সেভেনের পেশেন্ট মিস শেহজানা আলম শাওলিনের আপডেট জানতে এসেছি। এই মুহুর্তে উনার হেলথ কণ্ডিশন কেমন? শুনলাম, ফিভারটা নাকি খারাপ পর্যায়ে গেছে?
রেহানা একপ্রস্থ ধারালো প্রশ্নের কাছে জবুথবু হল।কল্পনার ক্যানভাসে শাওলিন মেয়েটার প্রতিচ্ছবি কাটছে না। তবু জিভের আগায় আমতা আমতা সুর জড়িয়ে ফট করে জানাল,
- না না। অতটা খারাপ নয়।. . মানে . . এখনো নরমাল স্টেটেই আছে। অ্যান্টিবায়োটিক মেডিসিন ঠিকঠাক মতো দিলেই কাল সকালের ভেতর সুস্থ হয়ে যাবে। আমি ডাক্তার রেজাকে একবার আসতে বলেছি। এইতো ডাক্তার এলো বোধহয়। ডাক্তার ভালোমতো দেখে দিলেই নরমাল কণ্ডিশন বলা সম্ভব।
অচেনা একটি মেয়ের শারীরিক দুর্বলতা একছাঁট মিথ্যে ঝাড়ল রেহানা হানিফ। কেন ঝাড়ল তা সে নিজেও পুরোপুরি জানে না। বরং ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় তীব্রভাবে জানান দিচ্ছে এই মেয়েকে এই মুহুর্তের জন্য দৃষ্টিসীমানার আড়ালে রাখতে পারলে বাঁচে। পৈশাচিক শান্তি পায়। মেয়েটাকে তার সহ্য হচ্ছে না। নিজের ভবিতব্য দিনগুলোর জন্য, তার আসন্ন সুন্দর স্মৃতিটুকুর জন্য, তার সামনে দাঁড়ানো এই উদার মনষ্ক পুরুষটির মনে প্রণয়-বীজ বপনের জন্য কোনো রিস্কই নিতে চাচ্ছে না। এমনিই মেয়েটা বড্ড বেশি . .বড্ড বেশিই . . সুন্দর।
রেহানার ওরকম বাঁকা আচরণটা আজও অস্বচ্ছ লাগল শোয়েবের। সে ঠিক বুঝতে পারছে না এই তরুণীর মধ্যে ইনসিকিওর হাবভাব কেন ফুটে থাকে। বিশেষ করে নতুন কোনো রোগী— ‘মেয়ে’ রোগী এলে তাদের নিয়ে একটা আড়ালপণা বিষয় দেখা যায়। কেমন যেন নিজেকে হাইলাইট করতে ব্যস্ত। হঠাৎ চোখদুটো ডানদিকের সুবিশাল থাইগ্লাসে আঁটকে গেল। জানালাটা স্বল্প একটু ফাঁক হয়ে আছে। ফাঁক গলে ঝরঝর করে বৃষ্টির পানি ফ্লোর ভিজিয়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটা দেখে পা চালিয়ে থাইগ্লাসটা বন্ধ করে দেয় শোয়েব। রাতের নিঝুম প্রকৃতি অভিমানী কিশোরীর মতো আকাশ চিঁড়ে কান্না ঝরাচ্ছে। কেন উদাস হয়ে আছে তার প্রিয় আকাশটা? কোন আক্ষেপের দুঃখে দুঃখ পেয়ে রোদন করছে আকাশ-চক্ষু? তার চোখজোড়া বাইরের রুদ্রতেজি প্রকৃতি থেকে সরাতে উদ্যত হবে, ঠিক তখুনি দৃষ্টি থমকে গেল শোয়েবের। সহসা সোজা স্থিরবৎ দাঁড়িয়ে নিজেকে থাইগ্লাসের আয়নায় চুপচাপ দেখতে লাগল। নিজেকে ঠিক কতদিন পর মনোযোগ দিয়ে দেখছে তা জানা নেই। তবে আশ্চর্য হলো, বাংলাদেশের এই বনে-বাঁদাড়ে ঘুরে, সর্বক্ষণ কঠোর ডিউটি পালন করে, নিজেকে অমানুষিক যন্ত্রণার ভেতর রেখেও তার শরীর ভাঙেনি একদণ্ড। কমেনি দেহের ভারি প্রাবল্য চৌকশ ভাব। বরং মনে হচ্ছে আগের চাইতেও শাণিয়ে এসেছে তার দেহের স্ফীত সুদৃঢ় পেশি। দৃঢ়তাপূর্ণ পাকিয়ে এসেছে দুকাঁধ, দুবাহু, তাঁর পুরুষ নিভৃত নির্জন বুক। হঠাৎ বুক চিঁড়ে ভারি শ্বাসটা ঠোঁট নির্গত করতেই নীল সম্মোহন চোখদুটো কঠিন চুম্বকের মতো থমকাল! থাইগ্লাসের বাঁদিকে অন্য আরেকটি মনুষ্য অবয়ব কখন যে বড় সন্তপর্ণে ফুটে ওঠেছে, তা এতোক্ষণ যাবৎ লক্ষ করেনি শোয়েব। তার পেছনে সেই আগের জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল রেহানা। রেহানার দিকে আজও তার দৃষ্টি নেই। রেহানার ঠিক পাশে লম্বা বেডে শায়িত আছে জ্বরতপ্ত মেয়েটি। মুখটা তার ওপাশ ফেরানো। দেখা যাচ্ছে না। একঝাঁক কালো অরণ্য-কেশের কাছে ঢেকে রয়েছে চেহারার বাঁপাশ। শীর্ণ একটি হাত বেডের বাইরে সামান্য একটু ঝুলছে। হাতের তালুটা লালবর্ণ রক্তিম, যেন রক্তে ডোবা কোমল ক্ষুদ্র মুঠো। আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে অকথিত কী এক নিস্পৃহ ভাব জুড়ে আছে . . জানা নেই। রেহানা হয়তো কাছে না থাকলে হাতটা একবার ধরে হার্টবিট চেক করতো। হয়তো একঝলক দেখতো সেই দুঃসাহসী মেয়েটির মুখ— যার অন্তরে মনুষ্যত্বের শিখা দপদপ করে জ্বলছে। যার হৃদয়-সিন্ধুতে পরোপকার সত্তা দুর্দম্য ভাসমান। একবার কী বেডের কাছে যাবে? গিয়ে কী দেখবে একবার?
.
বৃষ্টি ধোঁয়া প্রকৃতি সকালের স্বর্ণ ছোঁয়ায় চকচক করে আলো ছড়াচ্ছে। বাতাসে প্রাণ উজাড় করা সুশীতল আরাম অনুভূতি। দূরবর্তী গাছের ডাল থেকে কিচিরমিচির করছে ভোরের ছোট্ট ছোট্ট পাখিরা। পাখিদের মিঠে অকাতর কূজনে নিদ্রাভঙ্গ চোখদুটো আস্তে আস্তে মেলে তাকাল শাওলিন। প্রথম ক্ষণে বুঝতে পারেনি কোথায় আছে সে। পরক্ষণে স্মৃতির কপাট খুলতে থাকলে সমস্ত ঘটনা একে একে মনে পড়ে। শূন্য কেবিনের একটি মাত্র অদূরবর্তী জানালায় চোখ ফেলে বুঝল বাইরে এখন ফটফটে সকাল। বাঁদিক থেকে চোখ সরাতেই কেবিনের দরজা ঠেলে প্রবেশ করল শ্রেষ্ঠা। হাতভর্তি খাবার। চোখ নীচু করে থাকায় খেয়াল করেনি শাওলিন উঠেছে। দরজা চাপিয়ে সামনে তাকাতেই খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে 'জানা!! উঠে গেছিস!' বলে একনিঃশ্বাসে ছুটে চলে এল। খাবারগুলো দ্রুত বেডসাইড টেবিলে নামিয়ে রাখলে ফটাফট টুলটা টেনে বসতে বসতে বলল,
- ফাইনালি ইয়্যু ওয়েক আপ জানা! শেষপর্যন্ত জেগে গেছিস রে উফ! আল্লাহর কাছে অশেষ ধন্যবাদ আর কোনো বিপদ আসলো না। কী যে আতঙ্কে ছিলাম!
শ্রেষ্ঠার চিন্তা জড়ানো মুখটা দেখে মৃদু হাসে শাওলিন। দুর্বল হাতটা শ্রেষ্ঠার কোলে রেখে দিয়ে বলে,
- সহজভাবে মরব না। মরলে হয়তো ভয়ংকর দুঃখ দিয়ে মরব। আমার এমনটাই ইচ্ছে।
অমন ভয়াবহ গোছের কথা শুনে থমকে যায় শ্রেষ্ঠা। বুকটা হঠাৎ ভয়ে মোচড়ে ওঠে। খপ করে শাওলিনের হাতটা দুহাতে খামচে ধরে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,
- তুই কী আমার কাছে [মা] র খেতে চাচ্ছিস? মুখে ওসব কথা আনতে বারণ করেছি না? মাত্র চোখদুটো খুলল আর অমনেই মহারাণীর খারাপ জঘণ্য কথা শুরু! চুপ করে ওঠে বস তো। নাস্তা এনেছি। একটু পর ডাক্তার এসে চেক করে যাবেন।
শ্রেষ্ঠার কপট রাগারুণ মুখের দিকে চেয়ে ফিক করে হাসলো শাওলিন। সকালের রৌদ্রকরোজ্জ্বল পরশ ওর স্নিগ্ধ মুখে অবলীলায় ছুঁয়ে যায়। হয়তো শ্রেষ্ঠার জায়গায় আজ অন্য কেউ হলে এতোটা স্বাচ্ছন্দ্য ব্যবহার, প্রাণবন্ত রূপ দেখাতে পারতো না শাওলিন। দুর্বল হাতটা শ্রেষ্ঠার মুঠোয় রেখে শোয়া থেকে উঠে বসল ও। ঠিক তখুনি মুখ কালো করে কেবিনে ঢুকল সেলিমের অনুতপ্ত অবয়ব। পিছু পিছু এলো নাযীফ, জিদান ও সোহানার দৃষ্টিনত চেহারা। সবার মুখে সুদৃঢ় অনুতাপের আঁচ, চোখে-মুখে ভুল কৃতকর্মের প্রচ্ছন্ন ভারি লজ্জা। শাওলিন প্রত্যেকের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে মনে মনে একটু হাসলো। বাইরে থেকে সেটা বুঝতে না দিয়ে তেজগম্ভীর সুরে বলল,
- বসো। ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকো না। রোজা জেগেছে?
শাওলিনের সহজ স্বাভাবিক প্রশ্নটা শুনে মন কিছুটা ভার মুক্ত হলো ওদের। হয়তো ওরা ভেবেছিল কাল ওরকম কাপুরুষ ঘটিত কর্মকাণ্ডের জন্য প্রচুর চটবে শাওলিন। অনেক নীতি বাক্য আওড়াবে। কপচাবে। সমস্যা করবে। কিন্তু অবশেষে তা হচ্ছে না। সেলিম স্টিলের একটা টুল টেনে বসতেই ভরাট গম্ভীর স্বরে বলল,
- রোজার ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস কিছু বলার আছে জানা। আমার মনে হচ্ছে দুদিকের কথাবার্তা তোমার শোনা প্রয়োজন। তুমি যে শুধু শুধু গতকাল আমাদের ওপর চটলে, রোজাকে আনিনি বলে আগুন ঝাড়লে, এটা একদিক দিয়ে ভালো হয়নি। আমরা রোজাকে ইচ্ছা করে ফেলে আসতে চাইনি। দ্যাট সিচুয়েশন ওয়াজ আউট অফ হ্যাণ্ড। ঠিক বর্ণনা করার মতো না।
সেলিমের কথা শুনে ভরসা পেয়ে গেল জিদান। হাতের সেলফোনটা পকেটে পুড়ে শাওলিনের পায়ের কাছে একচিলতে জায়গাটুকুতে বসে পড়ে বলল,
- শোনো জানা। ফার্স্ট অফ অল বলি, আমরা তোমাকে হোটেলে ফেলে যেতে একদম রাজি ছিলাম না। ইয়্যু ওয়াজ সিক . . দ্যাট ওয়াজ মোর হার্টফুল টাইম ফর আজ। কিন্তু তুমি এটা জানো আমরা এখানে ভিডিয়ো শ্যূট করার জন্য রুটিন মেইনট্যান করে এসেছি। চট্টগ্রামের মতো বিশাল জায়গাটা এক্সপ্লোর করাটা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। তার ওপর এদিককার ভাষা, এদিককার কালচার সব আমাদের থেকে উল্টো। ভাষাটাই ঠিকঠাক করে বুঝতে পারছি না। বেসিক্যালি এমন একটা জায়গায় এসে যখন দেখি দা, কাস্তে, ছুরি নিয়ে একদল ডাকাত পথ আঁটকে দিয়েছে, তখন নিশ্চয়ই জান বাঁচিয়ে পালানো এককথায় ফরজ। আমরাও তাই করেছি। আর রোজাকে এই ট্রিপে আনাটা একদম আমাদের প্ল্যানে ছিল না। তুমি তো জানোই ও সোহানার সঙ্গে চালাকিটা না করলে আমরা কখনো ওকে ট্রিপভুক্ত করতাম না। আর তুমি যে তখন . . .
জিদানের কথাটা মাঝপথে থামিয়ে নিজের ক্ষোভিত বাক্যযোগ করল শ্রেষ্ঠা। রাগে ক্রুদ্ধ বিক্ষুদ্ধ হয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল,
- আর তুই তখন ঠিকানা না দিয়ে চলে আসলি কেন? একটাবারও বলেছিস তুই রোজাকে পেয়ে গেছিস? জানিয়েছিস ও যে সেফসাইড সুস্থভাবে আছে? আমরা পাগলের মতো সারা এলাকা চষে শেষপর্যন্ত পুলিশের কাছে ধন্না দিয়েছি। ওখানে গিয়ে শুনি নর্থলেন রোড থেকে সেন্সলেস একটা মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। সেই মেয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি! পুরো দিনটা পাগলের মতো পাগলামি করে কেটেছে। আর রাতটা ছাগলের মতো ম্যাঁ ম্যাঁ করে রাস্তায় রাস্তায় তোদের দুটোকে খুঁজেছি!
শাওলিন যে এদের কথার ফাঁকে নিজের মূল মন্তব্যটুকু বলবে সে সুযোগ আর পাচ্ছে না। শ্রেষ্ঠার কথাটা শেষ হতেই ঝপ করে বাক্যের বারি বসালো নাযীফ,
- সারারাত ধরে তোর ভাবীকে আমি কীভাবে যে হ্যাণ্ডেল করেছি সেটা আমি জানি। একটু পরপর তোর মণি আমাদের কল দিয়ে কলিজা হাতে ধরিয়েছে। এর মধ্যে রোজার আহ্লাদী মা কোন্ এলাকার কোন্ [লেং] টা বাবা, [চেং] টা বাবা কোন্ ঝাঁড়ফুঁক, কী তাবিজ দিতে পারে, এই নিয়ে কানদুটো ঝালাফালা করে শেষ। আস্ত অ [স] হ্য একটা মহিলা! কী নিয়ে আমরা ট্রিপে আসলাম!
নাযীফ ফড়ফড় করে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলতেই সবাই কেমন স্থির চোখ হয়ে তাকিয়ে আছে। ঘটনা কিছু বুঝতে পারল না নাযীফ। কথার মধ্যে ভয়ংকর কিছু বলেছে? ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমতা আমতা সুরে শুধোল,
- হোয়াট হ্যাপেণ্ড? আমার কথায় কিছু ভুল আছে?
নাযীফের বোকা বোকা ভঙ্গি দেখে তুমুল হাসিতে ফেটে পড়ল ওরা। নির্বিকার শুধু শাওলিন। ঠোঁটে হাসি নেই, ছোঁয়া নেই, আনন্দ-ঝিলিক শূন্য। সকালের প্রথম ভাগে এমন এক প্রাণোচ্ছল দৃশ্য দেখে কোনো বিকার ঘটল না শাওলিনের ছোট্ট মনে। অট্ট হাসাহাসির মাঝে ওর নিষ্প্রভ চোখদুটো সেই জানালার কাছে চলে গেছে। আকাশজুড়ে যেখানে নীল রঙের ছড়াছড়ি, মেঘেদের হাতছানি, রৌদ্রের স্বর্ণাভ উঁকিঝুঁকিতে প্রকৃতি সুপ্রসন্ন। শাওলিন জানে না ওই জানালার কাছে গতরাতের এক টুকরো সম্মোহন দৃশ্য আবদ্ধ হয়ে আছে। আছে থাইগ্লাসের আয়নায় দুটি মানব-মানবীর স্পষ্ট-অস্পষ্ট অবয়ব। কেউ কাউকে চেনে না। দেখেনি। দেখেছে শুধু ওই জানালার বুক। দেখা কী কখনো হবে?
.
সকালের প্রথমার্ধে শাওলিন ও রোজার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হলো। গতকালকের চেয়ে রোজার অবস্থা প্রায় সুস্থই বলা চলে। ওদিকে শাওলিনের অবস্থা আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক। দুর্ভাগ্যবশত— যে দেবদূত মানুষটি ওদের সাহায্য সহযোগিতা করেছে, তার সঙ্গে ওদের সাক্ষাৎ আর হলো না। মানুষটা এখানে নেই। আসেওনি। কখন আসবে তা কেউ বলতে পারল না। এদিকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ নিয়ে সমস্ত ফর্মালিটিস সম্পন্ন করে সেলিমের ভাড়া করা নয় সিটের মাইক্রোতে চড়ে বসলো সবাই। হাইস মাইক্রোটি দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতাল গেটের ঠিক কাছে। একে একে সিটে বসার দৃশ্য হাসপাতালের বারান্দা থেকে দেখছিল রেহানা। পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফাইরুজ কামাল। বারবার নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখে চাপা অস্থিরতায় ভুগছে রেহানা। বুঝতে পারছে যেকোনো সময় স্যারের গাড়িটা আসতে পারে। হয়তো . . হয়তো এখনই। কিন্তু . . কিন্তু এই মাইক্রোটা চটজলদি যাচ্ছে না কেন? দাঁড়িয়ে আছে কেন? কী জন্যে হচ্ছে এসব? হাইস মাইক্রোর জানালা সংলগ্ন সিটটায় উঠে বসল শেষ যাত্রীটি। তার পড়ণে ধবধবে সাদা ভূমি ছুঁই স্কার্ট। সেই স্কার্টের শেষপ্রান্তটা মাটি ছুঁয়ে এগোতেই কোনো এক গাড়ির খাঁজকাটা টায়ারের দাগ থেকে সামান্য একটু কাদা জড়িয়ে যায়। অজান্তে, অলক্ষে, নীরবে। কেউ জানলও না। বুঝলও না। মাইক্রোর ভারি দরজাটা সশব্দে বন্ধ হতেই স্কার্টের নীচটায় কাদার আস্তরণ দেখতে পায় শাওলিন। পায়ে অসহ্য চিটচিটে লাগছে। এদিকে কানেও শুনতে পাচ্ছে কোনো একটি গাড়ি বোধহয় গেটের কাছে হর্ণ বাজিয়ে আগত। কাদাটুকু ঝাড়ার জন্য মাথাটা কিঞ্চিত ঝুঁকালে তখনি মাইক্রোটা স্টার্ট হয়ে গেল। ঝুঁকে থাকার ফলে শাওলিন খেয়ালই করল না ওদের পাশ দিয়ে সশব্দ গর্জনে খাঁজকাটা টায়ারের সেই গাড়িটাই হাসপাতালে ঢুকে যাচ্ছে। জানতেও পারল না ওদের মুখোমুখি থাকা গাড়িটাই ছিল বনবিভাগের কর্মকর্তা শোয়েব ফারশাদের গাড়ি। গতরাতের সেই দেবদূত মানুষ . . সেই ছোট্ট মেয়ের ন্যায়-বিচারক . . সেই নার্স রেহানার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন-সম্রাট। দুটো গাড়ি দুটো মানচিত্রের মতো দুই ভিন্ন পথে চলে যায়। ছুটে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দেখা কী হবে আবার? কবে, কখন, কোথায়?
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
৪র্থ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমো সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন