উপন্যাস : বজ্রমেঘ
লেখিকা : ফাবিয়াহ্ মমো
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১৩ই এপ্রিল, ২০২৪ ইং
লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমোর “বজ্রমেঘ” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২৪ সালের ১৩ই এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো |
৪র্থ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো (পর্ব - ৫)
(ক)
চারিদিকে কুসুম ফোঁটা বসন্ত। আকাশের রঙ গাঢ় নীল। রৌদ্রের দাপুটে তীব্র ঝলকানিতে চোখ ঝলসে ওঠে। মনে সহসা ছুঁয়ে শিরশিরে ঠাণ্ডা কাঁপুনে শিহরণ। আজকের দিনটা অন্যরকম, ব্যতিক্রম, বিচিত্র রকম এক আবহাওয়া ছড়িয়ে দিয়েছে। এই অন্যরকম আবহাওয়ার নাম পরিচয় জানা নেই শাওলিনের অন্তঃকোণে। একটু অদ্ভুত ভয়, একটু অস্থির মাখা সময়, কিছুটা অচিন অব্যক্ত অনুভব দূর অজানার দেশে ঠেলে দিচ্ছে ওর বাঁধো বাঁধো মন। হাতের মুঠোয় সেলফোন। ফোনের ওপর ফুটে আছে একজন কর্মপরায়ণ চৌকশ ব্যক্তির ব্যক্তিগত নাম্বার। শাওলিন খোদ জানে না, কেন এই মুহূর্তে উক্ত ব্যক্তির নাম্বারটি ফোনবুকে খুঁজে নিয়েছে ও। তবে মন বলছে আজ বসন্তবরণ প্রকৃতিটা ওর মনের মতোই কী যেন ব্যাকুলি চিত্তে খুঁজতে ব্যস্ত। শান্ত সুগভীর চোখদুটো ফোনের স্ক্রিনে রাখলে সময়ের গণ্ডি দেখল দুপুর দুটো। আজ সমগ্র ভার্সিটি চত্বর বসন্তের রূপ-বর্ণিল উৎসব-চপল আমেজে মেতে উঠেছে। প্রতিটি কোণায় কোণায় রঙ লেগেছে ফুরফুরে প্রাণ চাঞ্চল্য করা হাওয়া, শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্ত-বরণ কলহাস্যে মুখর এই আনন্দমেলা। ডিপার্টমেন্ট থেকে অবাধ্য কঠিন চাপাচাপিতে বসন্তবরণে নিজেকে আজ ভিন্ন পোশাকে মুড়িয়ে এনেছে শাওলিন। বাসন্তি রঙা শাড়ি, লাল রক্তাভ পাড়, পাড়ের রঙের সঙ্গে মিল রেখে লাল বর্ণ ব্লাউজ। সম্পূর্ণ ভিন্ন এই বেশভূষাতে চোখ রাঙানো, মন জুড়োনো নিঃশব্দ এক রূপ-ঐশ্বর্যে অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে শাওলিন। মুখে নেই কোনো কৃত্রিম সাজের বালাই। নেই ঝকমারি অলংকারের ঝনঝনে বাহুল্যতা। তবু উপস্থিত অন্যান্যদের কৌতুহলী দৃষ্টি বারবার ফিরে চাইছে ওর হাসিশূন্য মুখটুকুর দিকে। মাথার ডানদিকে সিঁথি কেটে ওভাবেই কৃষ্ণবর্ণ সুন্দর চুলগুলো ছেড়ে রাখা। কাঁধের বাঁদিক থেকে ছেড়ে রাখা প্রশস্ত আঁচল বাঁহাতে সুন্দরভাবে সামলে রেখেছে। লাল বর্ণ ব্লাউজে ওর কবজি পর্যন্ত ঢাকা, শীর্ণ নরম হাতদুটি চুড়িহীন। স্কুলজীবনের পর আর কখনো ওই হাতদুটিতে রেশমি চুড়ির রিনঝিন মিষ্টি সুরটা বাজেনি। শাওলিন আরেকবার ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখার জন্য তাকাবে, ঠিক তখনই পেছন থেকে কে যেন উচ্চকণ্ঠে ডেকে উঠল,
- জানা! পেছনে দেখো!
শাওলিন নিজের ছোট্ট নামটা শুনে চট করে পেছন ঘুরে চাইল। বেশ খানিকটা দূরে ছিমছাম ছায়া-ঘন কাঠগোলাপ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেলিম। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? ওকে তো বলেছিল লাইব্রেরি এরিয়ার এপাশটায় অপেক্ষা করতে। কী আশ্চর্য! সেলিমের পড়ণে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, গ্যাবার্ডিনের অফ হোয়াইট প্যান্ট, হাতে দামি ব্র্যাণ্ডের কালো রিস্টওয়াচ রৌদ্রের তির্যক স্পর্শে চকচক করে জ্বলছে। শাওলিন শাড়ি সামলে পায়ে পায়ে জনশূন্য লাইব্রেরি এরিয়াটা ছাড়িয়ে আরো কিছু দূর, সেই নির্জন কাঠগোলাপ গাছতলার কাছে অগ্রসর হলো। বলা বাহুল্য, ক্যাম্পাসের এদিকটা নির্জন, জনশূন্য এবং পেছনদিক হিসেবে কর্মচারিরাও এদিকে পা মাড়ায় না। শাওলিন দুই হাত দূরত্ব রেখে সেলিমের মুখোমুখি দাঁড়ালে স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীরভাবে বলল,
- কেন ডেকেছেন?
কণ্ঠের ভেতর এমন এক সুক্ষ্ম ক্ষোভ লুকায়িত যা সেলিমকে স্বাভাবিক করল না। বরং তার চোখে-মুখে কেমন বিক্ষুদ্ধ ভঙ্গির জেদ লুকোনো। চোয়ালটাও কেমন কঠিন। সেলিম স্থির চোখদুটো শাওলিনের মুখে ফেলে এক কদম এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
- তোমার তো জানার কথা কেন ডেকেছি। তুমি কী জানো না?
শাওলিন বুঝতে পারছে না সেলিম কেন আজকের মতো সুন্দর দিনটায় এমন আচরণ করছে। ভ্রুঁদুটো তৎক্ষণাৎ কুঁচকে এলে বেশ সংযত স্বরে বলল,
- আমি জানি না বলেই তো জিজ্ঞেস করছি কেন ডেকেছেন এখানে? এখানে কী প্রয়োজন আমার? কী দরকার? আমার সঙ্গে আপনার হিসাবটা কী?
কথাগুলো শুনে রাগ ছলকে ওঠল সেলিমের। এই ধরণের আচরণ একটুও বরদাস্ত করতে পারে না সে। সে যে ওর সিনিয়র হয় সেটাও কী এই মেয়ে ভুলে গেছে? ভুলে গেছে আদনান আবীর সেলিম কতটুকু খারাপ কাজ করতে জানে? হয়তো এই চরম উদ্ধত, অহংকারী মেয়েটা ভুলেই গেছে সেলিমের নেটওয়ার্ক কতটুকু গভীর। কতটা বিপজ্জনক। পাঞ্জাবির স্লিভদুটো কবজি থেকে ভাঁজ করতে করতে কনুইয়ে মোটা করে রাখতেই মুখটা কিঞ্চিত নীচু করল সেলিম। শাওলিনের মুখের কাছে নিজের মুখ রেখে খেপাটে গলায় কণ্ঠ নীচু করে বলল,
- আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু ইগনোর না। আমাকে তুমি ইগনোর করার স্পর্ধা দেখাচ্ছ। তুমি ভালো করেই জানো আমি তোমার সাথে ইনভল্ভ হবার জন্য ওয়ান হাণ্ড্রেড পার্শেন্ট ট্রায় করছি। বাট ইয়্যু আর গিভিং মি ইয়্যুর [ফা] কিং ইগনোরেন্স! [ফা] কিং ইগো!
সেলিমের মুখের ভাষা, চোখের দৃষ্টি চরম হতবাক করে দিল শাওলিনকে। কল্পনাও করেনি সেলিমের আচরণ এতোটা উদ্ধত, এতোটা শ্লীলহীন ভাষায় হতে পারে! হাতের ফোনটা মুঠোর ভেতরে শক্ত করে চেপে রইল শাওলিন। ঠাস করে এক চড় বসানোর চিন্তা ওর মাথায় আজ এল-ই না। সেলিম আরো এক কদম অগ্রসর হয়ে আগ্রাসী চোখদুটো ওর চোখে স্থির করে বলল,
- তোমার ভেতর হয় কোনো ঝামেলা আছে, নয় তুমি মানুষের সঙ্গে মিশতে জানো না। তোমার মতো অসামাজিক আচরণ করতে কাউকেই দেখিনি। সোহানার মতো মেয়েকে দেখো, রোজার মতো মেয়েকেও দেখো। ওরা কী সুন্দর চিয়ারফুলি সবার সঙ্গে মেশে, ওয়েল বিহেভ করে। আর তুমি? আয়নায় নিজেকে একবার নিজেকে দেখো। কোনোদিন ভদ্রভাবে প্রাণ খুলে হেসেছ কিনা ডাউট আছে। আমার তো সন্দেহ হয় আদৌ তোমার বাবা-মা . . .
হঠাৎ কথাটা বলতে যেয়ে মাঝপথে থেমে যায় সেলিম। ইচ্ছাকৃত এই প্রসঙ্গটা তুলতে গিয়ে আরো একবার শাওলিনের মুখটা লক্ষ করল সে। কিন্তু বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে চুপচাপ সেই জায়গাটা হতে প্রস্থান করল। শাওলিন নির্জীব শূন্য দৃষ্টিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে পাশে থাকা ঘাসের ওপর আস্তে করে বসে। বুকভরা দমটুকু গভীরভাবে টানে। এক পশলা দমকা হাওয়ায় গাছের ডালে ডালে ধাক্কা লেগে কাঠগোলাপের বৃষ্টি হয়। সাদা সাদা ফুলে ভরে যায় সবুজ ঘাসের বুক, দু একটা ফুল এসে পড়ে ওর ছোট্ট কোলের ওপর। হাত বাড়িয়ে কোলের সেই শুভ্র সুন্দর কাঠগোলাপের গায়ে আঙুল ছুঁয়ে ভাবে, সে কী কখনো আয়নায় নিজেকে হাসতে দেখবে? পৃথিবীর মানুষ যখন নিষ্ঠুর প্রসঙ্গটা তুলে তুলে দগ্ধ করে, ব্যথিত করে, রক্তাক্ত করে ছাড়ে সেই নির্মম অতীত কবে ঢাকা পড়বে? কবে পৃথিবীর মানুষ বুঝবে ও বতর্মানকে সুন্দর করতে চায়? কবে বুঝবে এই চলমান জীবনের আগামি দিনগুলোকে নিয়ে ও উদগ্রীব? ও চায় না অন্য কারোর পাপের ঝুলি ওর কাঁধদুটোকে আসুক। ও চায় না অবুঝ দিনের হিসাবগুলি ওর খাতায় পড়ুক। তবু মানুষ ঠেলে ঠেলে খারাপেই দিকেই ওকে ফেলে দিচ্ছে। বারবার ওর স্পৃহাজড়িত শক্তিকে গলা টিপে হত্যা করছে তারা-ই। শাওলিন সহসা অনুভব করল ওর হাতের মুঠোটা ব্যগ্রভাবে কাঁপছে। চট করে মুঠোটা আলগা করতেই ফোনের স্ক্রিনে দেখল মণি দিয়েছে। কলটা নিয়ে দোনোমনায় ভুগলেও শেষপর্যন্ত সেটা রিসিভ করে কানে চাপল শাওলিন। মৃদু হিম কণ্ঠে বলল,
- আসসালামুয়ালাইকুম মণি। কী করছেন?
কলের ওপাশ থেকে কী বুঝল বোঝা গেল না, তবে রেবেকা নেওয়াজ বেশ সুক্ষ্ম গলায় প্রশ্নটা রাখলেন,
- বসন্তের দিনে মন খারাপ?
প্রশ্নটা শুনে ঠোঁটের কোণে হাসি ছুঁয়ে গেল। কেউ দেখল না। জানল না। বাতাসের ঝাপটায় থোকা থোকা কাঠগোলাপ ঝরতে থাকলে সেই ঠাণ্ডা পরিবেশে দুচোখ বুজল শাওলিন। পরম শান্তিতে, গভীর আশ্লেষে। সেভাবেই প্রসন্নচিত্তে উত্তরটুকু রাখল,
- আপনি দূর থেকে কীভাবে এসব বোঝেন? আমি সালাম আর কুশল-প্রশ্ন ছাড়া কিছুই তো আপনাকে বললাম না।
বসন্তের সদ্য ফোঁটা ফুলের মতোই খিলখিল করে হেসে ওঠেন রেবেকা।
- তুমি আমার কাছে আমার সন্তানের মতো শাওলিন। তোমার দাদা আমাকে বিয়ে করার সময় একটা কথাই বলেছিল, আজও সে কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে স্যার বলেছিল, তোমাকে যেন মেয়ের মতো পালন করি। কখনো বুঝতে যেন না দিই তুমি তোমার বাবা-মা থেকে বঞ্চিত আছ। কখনো কোনোকিছুতে কষ্ট পাচ্ছ।
- একটা প্রশ্ন করব?
- দেরি কীসের? বলো।
- দাদা কী জানতো বাবা-মার খুব শীঘ্রই বিচ্ছেদ হচ্ছে?
কঠিনতম প্রশ্নটা শুনে রেবেকাও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। কয়েক মুহূর্ত কিছুই তিনি শাওলিনের কাছে বলতে সাহস পান না। তবু বুকের ভেতর সাহস সঞ্চার করে ভারি শ্বাস ফেলে বলেন,
- জানতো সোনা, জানতো।
উত্তরটা শুনে মাথা আরো নীচু হয়ে আসে শাওলিনের। পরবর্তী প্রশ্নটা করতে আজও জিভ আড়ষ্ট হচ্ছে। কয়েক লহমা অতিক্রান্তের পর নিষ্প্রভ সুরে বলল,
- খারাপ . . খারাপ লাগেনি? সেসময় দাদা কীভাবে সেটা সহ্য করেছিল?
শোয়া থেকে ওঠে বিছানার হেডবোর্ডে পিঠ এলিয়ে বসলেন রেবেকা। অতীত দিনের টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো একত্র করে বলে ওঠলেন,
- নীরবে। খুব নীরবে সহ্য করেছিল। আমাকে কখনো বুঝতে দেয়নি অমন কঠিন একটা সিদ্ধান্তে তোমার দাদা কতটা কষ্ট পেয়েছে। শুধু অনুভব করেছি সে মানসিকভাবে খুবই আঘাত প্রাপ্ত। কোনো প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের জন্য বাবা-মার বিচ্ছেদ সহনীয় নয় সোনা। খুবই দুর্বিসহ একেকটা দিন কাটে।
মনের আল্পনায় বড় ভাইয়ের মুখটা কল্পনায় আঁকল শাওলিন। বেশ সুদর্শন এক যুবকের মুখে সুগভীর গহিন যন্ত্রণায় ছাপ। উদাস ভারাক্রান্ত ব্যথিত দুটি চোখ। হয়ত সেই চোখ দিয়ে ছোটবোনের আসন্ন ভবিষ্যৎ, তার প্রতিটি দিনগুলোকে নিয়ে চিন্তা করতো। কিন্তু চিন্তা করার দিনগুলো স্রষ্টা এতো সীমিত দিয়েছিলেন যে, সেই ছোটবোনটিই তার ভাইয়ের মায়া-মমতা দেখতে পেল না। হারিয়ে গেল ভাই। ছাড়া ছাড়া, ভাঙা ভাঙা, কূলকিনারাহীন অবস্থার ভেতর রেখে গেল একা। আজ সেলিম যদি বাবা-মার প্রসঙ্গ তুলে ওকে বিচার না করতো, হয়তো ক্যাম্পাসের এই নির্জন গাছতলায় বসে নিজেকে নিয়ে ভাবতে বসতো না শাওলিন। চিন্তা করতো না, দুই অভিভাবক যখন বিচ্ছেদ নিশ্চিত করে, তখন কতটুকু ভয়ংকর প্রভাব পড়ে সন্তানদের ওপর। কতটা বাজেভাবে ওদের দেখতে থাকে এই সোসাইটির মানুষ। আজ আড়াই বছর হতে চলল বাবার সঙ্গে একবাড়িতে থাকে না শাওলিন। বাবা ও মা দুই ভিন্ন পথ পছন্দ করে আলাদা হয়ে গেলে শাওলিন তখন ছোট বাচ্চা। তখন বুঝতে দেওয়া হয়নি বাবা ও মা কেন আলাদা আলাদা থাকে। বুঝতে দেওয়া হয়নি কেন তারা আগের মতো এক টেবিলে বসে নাস্তা খায় না, চা-পান করে না। যখন বোঝার বয়সটা চলে আসে, তখনই বড় ভাই পরপারে পাড়ি জমান। ছোটবোনের দায়িত্বটা নিশ্চিন্তে রেখে যান বিশ্বাসযোগ্য সহধর্মিণী রেবেকার নেওয়াজের কাছে। কিন্তু সেই দায়িত্ব কত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রেবেকার কাঁধে ওজন বাড়াচ্ছে তা বাইরের কেউ জানে না। সরকারি একটি কলেজের অধ্যাপক থাকায় পেনশনের টাকায় ননদ-ভাবীর ছোট্ট সংসারটা কোনোমতে চলছে। স্বামীর রেখে যাওয়া যৎসামান্য রিযিকটুকু তুলে রেখেছেন শাওলিনের কথা চিন্তা করেই। কিন্তু তিনি জানেন না সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, একটি সুযোগ্য পাত্রের সন্ধান তিনি কীভাবে কবে পাবেন। কবে নিশ্চিন্ত হতে পারবেন, তিনি না থাকলেও শাওলিন ভরসাযোগ্য কারোর কাছেই আছে। এমন সময় ফোনের এপাশ থেকে বিষণ্ণ সুরে বলে ওঠল শাওলিন,
- মণি, আমি হয়তো ভার্সিটিতেও ব্যর্থ। এখানকার মানুষজন অন্যচোখে দেখছে। অন্যভাবে ভাবছে। প্রতিনিয়ত মনে হচ্ছে ওরা আমাকে জাজ করে যাচ্ছে। আমি কখনো চাইনি আমার বাবা-মার ডিভোর্সের সত্যটা ওরা কেউ জানুক। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আজ প্রতিটা মুহূর্ত ওরা আমার ভুলগুলোর জন্য তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে খোঁটা দিচ্ছে। ভেবেছিলাম আজকের দিনটা খুব সুন্দরভাবে কাটাব। কিন্তু . .হলো না।
হতাশার ভারী সূঁচালো দমটা ঠোঁট গোল করে নির্গত করল শাওলিন। দুচোখ মেলে চারিদিকের নির্জনতায় দৃষ্টি বুলিয়ে আস্তে করে বসা ওঠল। ফোনের ওপাশ থেকে ওর কথার মর্ম বুঝতে পেরে রেবেকা নেওয়াজ আজ আর মন খারাপ করলেন না। বিছানা-লাগোয়া খোলা জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে তিনি প্রাণবন্ত হাসি হেসে বললেন,
- শাওলিন, একটা সত্যি কী জানো? আল্লাহ তখনই পৃথিবীর মানুষকে আমাদের থেকে দূর করে দেন, যখন এর পেছনে অর্থবহ কোনো কারণ থাকে। হয় তুমি মেয়েটা অন্য সবার মতো নও, নয় তোমার জন্য শুধু একজনই নির্দিষ্ট আছে। সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তি যেদিন তোমার জন্য আসবে, ধরে নিতে পারো তুমি সবচাইতে সুন্দর উপহারটাই পাবে। এরকম আশপাশের মানুষদের কাছে কিছু প্রত্যাশা কোরো না মেয়ে। আমি জানি তুমি তোমার দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছ সবার সঙ্গে মিশে থাকতে। কিন্তু কোনো কারণবশত সম্ভব না হলে এতে আমি তোমার দোষ দিব না। সবাই একরকম, একগণ্ডি, একসীমানার মানুষ হয় না। বুঝতে পেরেছ? ভার্সিটি গিয়েছ, আজ একা একা আনন্দ করো। সবাইকে নিয়ে সবসময় আনন্দ করতে হবে এরকম কোনো নিয়ম নেই। মাঝে মাঝে নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। আচ্ছা, রাখি। তুমি কথা শুরু করিয়ে দিলে কথা থামাতে ইচ্ছে করে না। বাসায় সাবধানে এসো কেমন? কোনো মন খারাপ করা যাবে না। আল্লাহ হাফেজ।
- আল্লাহ হাফেজ।
ছোট্ট সুরে শব্দদুটো জানিয়ে কলটা কেটে দিল শাওলিন। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে লাইব্রেরি এরিয়া ছাড়িয়ে ক্যাম্পাস চত্বরে প্রবেশ করেছে খেয়াল নেই। মঞ্চে এখন দেখা যাচ্ছে শ্রেষ্ঠা, সোহানা, রোজাদের সঙ্গে অন্যান্য মেয়েদের যৌথ দলীয় নাচের ধুম। সেদিকে মনোযোগ আকৃষ্ট করে হুল্লোড় করছে সমস্ত শিক্ষার্থীর দল। শাওলিন চুপ করে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে একটা উঁচু পাটাতন থেকে রিকশায় উঠে বেরিয়ে পড়ল। হুড তুলে দেওয়া রিকশার ভেতর হঠাৎ অনুভব করল ওর ফোনটা বিকট শব্দ করে চিৎকার করছে। কল কাটার সময় যে সাইলেন্ট মোডটা অফ করেছিল খেয়ালই নেই। দ্রুত ফোনটা বের করতেই মোবাইল স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি থমকে যায় ওর! কী দেখছে এসব! এই নাম্বার থেকে সত্যিই কল এসেছে? নাকি চোখের ভ্রম? শুকনো গলায় ঢোক গিলে কলটা কানে চাপলো ও। আস্তে করে বলল,
- হ্যালো,
বিপরীত প্রান্ত থেকে বজ্রনিনাদী কণ্ঠে সম্ভ্রম ভাব রেখে বলল,
- শাওলিন?
কণ্ঠ শুনে গলার কাছটায় ঢোক আঁটকালো ওর। কোনো ভ্রম নয়, ভুল নয়, নিছক মিথ্যাও নয় এটা! সত্যিই কলটা দিয়েছে। শাওলিন পুরোদস্তুর নির্জীব মূর্তির মতো শক্ত থেকে বলল,
- জ্বী। শাওলিন বলছি। আপনি . .
মুখের কথা শেষ হবার পূর্বেই ওপাশ থেকে স্পষ্ট জোরালো কণ্ঠে বলল,
- শোয়েব ফারশাদ বলছিলাম। ফরেস্ট অফিসার অফ চিটাগাং হিল-ফরেস্ট। আপনি কী রিকশাটা ঘুরাবেন? আপনার ভার্সিটির বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। দারোয়ান বলল আপনি রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন।
ওই মুহূর্তে শাওলিন নিজের ভেতরে এলোমেলো এক ঝড়ো অবস্থা টের পেল! নিজের কানদুটোকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না ঢাকা থেকে দূর, বহুদূর সেই চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে এখানে এসে পড়েছে। ওর দোরগোড়ায়, ওর ভার্সিটির গেট-সমুখে! শাওলিন দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক সুরে বলল,
- আপনি ভার্সিটির সামনে?
- হ্যাঁ। গেটেই আছি। আমি ভেতরে ঢুকব না।
এ অবস্থায় শাওলিন কোনোকিছু ভাবতে না পেরে সরাসরি বলল,
- আপনি দশ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি ব্যাক করছি। আশা করছি আপনার কোনো অসুবিধে হবে না।
- ঠিক আছে। আমি আছি। আসুন।
কলটা কেটে দিয়ে তখনই রিকশাটা ঘুরাতে বলে শাওলিন। চোখের সামনে ভেসে উঠছে চট্টগ্রাম ট্যূরের দিনগুলোর কথা। সেখানে কেমন সব দিন কাটিয়ে অতঃপর ফিরেছিল ব্যস্ত শহরে। কিন্তু ফেলে এসেছিল নিজের মূল্যবান সম্পদ একান্ত ব্যক্তিগত বস্তু ডায়েরি। সেখানে জমা ছিল নিজের তথ্য থেকে কিছু ব্যক্তিগত ছবিও। শাওলিন জানে না একটা অপরিচিত লোক আদৌ ওর ডায়েরিটা খুলে খুলে দেখেছে কিনা। হাত থেকে ধপাস করে ফেলে দিয়ে ছবিগুলোতে চোখ রেখেছে কিনা। চিন্তার ধূলি সাগরে হাবুডুবু খেয়ে অতঃপর এসে পৌঁছুল বিশাল গেটের সামনে। দূর থেকেই লক্ষ করল একটি গাড়ি গেটের ডানপাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির ভেতরে কেউ আছে কিনা বোঝা গেল না। ভাড়া চুকিয়ে শাড়ি পড়ুয়া শাওলিন উঁচু প্যাডেল রিকশা থেকে নামতে নিলে হঠাৎ কে যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সুস্পষ্ট কণ্ঠে বলে ওঠল,
- আপনার হাতটা দিন।
চকিতে বাঁপাশ ফিরে চাইল শাওলিন। চরম অবাক হয়ে দেখল ওর দিকে ডানহাত বাড়িয়ে দিয়েছে লোকটা। সে বুঝতে পারছে উঁচু রিকশা থেকে শাড়ি পড়ে নামাটা বেশ শঙ্কাযুক্ত কঠিন। এদিকে শাওলিন অবাকের শীর্ষেস্থানে আঁটকে গেলে আবারও তাগাদা দিয়ে বলল শোয়েব,
- হাতটা দিন। ওভাবে নামতে গেলে পড়ে যেতে পারেন।
শোয়েবের দিকে স্থির চাহনি রেখে আস্তে আস্তে হাতটা বাড়িয়ে দিল শাওলিন। অনুভব করল ওর মোলায়েম হাতটা চর্তুদিক থেকে দৃঢ়কাঠিন্য মুঠোয় আঁকড়ে ধরেছে। নিজের হাতের সবটুকু ভর ওই শক্ত হাতে চেপে দিয়ে রিকশা থেকে নামল শাওলিন। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো দুটি হাত একে অপরকে পাঁচটি আঙুলে আষ্টেপৃষ্ঠে খাবলে ধরেছিল। যেন একজন চাইছিল হোঁচট খেয়ে ব্যথা না পাক, অন্যজন চাইছিল পা ফসকে পড়ে না যাক। দুজনের এই নিঃশব্দ আকাঙ্ক্ষায় রিকশাওয়ালা মিচকি মিচকি হাসিতে রিকশা ঘুরিয়ে চলল। শোয়েব আশপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে কী যেন দেখে শাওলিনের দিকে বলল,
- এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন? প্রচুর মানুষ। হইচই হচ্ছে। গানবাজনার সাউন্ড আসছে। আপনার প্রবলেম না হলে গাড়িতে বসতে পারি। সাউন্ডপ্রুফ সারফেসে বেটার হবে।
শোয়েবের ইনিয়ে বিনিয়ে বলা চাপা ইঙ্গিতটা ধরতে পারছে শাওলিন। ভদ্রলোক সরাসরি চা-কফি ট্রিটের জন্য বাঁকা পথ অনুসরণে বাধ্য হচ্ছে। বিষয়টা দেখে লাল-খয়েরি লিপস্টিক রাঙা ঠোঁটদুটো মৃদু হাসিতে প্রসারিত হয়। কণ্ঠে সরল সহজ ভাব প্রকাশ করে বলে,
- ঠিকআছে। বসা যেতে পারে।
গাড়িতে বসার সুক্ষ্ম জবাবটা বুঝতে পেরে প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল শোয়েব। রিমোটের বাটনে ক্লিক পড়তেই টুট টুট আওয়াজে গাড়ির দরজা আনলক হয়ে প্রস্তুত হলো। শোয়েব ড্রাইভিং সিটে এবং ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটায় বসে পড়ল শাওলিন। ফটাফট যান্ত্রিক বাহনের ইঞ্জিনটা চালু হতেই ভার্সিটির গেট ছাড়িয়ে রাস্তায় প্রবেশ করল গাড়িটা। গাড়ির ভেতরকার আবহাওয়া এসির ঠাণ্ডায় ভীষণ ঠাণ্ডা রূপ ধারণ করে আছে। যেন মৌনব্রত প্রতিযোগিতায় কেউ কারো কাছে হার মানতে রাজী নয়। এই প্রথম কোনো পুরুষ ব্যক্তির গাড়িতে চড়ে, তাকেই পুরোদস্তুর ড্রাইভার বানিয়ে ঢাকার রোডে এসেছে শাওলিন। আকাশে বিকেলের রঙ ধরেছে এখন। রৌদ্রের তেজ কমলাভ। অখণ্ড নীরবতার ভেতর শোয়েবই নিঃশ্চুপ অবস্থা ভঙ্গ করে বলল,
- আপনি কী বিরক্ত হচ্ছেন?
জানালার দিকে মুখ ফেরানো শাওলিন এপাশ ফিরে বলল,
- বিরক্ত? কেন? আপনাকে ড্রাইভার বানানোর জন্য?
কাঁচ চশমার আড়ালে থাকা চোখদুটো নীলমণিতে হেসে ওঠে। অফ হোয়াইট শার্টের স্লিভদুটো কবজি থেকে ভাঁজ করে কিছুটা গুটিয়ে নেয় সে। ডানহাতে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে নির্জন একটি জায়গায় গাড়ি পার্ক করে বলল,
- পার্সোনাল প্রোপাটিতে প্রোপাইটর থাকা ভালো। এটা নিয়ে ট্রিগার্ড হতে পারলাম না। আপনার সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। এখানে বসবেন নাকি বাইরে গেলে ভালো হয়?
- আমার মনে হয় এখানেই ভালো।
- ঠিক আছে।
কথাটা বলতেই গা থেকে সিটবেল্ট খুলে ফেলল শোয়েব। কিছুটা এগিয়ে এলো বাঁদিকে বসা মেয়েটির দিকে। অকপটে ওর কোল থেকে সেই হাতটিই তুলে নিল, যেটি একটু আগে রিকশা থেকে নামার সময় মুঠোয় পুড়ে ধরেছিল। তবে এবার হাতটি আঙুলের ফাঁক গলে নিজের আঙুলগুলো জড়িয়ে মুঠোবন্দি করে নিল সে। সহসা এমন কাণ্ডে শাওলিন মুখ শুকনো করে ফেললে নির্ভয়চিত্তে আরো খানিকটা এগিয়ে এলো শোয়েব। ওর মুখের কাছে মুখ স্থির করে বলল,
- তোমার মণির কাছে নিয়ে যাবে। এখনই।
ধ্বক্ করে বুকের ভেতরটা শিউরে ওঠে শাওলিনের। গলার নীলচে শিরায় টান টান অনুভব হয়। লোকটা ওই ঠোঁটদুটোয় ওকে 'তুমি' উচ্চারণ করছে। রিমলেস চশমার আড়ালে থাকা চোখদুটো ওর অন্তঃকোণে ছাপ ফেলে আবারও বলে ওঠল,
- ক্যান ইয়্যু মেইক ইট ইজি ফর মি? আই ওয়ান্ট টু হেভ অ্যা পিউরেস্ট রিলেশনশিপ উইদ ইয়্যু। ইফ ইয়্যু হেভ অ্যানি অবজেকশন উইদ মি অর মাই ক্যারিয়ার রিলেটেড সাইট, টেল ইট ইজিলি শাওলিন। আই উইল অ্যাকসেপ্ট অল ইয়্যুর ওয়ার্ডস্। অ্যাভ্রি কণ্ডিশন্স। আই হেভ নো ইস্যুজ উইদ ইয়্যুর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউণ্ড। সাম সর্ট অফ দ্যাট ন্যাস্টি থিংস, আ'ম গননা হেট ইট।
একনাগাড়ে বলে চলা অ্যামেরিকান একসেন্টের কথাগুলো শুনে ঢোক গিলল শাওলিন। এটাকে সম্পর্কের সূচনা ভাববে? বিয়ের প্রস্তাব বলবে? নাকি অন্যকিছুর মূল সমীকরণ? শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল চশমার কাঁচ ভেদ করা দুটো শীতল চোখের দিকে। কিয়ৎক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থাকার পর কী যেন ভেবে আস্তে করে বলল শাওলিন,
- চশমাটা একবার খুলুন।
উদ্ভট একটি কথা শুনে চোখদুটো কিঞ্চিৎ খাটো করল শোয়েব। বুঝতে পারছে না শাওলিনের শেষ উত্তর কী দাঁড়াতে চলেছে। স্বল্প এই দেরিটুকু সহ্য না করতে না পেরে পুনরায় তাগাদা রাখল শাওলিন,
- চশমাটা খুলে ফেলুন।
এবারের কথায় কোনো নড়চড় রাখল না শোয়েব। অন্যহাতে চোখের চশমাটা খুলে নিতেই পূর্ণদৃষ্টিতে শাওলিনের পানে তাকাল। এখনো অনুমান করতে পারছে না তার চশমা খুলে কেন ওভাবে নিগূঢ় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে ও। কী করছে ওভাবে? কী খুঁজছে চোখের ভেতর? শাওলিন আরো একধাপ এগিয়ে দুজনের ভেতর নূন্যতম কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব রেখে আস্তে করে বলল,
- চশমা ছাড়া যতটা স্মার্ট লাগে, চশমা ছাড়া ততটাই সুদর্শন আপনি। আমার কাছে চশমা পড়বেন না।
শোয়েব হেঁয়ালি চালে ঠোঁট টিপে হাসতেই হাতের মুঠোতে সুতীব্র চাপ দিল। আকস্মিক ব্যথায় শাওলিন চোখ খিঁচিয়ে আর্তনাদ করে উঠলে নীচের ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে হাসতে লাগল শোয়েব। সেই প্রচ্ছন্ন হাসির চাপা ইঙ্গিতে হালকা স্বরে বলল,
- বিপদসীমার কাছাকাছি থাকলে এমনিতেও চশমা পড়া যাবে না। আই হেভ টু টেক অফ মাই গ্লাসেস . . .
(খ)
বীরদর্পে জ্বলজ্বল করছে সূর্য। আকাশ মেঘমুক্ত সুনীল। বহুদূর থেকে ছুটে আসা ফুরফুরে নরম হাওয়ায় চোখদুটো বুজে আসছে আবার। কী অপার শান্তি! অন্যরকম সুখ! এ সুখের সংজ্ঞা তুলতুলে নেশার মতো, মদিরার মতো, আচ্ছন্ন করা ঘোর স্বপ্নের মতো মধুর। দুপুরের উজ্জ্বল রঙে ফটফট করছে হোটেল প্যারাডাইস লাউঞ্জ। এতটুকু বোঝার উপায় নেই কী দুর্ভেদ্য অবস্থা আশপাশে লুকোনো, ছুপানো, অদৃশ্য রয়েছে। নিজ নিজ হোটেল-রুমে আরামের ঘুম দিচ্ছে নিদ্রাকাতর সেলিমের দল। গতকালকের সমস্ত জক্কি দুপুরের ভাতঘুম দ্বারা পুষিয়ে নিচ্ছে, তা আদ্যোপান্ত বুঝতে পারছে জাগ্রত রোজা। ডাবল বেডের একটাতে সটান শরীরে শুয়ে আছে রোজা হায়দার। চোখে ঘুম নেই। হাতে ফোন নিয়ে ইন্সটাগ্রাম সাইটে সমস্ত ছবি আপলোড করে অগণিত মানুষের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখছে। স্টোরিতে আপলোড করা উনিশটা ছবির ভেতর একটা ছবি শুধু শাওলিনের সাথে। আর তাতেই কিনা দেখা যাচ্ছে সবচাইতে বেশি, রেকর্ড ব্রেক সংখ্যক রিয়েক্ট-রিপ্লায়ের ঝড়! কী ভয়াবহ! ছবিটা আহামরি এমন কী ছিল যে হুড়হুড় করে রিয়েক্টের ঝড়টা বয়ে গেল? মুখটা পাশ ফেরালে বাঁদিকের বেডে ঘুমন্ত মুখটায় চাইল। গোসল সেরে কোনোরকমে খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছে শাওলিন। ভেজা চুলগুলো মুখজুড়ে ঢেকেঢুকে থাকলেও ফ্যানের বাতাসে শুকোচ্ছে এখনো। পড়ণে কালো রঙের কামিজ, সাদা পাজামা। সুতির সাদা ওড়নাটা মাথার কাছে বালিশের পাশে রাখা। চুলের ফাঁকফোঁকর দিয়ে উজ্জ্বল মুখটা গহিন ক্লান্তির জানান দিচ্ছে। নরম আঙুলগুলো বিছানার ওপর এমনভাবে রাখা, প্রতিটি ভারী নিঃশ্বাসের সঙ্গে কেঁপে ওঠছে আঙুলগুলো। অস্বীকার করবার সুযোগ নেই, শাওলিন ওর নামের মতোই অনন্য। হঠাৎ ঘুমের ঘোরে খুকখুক করে কেশে ওঠলে তৎক্ষণাৎ চোখদুটো সরিয়ে নেয় রোজা। আড়চোখে দেখতে পায় শাওলিন কাশতে কাশতে ওঠে বসেছে। বিশ্রী কাশিটার দরুন বেচারির নাক-মুখ রক্তবর্ণ করুণ দশা! অবস্থা দেখে দ্রুত ফোনটা ছেড়ে বেডসাইড টেবিল থেকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিল রোজা,
- আস্তে আস্তে পানিটা খা। তোর ঠাণ্ডা এখনো কমেনি কেন? কী অবস্থা আল্লাহ! কাশতে কাশতে তোর মুখ লাল টকটকে হয়ে শেষ। এভাবে কারো কাশি হয়?
শাওলিন এক চুমুকে পানিটা সাবাড় করতেই গ্লাসটা ফেরত দিল। গলা কিছুটা শান্ত হলে অবসন্ন সুরে বলল,
- সারতে বেশ সময় লাগবে। কাশি রোগটা আমার জন্য ভয়াবহ। পানিটার জন্য থ্যাংকস রোজা। ধন্যবাদ।
ছোট্ট ওই থ্যাংকসটুকুতে মুচকি হাসলো রোজা। এতটুকু কাজের জন্য কেউ ধন্যবাদ দেয়? দেয় না তো। কিন্তু শাওলিন যে দেয়! এই মেয়েটা ছোট ছোট কাজগুলোতে এমন মিষ্টি করে ধন্যবাদ জানায় যে, অতি তুচ্ছ কাজও অর্থবহ বলে মনে হয়। রোজা গ্লাসটা টেবিলে রেখে বিছানায় বসে বলল,
- থ্যাংকস বলে আমাকে লজ্জায় ফেলিস না জানা। গতকাল তুই না থাকলে আমার কী হতো জানি না। বিপদের দিনে তুই যেভাবে ছুটে এলি . . বিশ্বাস কর, শুধু মনে মনে এতটুকু ভরসা ছিল, আর কেউ আসুক বা না আসুক, তুই হয়তো মুখ ফিরিয়ে যাবি না।
যমের মতো কাশিটায় প্রচুর হয়রান লাগছে শাওলিনের। বিছানার হেডবোর্ডে পিঠ ঠেকিয়ে চুপচাপ কথাগুলো শুনল সে। বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাল না। গতকালকের ব্যাপারটায় ওর যতটুকু অবদান, তার চেয়ে বহু বহুগুণ অবদান সেই দেবদূত ভদ্রলোকের। যদি লোকটা সুসময়ে উপস্থিত না হতো তখন . .? তখন কী হতো জঘণ্য খারাপ দৃশ্যটা? মনে করলেও যে বুকের ভেতরটা ছমছম করে ওঠে! প্রচণ্ড ভয় হয়। তীব্র ভয়। রোজা ফোনটা হাতে তুলে সামান্য জড়তা নিয়ে বলল,
- একটা কথা বলি জানা? উত্তর দিবি তো?
শাওলিন চোখদুটো বন্ধ করে নরম সুরে বলল,
- হুম। বলতে পারিস।
- তুই কী লোকটাকে দেখেছিস? একবারের জন্য হলেও?
আচমকা এই প্রশ্নের কাছে চাপা ইঙ্গিতটা টের পেল শাওলিন। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? হাসপাতালেও এই লোকটাকে নিয়ে 'স্যারের কেস' বলে অন্যরকম একটা আদিখ্যেতা দেখেছে। তৎক্ষণাৎ চোখদুটো রোজার দিকে ফেলে প্রত্যুত্তর করে বলল,
- আমার পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। আমি যখন হসপিটালে পৌঁছেছি তখন তিনি ছিলেন না।
রোজা উত্তর শুনে নীরবে একবার ঢোক গিলল। বুঝতে পারছে না কথাগুলো ওকে বলবে কিনা। একবার চোখ তুলে শাওলিনের জিজ্ঞাসু মুখটায় চাইল সে। মনে হচ্ছে না শ্রেষ্ঠাদের মতো ছ্যাঁচড়া অথবা দুষ্টুমির কোনো ভড়ং শাওলিন করবে। বুকভর্তি করে ফুরফুরে অক্সিজেন টেনে শাওলিনের দিকে পুরোপুরি দৃষ্টি রাখল রোজা,
- আমার কথাগুলো একমাত্র তুই-ই বোধহয় বুঝবি জানা। তাই তোকেই আমি সবটুকু কথা জানাতে চাই। শ্রেষ্ঠা আর সোহা মাঝে মাঝে প্র্যাংক করার নামে কী কী সব বাজে কাজ করে তা তো তুই জানিস। তাই আমি চাচ্ছিস না এসব কথা শুনে ওরা আবার আরেক ঝামেলা টানুক।
বিছানার হেডবোর্ডে তখনো পিঠ ঠেস দিয়ে ওভাবেই বসে আছে শাওলিন। কোলের ওপর ছোট্ট বালিশটা টেনে নিয়ে বেশ গম্ভীর স্বরে বলল,
- কথা আমার কাছে সোজাসুজি বলতে পারিস রোজা। আমি আমার মতো করে বুঝে নিব। যদি মনে হয় আমার কাছে শেয়ার করলে বিপদে পড়বি, তাহলে দরকার নেই। আমি কারো ব্যক্তিগত কথা শোনার জন্য ফোর্স করতে পারি না।
কথার মোড় অন্যদিকে যাচ্ছে দেখে তৎক্ষণাৎ জিভ কামড়ে ' না না' বলে ওঠল রোজা। নিজের সিঙ্গেল বিছানায় যুত করে বসে ফোনটা সাইডে রেখে বলল,
- জানা, আমি তোকে হার্ট করতে চাই না। ভুলে আমার কোনো কথায় হার্টফুল হলে আই অ্যাপোলোজাইয ফ্রেণ্ড। তোকে সব খুলে বলছি, শোন। তুই উনাকে দেখলে কী রিয়েকশন দিতি জানি না। বাট টু বি অনেস্ট, ইট ওয়াজ ভেরি শকিং ফর মি। হয়ার আই থট হি উড বি অ্যান ওল্ড ম্যান, বাট হি ওয়াজ . . হি ওয়াজ . .
হঠাৎ কথার মাঝপথে জিভ আঁটকে জড়িয়ে যায় রোজার। উত্তেজনায় কী বলতে যেয়ে কী বলতে চাচ্ছে কিছুই স্পষ্ট হচ্ছে না। শাওলিন পাশের বেড থেকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালে কিছুটা তাগাদা ছুঁড়ে বলল,
- . . তারপর? হি ওয়াজ? ওভাবে তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই। ঠাণ্ডা ভাবে বল। আমি শুনছি।
রোজা কথাগুলো বলতে গিয়ে আকণ্ঠ অস্থিরতায় হাবুডুবু খাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে তুমুল উত্তেজনার ঢেউ বাঁধ ভাঙছে ওর। চট করে এক গ্লাস পানি খেয়ে পুনরায় বলতে শুরু করল,
- হি ওয়াজ ব্রুটালি হ্যাণ্ডসাম জানা। হিস আই টু আই কন্ট্র্যাক্ট , দ্যাট শার্প স্মাইল . . . কান্ট ডিসক্রাইব ইট মোর। অল আই ওয়ান্ট টু স্যা, উনার চোখদুটো খুবই অন্যরকম। বাদামি, কালো, ধূসরবর্ণ না। জাস্ট নীল . . দি ক্লিয়ারেস্ট পিউরেস্ট ওশেন ব্লু!
কথাগুলো বলতে বলতে হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলেছে রোজা। প্রবল অস্থিরতায় আচ্ছন্ন হয়ে কেমন অপ্রতিভ দেখাচ্ছে ওকে। শাওলিন বুঝতে পারছে না একটা সাধারণ গোছের লোককে নিয়ে অতো মাথাব্যথা কীসের? কী এমন বিশেষত্ব আছে ওই স্বচ্ছ-নীল চক্ষুতারায়? তাছাড়া, তাদের এই ট্যূর গ্রুপের আদনান আবীর সেলিম তো কোনো অংশে কম সুদর্শন নয়। তাহলে কেন এমন অতিরঞ্জিত বলাবলিটা হচ্ছে? রোজা কী একটু বেশি বাড়িয়ে বলছে না? শাওলিন কিছুটা নিরুদ্যম ভাব পোষণ করে বলল,
- দুঃখিত রোজা। আমি সোহা বা শ্রেষ্ঠার মতো রিয়েক্ট করতে পারলাম না। আমার কাছে এটা নরমাল লাগল। আল্লাহর সৃষ্টি সবাই সুন্দর। একটু বাড়াবাড়ি রকম প্রশংসা করতে যেয়ে অন্য কাউকে তুচ্ছ করলে খারাপ দেখায়। আমার মনে হচ্ছে তুই বিষয়টা নিয়ে সেলিমের কাছে আলাপ করবি। সেলিমকে কথায় কথায় ছোট করবি। এর জন্য আগেভাগেই বলে দেই, তুই যদি ওই লোকের অ্যাড্রেস বের করে সোহাদের সাথে ঘুরতে যাস, তাহলে আমাকে প্লিজ সঙ্গে নিবি না। আমি তোদের ওসব হট্টগোল জায়গায় থাকতে চাই না। এখানে এসেছি একটু মানসিক শান্তির জন্য। একটু খোলামেলা হাওয়ায় শান্তির নির্যাসটুকু পেতে চাই। কতদিন সুস্থভাবে থাকব জানি না। আমার জন্য এই দুটো মাত্র দিন, এই আটচল্লিশ ঘণ্টার মুহুর্তগুলো অনেক দামী। দয়াকরে, আর ঝামেলা আনিস না রোজা। আমার এই উপকারটা করলে খুব খুশি হব।
কোল থেকে বালিশ সরিয়ে নিঃশব্দে বিছানা ছাড়ল শাওলিন। শুকিয়ে যাওয়া চুলে রৌদ্র ঝলকানির দাপুটে আভা লেগে বড্ড সুন্দর দেখাল চুল। কাঁধের ডানদিকে সাদা ওড়নাটা টান দিয়ে চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকল শাওলিন। পিছনে ফেলে গেল একরাশ নীরবতা, একস্তুপ চিন্তা, এক অকথিত মানসিক যুদ্ধ। ফোনের স্ক্রিনে ফুটে আছে এক নীরব ঘাতকের নাম। যার ফোনকল, ম্যাসেজ কোনোটাই রিসপন্স করছে না ও।
.
কাঠ মলাটের ডায়েরিটায় হাত রাখল শোয়েব। এই প্রথম অচেনা কোনো অপরিচিতার ব্যক্তিগত সম্পদে হাত রাখল। খোদিত নামের প্রতিটি ইংরেজি অক্ষরের ওপর তর্জনীর ডগা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল, S H E H Z A N A . এখনো খুলে দেখেনি ভেতরে কী আছে। একপৃষ্ঠাও উল্টায়নি কলমের আঁচড়ে কী কী ব্যক্ত হয়েছে। চলন্ত গাড়ির ব্যাকসীটে বসে আজকের এই আকাশ, বাতাস, মুক্ত প্রকৃতির নির্জলা শান্তরূপ ভালো লাগছে। গৎবাঁধা জীবনের প্রতিটি দিন কাটে সহনীয় নিঃসঙ্গতায়। শুরুতে এই নিঃসঙ্গ জীবনের সংজ্ঞা ছিল অসহন, খারাপ, বিষাদগ্রস্ত, অন্ধকার। আজ সময়ের আর্বতনে সেই নিঃসঙ্গতাই হয়েছে অন্যরকম এক আকর্ষণে। যেখানে পরিবার নামক পিছুটান নেই, এই নশ্বর জীবনের প্রতি মৃত্যুভয় নেই, আগামির জন্য দুশ্চিন্তার বুভুক্ষা কাজ করে না মনে। নিজেকে মনে হয় একাকী সম্রাট! এই বনে-জঙ্গলে নিস্তব্ধপুরীর ভয়াল রাজত্বে একমাত্র রাজাধিরাজ! নিজেকে নিয়ে একটুও চিন্তা হয় না শোয়েবের। মাঝে মাঝে মনে হয় দূর কোনো অজানার দেশে পাড়ি দিলে হয়তো দেখা পাবে আম্মির। প্রাণের আম্মিকে আজ কত বছর ধরে দেখতে পায় না। আকাশের দিকে চাইলে ওই নীল আকাশি রঙে আম্মির অবয়ব খুঁজে পায়। ঠিক ওই নীল রঙের মতোই নীল আসমানি শাড়ি পড়তো সে। আবছা আবছা মনে পড়ে আম্মির শান্ত স্নেহের মুখ। মমতাময়ী স্পর্শে আগলে রাখা হাতদুটি ফুলের মতো নরম। ওই গোলাপ, বেলী, হাস্নাহেনার মতোই সুগন্ধি জড়ানো ওম। শীতের রাতে কত হুটোপুটির পর মায়ের বুকে চোখ বুজেছে! আজ সে দিনগুলো কোথায়? কোথায় পালিয়ে গেল সুখ সময়ের মুহূর্ত? রিমলেস চশমার চোখদুটো নিজের হাতের ওপর ফেলল শোয়েব। আকারে বৃহৎ, পুরু ত্বক, খসখসে চামড়ায় দানবীয় হাতে পরিণত হয়েছে। ঠিক এমন সময় মৃদ্যু ঝংকার দিয়ে যান্ত্রিক বস্তুটা দৃষ্টি ভঙ্গ করল। হাতের ডায়েরিটা পাশের সিটে রেখে প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করল শোয়েব। কলার আইডিতে চারবর্ণের নাম। সবুজ আইকনে বৃদ্ধাঙুল ছোঁয়াতেই ফোনটা বাঁকানে চাপলো,
- আসসালামুয়ালাইকুম, সাহেব। অফিসার সাহেব ব্যস্ত না সুস্থ? আপনার ভূতের বাড়িতে মানুষ কোথায়?
কলের ওপাশ থেকে এক বৃদ্ধ নারীর শান্ত অভিযোগ ছুটে এলো। বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা নিয়ে বারুদের মতো ক্ষেপা! শোয়েব বিষয়টা হালকা করতে মৃদু হেসে বলল,
- আপনি ঘরে বসুন। রাস্তায় আছি।
কথা শুনে আরো এককাঠি গনগন ক্রোধে ঝলসে ওঠেন বৃদ্ধা। দারুণ ক্ষোভে ক্ষোভিত হয়ে ভরাট কণ্ঠে বলে ওঠেন,
- আমি তো অফিসার সাহেবের আসাআসির কথা জিজ্ঞাসা করিনি। আপনার ভূতের বাড়িতে চ্যালা মুণ্ডার মুণ্ডিগুলো কোথায়? একটাকেও তো দেখছি না। লেজ গুটিয়ে ইঁদুরের গর্তে পালিয়েছে কেন? আমার ভয়ে?
শোয়েব এ প্রসঙ্গে কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারল না। ঠোঁটের ডানকোণে দাঁত বসিয়ে কী যেন একটু ভাবল। ভাবনা সেরে পরিপূর্ণ সম্ভ্রম ভাব বজায় রেখে বলল,
- ভূতের বাড়িতে রাজ-দাদীর অ্যারাইভাল পছন্দ হচ্ছে না। আপনি ফ্যান ছেড়ে ঘরে বসুন। কল দিয়ে দেখছি কে কোথায় আছে। আমি কাছাকাছি আছি।
নির্ভয়চিত্তে কথাগুলো বলতেই হঠাৎ কলের ওপাশ থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হলো। বৃদ্ধা কেমন আতঙ্কিত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে ওঠল,
- শোয়েব!
আচানক দাদীর ওরকম আতঙ্কিত কণ্ঠ শুনে ত্রস্তভাবে বলল সে,
- কী হয়েছে? হ্যালো? কথা শোনা যাচ্ছে না?
শোয়েবের মনে আবারও সেই পুরোনো আতঙ্কটা বাসা বেঁধেছে! কলের বিপরীত প্রান্ত থেকে কিছুই শোনা যাচ্ছে না! কিছু কী অঘটন ঘটল? নিমিষের ভেতর ড্রাইভারকে গাড়ির স্পিড তুলতে ইশারা বোঝাল সে। এদিকে কল কেটে দ্রুততার সহিত মতিন ও রোকেয়াকে কল দিয়ে বাংলো বাড়িতে এক্ষুণি ঢুকতে বলেছে। এখনো আন্দাজ করতে পারেনি কোন ধরণের সমস্যা হয়েছে। যেটা নিয়ে আশঙ্কা করছে, সেটা কক্ষণো না ঘটুক! অন্তত এখন তো নয়। বহুদিনের বিশ্বস্ত ড্রাইভার চোখের ইশারা পেয়ে বেশ ভালোই স্পিড তুলল। সে জানে, প্রয়োজন পড়লে তার মনিব বিপদসীমায় স্পিড ওঠাতে মানা করেন না। আজও তা-ই। এক লহমায় ফাঁকা রাস্তার সমস্ত ধূলো উড়িয়ে শাঁই শাঁই গর্জনে বাংলোর নিকটবর্তী পৌঁছুল! গাড়ির দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগাল শোয়েব! বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে। কাঁচ চশমার আড়ালে থাকা চোখদুটো নিষ্পলক। স্থির। এক বিধ্বংসী ক্রোধে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। এটা সে আশা করেনি! একদম নয় . . .
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
৬ষ্ঠ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমো সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন