উপন্যাস        :         বজ্রমেঘ
লেখিকা        :          ফাবিয়াহ্ মমো
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১৩ই এপ্রিল, ২০২৪ ইং

লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমোর “বজ্রমেঘ” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২৪ সালের ১৩ই এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন। 
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো

৬ষ্ঠ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো (পর্ব - ৭)


স্তব্ধ, বিমূঢ়, হতবাক চোখে তাকিয়ে রইল শাওলিন। বিস্ময়ে থমথম করছে ওর ছোট্ট নরম মুখ। অবিশ্বাসের দানা বুকের ভেতরে খচখচ করে বিঁধছে। এই অচেনা অপরিচিত পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কীসের বিপদ জুটল? কীসের পূর্বাভাসে বারবার ঝামেলা এসে ভিড়ছে? কার পেনড্রাইভ, কার জিনিস, কে রাতের আঁধারে ওর পাশে এসে বসলো? লোকটার সত্যিকার পরিচয় বোধহয় অন্যকিছু! সে নিজের পরিচয় অতি সাবধানে গোপন করেছে। বনমানুষ! হ্যাঁ, এটাই নিজের জন্য ব্যবহার করেছে লোকটা। কিন্তু বনমানুষ কোনো জলজ্যান্ত মানুষের নাম হয় না। তবে কী কারণে রাতের অন্ধকারে এমন অদ্ভুত জায়গায় এসেছিল? হাতের খামটা পুড়ানোর মূল উদ্দেশ্য কী? শত শত প্রশ্নের ভীড়ে নিজেকে বড্ড টালমাটাল অসহ্য লাগছে ওর। মনের ভেতরে ভর করেছে অসম প্রশ্ন-ঘূর্ণিঝড়! চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই নিজের গায়ের দিকে দৃষ্টি যায় শাওলিনের। চন্দ্রালোকের পাতলা আভায় হুডিটা দেখে প্রচণ্ড আঁতকে উঠল! এ কী! হুডিটার আকার যে এতোক্ষণ খেয়ালই করেনি! হুডিটা যে বিশাল মাপের! কী ভয়াবহ আকার! গায়ে যে দ্বিগুণের চেয়ে তিনগুণ মাপে বড়ো! এই ভাল্লুক মাপের হুডিটি পড়ে ওদের সামনে কীভাবে উপস্থিত হবে ও? কী ভাববে ওরা? দ্রুতবেগে বুদ্ধি হাতড়াতে হাতড়াতে ঢিবির উপর থেকেই ডাক ছাড়ল শাওলিন,
- শ্রেষ্ঠা! আছ? একটু এদিকে আসা যাবে?
শাওলিনের স্পষ্টসুরের ডাক শুনে আচমকা গান থামিয়ে ফেলে শ্রেষ্ঠা। চকিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রত্যুত্তর কণ্ঠে গলা উচুঁ করে জানাল,
- এইতো! আসছি আমি। তুই দাঁড়া।
শ্রেষ্ঠার উচ্চগ্রামের স্বর শুনে স্বস্তিসূচক শ্বাস ফেলল শাওলিন। ধীরেসুস্থে ঢিবি থেকে নামতেই ততক্ষণে শ্রেষ্ঠা একছুট দিয়ে ওর কাছে এসে পৌঁছুল। বুক ধড়ফড় করা শ্বাসে কিছুটা হাঁপাতে থাকলে তেমনি নিষ্কপট সুরে বলল,
- কিছু হয়েছে? হোটেলে ফিরে যাবি? দেখি, তোর জ্বরটা এখন কেমন অবস্থায় আছে।
বলতে বলতেই হাঁপাতে থাকা শ্রেষ্ঠা কাছে এসে ডানহাতের উল্টোপিঠটা শাওলিনের কপাল ছুঁয়ে ধরল। শাওলিন কিছু বলে উঠার পূর্বেই নির্ভয়ে প্রশান্তিসূচক দম ছেড়ে বলল,
- ওহ্, কপাল ঠাণ্ডা। জ্বর নেই। টেনশনে ফেলে দিয়েছিলি। এখন বল, কেন ওভাবে চ্যাঁচিয়ে ডাকলি? কিছু প্রয়োজন?
আলো আঁধারির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা শাওলিন একপলক চর্তুপাশে দৃষ্টি দিল। কেন দিল তা সে নিজেও জানে না। বোধহয় অবচেতন মন এখনো সেই মানুষটাকে অনুভব করার চেষ্টায় আছে। হুডির লম্বাটে স্লিভটা দিয়ে সরু ছিপছিপে নরম হাতটা বের করতেই শ্রেষ্ঠার ডান কবজিটা মুঠোবন্দি করে বলল,
- আমার সঙ্গে হোটেল রুমে আসতে হবে। আমি কিছু কথা বলতে চাই যা এখানে বলা সুবিধাজনক নয়। তোমার আশাকরি সমস্যা হবে না শ্রেষ্ঠা। আসো।
শ্রেষ্ঠা তড়িৎগতিতে বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। নয়তো শাওলিনের মতো শান্ত স্বভাবী ঠাণ্ডা মেজাজি মেয়েটা কখনো এভাবে অনুরোধ করতে যাবে না। প্রয়োজন পড়লে ও নিজেই একা একা হোটেল রুমে ফিরে যাবার হিম্মত রাখে। শ্রেষ্ঠা কোনোরূপ প্রশ্ন না করে সরাসরি শান্তভাবে জানাল,
- ঠিকআছে, চল্। এখানে যদি তোর প্রবলেম হয় তবে হোটেলেই চল্। ওখানে দুদণ্ড স্থিরভাবে বসে সব কথা শোনা যাবে। তোর কাছে রুমের চাবি আছে তো?
- হ্যাঁ, আছে। রুমের চাবিটা আমার কাছে রেখে গিয়েছে।
- পার্ফেক্ট। তাহলে চল্ ফেরা যাক। আমি ফোন করে ওদের বলে দিচ্ছি তোর মাথাব্যথার জন্য আমরা হোটেলে ব্যাক করছি। আমাদের জন্য ওরা অপেক্ষা না করুক, কেমন?
- হুম।
শ্রেষ্ঠা বেশ পরিচ্ছন্নভাবে ব্যাপারটা সামলে নিয়ে সেলিমদের কাছে সহজ করে বোঝাল। ফলস্বরূপ কেউ ওদের নিয়ে বাড়তি কৌতুহল দেখাতে গেল না। শাওলিন এই মুহুর্তে কী বলতে চায় সেটা শোনা অবশ্যম্ভাবী কর্তব্য। প্রায় দশ মিনিটের পথযাত্রা শেষ করে দুজন হোটেলে ফিরলে এবার সত্যিই তাজ্জব হয়ে যায় শ্রেষ্ঠা। রুমের ফরসা আলোয় ভ্রুঁদুটো কুঁচকে অবাক বিস্ময়ে বলল,
- জানা, গা-গা-য়ে . . তো-তোর গা-গায়ে . . .
কথাটা বলতে গিয়ে জিভ আড়ষ্ঠ হয়ে মুখ হাঁ করল শ্রেষ্ঠা! আশ্চর্যের সপ্ত আকাশে পৌঁছে গিয়ে হাঁ করা মুখের ওপর দুহাত ঢেকে রইল। শাওলিন ওর অবস্থা দেখে বিছানার দিকে তর্জনী তাক করে বলল,
- সব বলছি, বসো। আমি জানি তুমি কী ধরণের প্রশ্ন করতে পারো। তার আগে দু কাপ চায়ের জন্য বলে দাও শ্রেষ্ঠা। আমি ওয়াশরুম থেকে মুখ-হাত ধুয়ে আসছি।
বিস্ময়-বিমূঢ় হতবুদ্ধিকর শ্রেষ্ঠা যন্ত্রমানবের মতো কথাগুলো পালন করল। অন্যদিকে শাওলিন বাইরে থেকে আসায় হাত-মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে গা থেকে হুডিটা খুলে রাখল। ছোট্ট ছিমছাম হোটেল রুম। রুমের দুধারে দুটি প্রশস্ত বিছানা। বিছানার মধ্যখান দিয়ে পায়ে হাঁটে ডানদিকের টানটান বিছানাটায় উঠে বসলো শাওলিন। কোলে একটা নরম বালিশ টেনে হাতদুটো সেই বালিশের ওপর রেখে শান্ত নরম কণ্ঠে বলল,
- আমি তোমাকে দলের ভেতর সবচেয়ে বেশি মান্য করি। বিশ্বাস করি শ্রেষ্ঠা। তুমি যেভাবে সবকিছু সহজভাবে মেনে নাও, এটা বাকিরা সেভাবে পারে না। তাই যে কথাগুলো এখন বলব প্লিজ মনোযোগ দিয়ে শুনবে। প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই কোরো। তবে কথা বলার মাঝখানে নয়।
কথাগুলো বলে একটু বিরতি দিয়ে শ্রেষ্ঠার কাছ থেকে সাড়া চাইল শাওলিন। সুক্ষ্ম ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে বিচক্ষণ বুদ্ধির সাথে মাথা নাড়িয়ে 'হ্যাঁ' বোঝাল শ্রেষ্ঠা। সম্মতি পেয়ে চোখের চাহনিতে স্নিগ্ধভাব ফুটিয়ে হাস্যসুলভ সৌন্দর্যটা প্রকাশ করল শাওলিন। বলতে শুরু করল এবার,
- তোমরা চলে যাওয়ার ঠিক ঘণ্টাখানেক পর একজন লোক আসেন। পায়ের শব্দ নীরব, কথাবার্তা খাটো, গায়ে পড়া স্বভাব দেখিনি। আমার কাছ থেকে বেশ দূরত্বে বাঁদিকের খালি জায়গাটায় বসে পড়েন। আমি যেখানে বসেছিলাম তা কেমন অন্ধকার ছিল সেটা নিশ্চয়ই দেখেছ?
শ্রেষ্ঠা স্বল্প জবানে অনুযোগের স্বরে বলল,
- হ্যাঁ, জানা। দেখেছি। জায়গাটা খুব অন্ধকার ছিল। গাছপালায় ঘেরা ছিমছিম জায়গা।
- ধন্যবাদ শ্রেষ্ঠা। মূলত সেই অন্ধকারের জন্য লোকটার মুখ দেখা যায়নি। আমার যতটুকু ধারণা, তিনি নিজেও আমাকে দেখতে পাননি। তার উপর এই কালো হুডিটা তার গায়ে বেশ অদ্ভুতভাবে ঢাকা ছিল। কেন জানি না আমার এখন মনে হচ্ছে লোকটা চাননি কেউ উনাকে চিনে ফেলুক।
কথার মধ্যে গূঢ় রহস্যের সন্ধান পেয়ে ভ্রুঁ কোঁচকাল শ্রেষ্ঠা। দুচোখে কৌতুহলের ঢেউ চকচক করে উঠলে আচম্বিতে শাওলিনের হাতের ওপর নিজের ডান হাত চেপে বলল,
- খুলে বল্! লোকটা কী সন্ত্রাসী গোছের কেউ ছিল? এ এলাকায় আসার আগে সেলিমের মুখ থেকে ভয়াবহ একটা ঘটনা শুনেছি। শুনলে তুই চমকে উঠবি জানা! তোকে বলব বলব করে সুযোগই পাইনি। আচ্ছা, তারপর কী হলো? লোকটা তারপর কী করল?
শাওলিন অন্য প্রসঙ্গে মনোযোগ না দিয়ে নিজের কথাগুলোই গুছিয়ে সাজিয়ে বলল,
- বলা প্রয়োজন, নাক অবধি হুডিতে ঢাকা। মুখের কোনো অংশ দেখা যায়নি। আড়চোখে যতদূর বুঝতে পারছিলাম লোকটা লাইটার দিয়ে একটা খাম পুড়িয়েছে। ওসময় আমি এতো বেশি অন্যমনষ্ক ছিলাম ছোট ছোট বিষয়গুলো লক্ষ করিনি। মনোযোগ দিইনি। কিছু একটা ছিল শ্রেষ্ঠা। এরকম গুমোট চাপা বোধটা আমি কখনো অনুভব হয়নি।
কথাগুলো বলতে বলতে আবারও সুদূর ভাবনা-রাজ্যে প্রবেশ করেছে শাওলিন। ডায়েরিটা খুইয়ে মনের উপর এমন কঠিন চাপ পড়েছিল যে আশপাশের বিষয়বস্তু নিয়ে সজাগ দৃষ্টি পড়েনি। কুয়াশাচ্ছন্ন স্মৃতির মতো আবারও ধোঁয়াটে ক্ষণটা ওর মস্তিষ্কের দুয়ারে চেপে বসে,
' - মেহমান কী গরম পোশাক আনেননি? '
চট করে ছোট্ট এক সূত্র মস্তিষ্কের নিউরনে ঝিলিক দিয়ে উঠল ওর! মেহমান বলতে কী বুঝিয়েছিল লোকটা? শাওলিন তবে মেহমান এবং সেই লোকটা স্থানীয়? তার মানে কী লোকটা স্থানীয় সদস্য? বিদ্যুৎ চমকের মতো ওর সুন্দর চোখদুটো কেঁপে উঠলে শ্রেষ্ঠার দিকে দৃকপাত করল শাওলিন। কণ্ঠে বিহ্বলপূর্ণ কৌতুহল নিয়ে বিচলিত স্বরে জানালো,
- আমার মনে হয় লোকটা স্থানীয় শ্রেষ্ঠা! লোকটাকে খুঁজে বের করা কঠিন কিছু হবে না। আমার জন্য লোকটাকে খুঁজে বের করো। শীঘ্রই!
আচানক শাওলিনের মধ্যে কেমন অপ্রকৃতিস্থ ব্যাকুল ভাব ভর করেছে। যেন কিছুতেই সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিটাকে না খুঁজলে শান্ত প্রকৃতিস্থ হতে পারবে না। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে কী এমন পরিবর্তন ঘটল, যার জন্য এমন অস্থির উৎকণ্ঠায় বিচলিত হয়ে আছে? খুব রহস্যজনক লাগছে! শ্রেষ্ঠা চিন্তিত ভঙ্গিতে ওর কাঁধদুটো ধরে ক্ষিপ্র একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
- জানা, কী হয়েছে! এমন করছিস কেন? তুই অন্যমনষ্ক হয়ে কী ভাবছিস? কী বলছিস? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওই অখ্যাত লোকটাকে কোন্ কারণে খুঁজতে যাব? সে কী তোর সাথে বাজে কাজ করেছে? কোনো দুর্ব্যবহার?
কুয়াশার মতো আবছা ভ্রমের জগতটা আচমকা ভেঙে যায় শাওলিনের। চকিতে বাস্তব জগতে ফিরে আসার মতো জ্বলজ্বল পরিষ্কার হয়ে উঠল। শ্রেষ্ঠা ওর দু'কাঁধ ধরে বিস্ময়-ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছে, সেটি পূর্ণদৃষ্টিতে দেখতে পায় শেহজানা আলম শাওলিন। খড়খড়ে বাতাসে ওর রক্তবরণ ঠোঁটদুটি শুকিয়ে বড্ড টানটান হয়ে আছে। শুষ্ক ঠোঁটের ওপর উপর-পাটির দাঁত বসিয়ে কিছুটা স্তিমিত স্বরে জানাল,
- লোকটার পেনড্রাইভ আমার কাছে রয়ে গেছে। হুডিটার পকেটে ছিল। আমি চাই পেনড্রাইভটা সহি সলামত তার মালিকের কাছে পৌঁছুক। খুব কাছের কোনো জিনিস খোয়ালে কেমন দুর্বোধ্য খারাপ লাগা কাজ করে, সেটা আমার চাইতে দ্বিতীয় কেউ বুঝবে না। তুমি লোকটাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করো। আমি এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে পেনড্রাইভটা উনাকে বুঝিয়ে দিয়ে যেতে চাই। কারো মূল্যবান জিনিস এভাবে বেহুদা নষ্ট হতে দিব না। কাজটা কী সম্ভব শ্রেষ্ঠা? আগামি আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর কী খুঁজে পাওয়া সম্ভব?
প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে ডানহাতের মুঠোটা খুলে দেখাল শাওলিন। ফরসা নরম হাতের মুঠোয় কালো রঙা ছোট্ট একটি পেনড্রাইভ। শ্রেষ্ঠা বস্তুটার দিকে একপলক তাকিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত চোখে শাওলিনের ব্যাকুল নরম মুখে চাইল। কিছু বলতে পারল না ও।
.
চাপ চাপ অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে তল্লাট। রাত নিঝুম জোৎস্নায় ঘুমিয়ে পড়েছে বিশ্ব চরাচর। আবহাওয়া বড্ড শীতল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। শিরশির করে শীতালু কামড় চামড়া দংশন করে। হারিকেনের পলতেটা আরো একধাপ বাড়িয়ে হলুদাভ আলোয় উজ্জ্বল করল ঘরখানা। বিশাল বড়ো রাজকীয় আকারবিশিষ্ট ঘর। প্রতিটি ঘরই বিশাল বড়ো বড়ো। এখনো নাতীর ঘরখানায় পদযুগল রাখেননি বৃদ্ধা। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে হারিকেনের চিকন হাতল ডানহাতে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত দরজায় থেমে গেলেন। বিদ্যুতের সয়লাব প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বড্ড কম। পুরো তল্লাট নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আচ্ছণ্ণ হয়ে আছে। এতটুকু প্রাণের শোরগোল নেই, মনুষ্য গলার কণ্ঠ নেই, আশপাশে ঘন বসতি পর্যন্ত জেগে নেই। রাত কেবল সোয়া দশটা। তাতেই নাতীর এলাকা যেন গভীর নিদ্রায় বুঁদ। চোখের সম্মুখে এখন বিরাট বড়ো নকশা-খচিত কাঠের দরজা। দেখলে মনে হয় বাদশাহী আমলের আলিশান কোনো ভারি প্রশস্ত রাজ-দুয়ার। ঐশ্বর্যে ঘেরা শৌখিন কারুকার্যে বীরদর্প নিয়ে নকশাকার দরজা দাঁড়িয়ে আছে। হারিকেনটি হাত বদল করে বাঁহাতে নিয়ে আস্তে করে ডানহাতটি দরজার বুকে চেপে দিলেন। দরজাটি খুলল না। বেজায় ভারি, ভারিক্কি তার পাল্লা, প্রচণ্ড ভারযুক্ত সেই দরজা। বৃদ্ধা ফাতিমা বুঝতে পারলেন, তার পক্ষে এমন বলশালী দরজাটি খোলা আকাশ-কুসুম ব্যাপার। তিনি বয়স ভারাক্রান্ত ন্যুব্জ দেহে এমন বিশাল রাজ-দুয়ার ঠেলতে সর্মথ নন। পা ঘুরিয়ে নিজ ঘরের দিকে হাঁটা দিলে আশপাশের সৌন্দর্যটুকু রাত্রির গহন আঁধারে দেখতে দেখতে এগোলেন তিনি। স্বীকার করতে বাধ্য, বাংলোটা গা ছমছম ভূতুড়ে শিহরণ দিলেও দিনের ফরসা আলোয় ততটাই আড়ম্বরপূর্ণ সুন্দর। শোয়েবের রুচি নির্জলা প্রশংসার দাবিদার। একদম মায়ের মতো জহুরি শ্যৈন দৃষ্টি পেয়েছে ছেলেটা। নিজ ঘরে পৌঁছুতেই বিছানা সংলগ্ন টেবিলের উপর হারিকেনটি নামিয়ে নরম শয্যায় উঠে বসলেন বৃদ্ধা। চোখে চশমা এঁটে বালিশের কাছ থেকে বের করলেন দুটো জিনিস। তন্মধ্যে একটি বই, অন্যটি অনিন্দ্য সুন্দর সেই কাঠের ডায়েরি। বইটির উপর সাদা রঙে বড়ো বড়ো বর্ণে লেখা, একাত্তরের দিনগুলি। জাহানারা ইমাম। বৃদ্ধ বয়সে এসে আজও তিনি বই পড়া ছাড়েননি। না ছেড়েছেন জ্ঞানের জায়গাকে আরো সুপ্রসন্ন করতে। এমন সময় নীরবতা ছিন্নভিন্ন করে গাড়ি প্রবেশের গমগম শব্দ ভেসে এল। কান খাড়া করে শুনতে পেলেন অবশেষে নাতী ফিরেছে। গাড়িটা জায়গামতো রেখে এসে শান্ত পায়ে দাদীর দরজায় ঠকঠক কড়া নাড়ল। সৌজন্যসুলভ শিষ্টাচারে মুগ্ধ হয়ে ফাতিমা চোখ তুলে বাঁয়ে চাইলেন। ঠোঁটের কোণে হাসির স্ফুরণ ঘটিয়ে বললেন,
- ভেতরে আসুন অফিসার সাহেব। আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম। ভেবেছিলাম দাদীর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরবেন না। এতো রাতে আপনার ডিউটি পড়ে?
দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসলো শোয়েব। ঝরঝরে চুলগুলোতে বিন্দু বিন্দু শিশির লেগে আছে। হারিকেনের হলুদাভ আলোয় দীর্ঘ পুরুষোচিত অবয়ব বড়ো অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ডানহাত উঠিয়ে শিশির সিক্ত চুলগুলো ঝাড়া দিতেই দাদীর কাছে এসে বলল,
- দিনের আলোতে যেটা অদৃশ্য, রাতের আঁধারে সেটা স্পষ্ট। রাত হলে পুরো জায়গাটা টহল দিয়ে আসি। এখানে রাত বাড়লে আবহাওয়া ভালো থাকে না।
বৃদ্ধা কথার পেছনে আসল মর্মার্থ বুঝতে পেরে হাসলেন। চশমার আড়ালে প্রবীণ চোখদুটো গর্বে জ্বলজ্বল করে উঠল। কোল থেকে বইটা সরিয়ে নাতীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,
- আসো দাদু। রাতে তো কিছু খেলে না। আমার হাতের রান্না কী ভালো লাগেনি? কিছু না খেয়ে ওভাবে রাতে বেরোতে হয়?
দাদীর বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে কাছে বসলো শোয়েব। রাতে কেন সে খেতে পারেনি তা নিয়ে কিছুই বলল না। আজও যে ঝালযুক্ত খাবার শোয়েবের জন্য খুবই বিপজ্জনক খাদ্য তা স্পষ্ট জবানে দাদীকে দুঃখ দিতে জানায়নি। দাদী কষ্ট পাবে। ভার-ভরন্ত বাহুদ্বয় এগিয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরল সে। বৃদ্ধার ন্যূব্জ কাঁধে ছোট্টবেলার মতো মুখ লুকিয়ে চোখ বুজল শোয়েব। শিশির ভেজা চুলগুলোতে আঙুল ডুবিয়ে দেন দাদী। নাতী তো উনার একমাত্র নয়, আরো তো নাতী আছে। কিন্তু ওর মতো নাতী যে একজনই আছে। চামড়া কোঁচকানো সরু আঙুলগুলো চুলে বুলিয়ে নরমসুরে বলে উঠলেন,
- দাদু, কিছু একটা মুখে দিয়ে তারপর ঘুমাও। খালিমুখে ঘুমোতে নেই। আসো। কী খাবে বলো, দাদী করে দিই।
দাদীর পরিচিত ঘ্রাণে মুখ লুকিয়ে নির্যুত্তর রইল শোয়েব। স্ফীত পেশির হাতদুটো তেমনি কঠোর রেখে ভীষণ শীতল কণ্ঠে বলল,
- এখন নয়। রাতে ঝামেলা কোরো না। কাল সকালে কিছু একটা করে দিয়ো।
- রোকেয়া বলল সকালের নাস্তা তুমি কিছুই খাও না। ডিম, রুটি খেয়ে বেরিয়ে যাও। এগুলো খাওয়া? স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা করে লাভটা কোথায়? রোকেয়াকে এ কারণে তোমার কাছে পাঠিয়েছিলাম? মতিন পাগলটা সারাক্ষণ তোমার গুণগান গেয়ে বেড়ায়, ও ভাইজান বলতেই অজ্ঞান, অথচ তোমার ব্যাপারে এরা কিছুই বলতে পারল না! এদের চোখগুলো ফাঁকি দিচ্ছ কেন?
আচানক চক্ষুজোড়া খুলে সতর্ক হয় শোয়েব। দাদী কোন ব্যাপারটায় ইঙ্গিত দিচ্ছে? যেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে সেটা নিয়ে? নাকি অন্য? বেশ স্থির হয়ে দাদীর গতিবিধি ঠাহর করতে লাগল শোয়েব। দাদী কিছু বুঝতে না পেরে নিজের মতো করেই বলে চললেন,
- তুমি নিজের সমস্যার ব্যাপারে মতিনদের কাছে জানাও না। মতিন বলল তুমি গাড়িটা পর্যন্ত ওকে চালাতে দিচ্ছ না। গাড়ির জন্য অন্য লোক রেখেছ। এরকম করলে . . .
শেষের কথাগুলোর প্রতি আর মনোযোগ নেই শোয়েবের। প্রথম দু বাক্য শুনেই পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে দাদী ওর আসল দিকে আঁচ করতে পারেনি। একদণ্ড নয়। এখন থেকে আরো বেশি সতর্ক হওয়া দরকার। নইলে বিপদ! শোয়েব নিঃশব্দে হাত শিথিল করে বৃদ্ধাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
- রাত অনেক হয়েছে। তোমার ঘুমিয়ে পড়া দরকার। জার্নি করে এসেছ। আর জেগো না। ঘুমোও।
কথাগুলো বলে দায়সারা ভঙ্গিতে সেখান থেকে প্রস্থান করল শোয়েব। লোডশেডিংয়ের দরুন পুরো বাড়ি অন্ধকার। হাতে সেলফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে নিজ ঘরের দিকে এগিয়ে চলল সে। পায়ের মৃদু শব্দ ছাড়া পুরো বাড়ি থমথমে নিঃসাড়। এমন সময় ট্রাউজারের বাঁ পকেট থেকে যান্ত্রিক কম্পনটা টের পেল শোয়েব ফারশাদ। বাঁহাতে বস্তুটা বের করে সরাসরি সেটা কানে চেপে বলল,
- বাড়ি ফিরলাম। . . না, তেমন নেই। হুম, মেহমান এসেছে। আমার দাদী। . . না, ক'দিন থাকবে সে ব্যাপারে কিছু জানি না। . . বুঝলাম। আমি কিন্তু নিরুপায়। চাপাচাপি করলে ফল শূন্য। . . জানা নেই।
ফোনে কথাগুলো বলতে বলতে নীচতলা থেকে উপরে যাচ্ছিল শোয়েব। হঠাৎ পাদুটো স্থির হয়ে আচমকা দাঁড়িয়ে গেল। চোখদুটো শীতল দৃষ্টিতে কিছু একটা পরোখ করলেও কানে তখনো ফোন আঁটা। সমানে কথা বলে যাচ্ছে। অন্যহাতে ধরা ফ্ল্যাশলাইটের আলোটা কিছুটা দূরে দেয়ালের কাছে ফেলল শোয়েব। অমনেই দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে চকিতে সজাগ হয়ে উঠল! দেয়ালের কাছে ফ [ণা] তুলে কালো কুচকুচে প্রাণীটা তাকিয়ে আছে। গায়ে ডোরাকাটা বি [ষা] ক্ত পরিচয়ের চিহ্ন। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে দ্রুত মস্তিষ্কের সকল নিউরন কর্মক্ষম করল শোয়েব। হাতের টর্চটা সাবধানে একটি জায়গায় রেখে সেদিক বরাবর আলোক উজ্জ্বল রাখল। নিঃশব্দে হাতটা কোমরের পেছনে নিতেই শক্ত বাঁটটা মুষ্টিবদ্ধ করল সে। মনে মনে গণনা শুরু করলে এক ... দুই ... তিন বলতেই সজোড়ে অ [স্ত্র] টা ক্ষিপ্রগতিতে নিক্ষেপ করল! সঙ্গে সঙ্গে ধারালো ফলাটা মা [থা] র একদম মাঝ বরাবর ভে [দ] করে দেয়। এঁকেবেঁকে হুটোপুটি খেতে থাকে ভয়ংকর বি [ষা] ক্ত জী ব টি। ডান কানে সেভাবেই ফোনটা চেপে রেখে প্রয়োজনীয় কথাগুলো চালাতে থাকল শোয়েব। কোনোপ্রকার ভয়-ভীতি না দেখিয়ে আপন মনে টর্চ তুলে উপরে উঠে গেল। দূর থেকে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা দেখে ঠকঠক করে কাঁপছে রোকেয়া। হাত-পা বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ভাইজান কী একটুও ভয় পান না? যদি ওই প্রাণীটা একবার ছোবল দিতো? সামান্য ওই ছুরি দিয়ে কীভাবে ওরকম লক্ষভেদ করলেন! কীভাবে সম্ভব? ওর তো সূঁইয়ের ভেতর সুঁতো ঢুকাতেই জান কয়লা হয়ে যায়, আর এদিকে ভাইজান কলে হুঁ হাঁ করতে করতে নিশানা বরাবর ছুরি! আল্লাহ গো আল্লাহ! কী কঠিন ব্যাপার! কী ভয়ংকর দৃশ্য! রোকেয়া ট্রে সমেত চায়ের কাপ নিয়ে দাদীর ঘরে দ্রুত পলায়ন করল।
ভারি পাল্লার দরজাটা গমগম শব্দে বন্ধ করল শোয়েব। ঘরজুড়ে অচেনা ফুলের সুভাস মাখানো হাওয়া জড়িয়ে আছে। গা থেকে ডিপ গ্রীণ টিশার্টটি খুলে ফেলতেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় সম্পূর্ণ দৈহিক অবয়বটি ফুটে উঠে। নিজের দিকে তাকানোর মনোভাব আর নেই। শুধু সমুদ্র নীল দৃষ্টিযুগল কয়েক সেকেণ্ডের জন্য বাঁ'কাধের কাছে পড়ল। সূঁচের প্রতিটি ফোঁড়া স্পষ্ট খারাপ দেখাচ্ছে। ফোঁস করে ভারিক্কি তীব্র শ্বাস ফেলতেই কানে টুং টাং আওয়াজ শুনতে পেল। চোখদুটো ড্রেসিং টেবিলের উপর পরতেই তৎক্ষণাৎ ভ্রুঁ কোঁচকালো শোয়েব। চট করে ফোনটা হাতে তুলতেই দেখল একটি উদ্ভট টেক্সট জমে আছে। টেক্সটটি ঠিক এরকম করে লেখা,
“ Can you kiss me , Gentleman Shoyeb? Response, hurry up!”


আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

 Follow Now Our Google News

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

৮ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমো সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন