উপন্যাস        :         বজ্রমেঘ
লেখিকা        :          ফাবিয়াহ্ মমো
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১৩ই এপ্রিল, ২০২৪ ইং

লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমোর “বজ্রমেঘ” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২৪ সালের ১৩ই এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন। 
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো
বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো

৭ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

বজ্রমেঘ || ফাবিয়াহ্ মমো (পর্ব - ৮)


মৃত্যু বারবার ছোবল বসাতে চাইছে। কিন্তু পারছে না! অদৃশ্য ভাবে বারবার বহুবার অসংখ্যবার আক্রমণ করতে চাইছে, কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থ! এমন অব্যক্ত ভয়াবহতার সাথে দিন কাটাচ্ছে শোয়েব, যেখানে কখন কোথা থেকে মৃত্যু এসে পড়ে এসে জানা নেই ওর। এই তো কিছুক্ষণ আগে বাড়ির ভেতর গো [খ] রো বি [ষা] ক্ত প্রাণীটাকে নিষ্ঠুরভাবে হ. [ত্যা] করল। [সা] পটা কোত্থেকে এসেছে, কীভাবে এসেছে সে প্রশ্নের উত্তর জানে না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এই প্রাণঘাতী কাজগুলো বাড়ির চেনা কেউ করেছে। অথচ, মতিন ও রোকেয়া এ বাড়ির কতটা বিশ্বস্ত ও ভরসাযোগ্য জীব, তা শোয়েবের চেয়ে বেশি কেউ জানে না। দরকার পড়লে নিজেদের জান পর্যন্ত কুরবান করতে প্রস্তুত, তবু এ বাড়ির ত্রিসামানায় বিপদের অগ্নি ঘেঁষতে দেবে না ওরা। হারিকেনের হলুদাভ আলোটা ছোট্ট গোল স্ক্রুতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ কমিয়ে দিল সে। রাতে আজ কিছুই খায়নি। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুমের উপর নিষ্ঠুরতম দক্ষতা অর্জনের পর শারীরিক দুর্বলতা ভর করে না। পরিচ্ছন্ন টানটান বিছানায় না খেয়েই শুয়ে পড়ল শোয়েব। কারিগরি ত্রুটির অপঘাতে বিদ্যুৎ সাহেব গায়েব। কখন আসবে ঠিক নেই। ফোনটা চার্জে দেওয়া অত্যাবশ্যক। ফোনের কথা মনে পরতেই একটু আগের ম্যাসেজ কাহিনি ফের মনে পড়ল। তাকে রাতবিরেতে ম্যাসেজ পাঠাবে এমন কট্টর দুঃসাহস কে দেখাচ্ছে? কে তাকে অমন বিশ্রী কথা বলার আস্পর্ধা দেখাল? সামনে পেলে ওই ব্যক্তির অবস্থা কী করে ছাড়তো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিছানায় সটান শুয়ে সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইল। মন বলছে হুডিটার ভেতরেই পেনড্রাইভটা হয়তো ছিল। আবার মনে হচ্ছে হয়তো পকেট থেকে কোথাও পড়ে গিয়েছে। রাগে, ক্ষোভে, উত্তপ্ত জেদে নিজের উপর মহা ক্ষুদ্ধ সে! আজ কেন সে অমনোযোগী হয়ে পড়ছে? কেন! এরকম তো আগে কখনো হয়নি। কক্ষনো নয়! কেন এতোগুলো বছর পর ছন্দপতন হচ্ছে জীবনে? কেন ভারসাম্য হারাচ্ছে তার একাকী বুনো জীবন? আম্মি বলতেন, যখন কোনো সুশৃঙ্খল কাজ অলৌকিক কায়দায় উলটে যায়, তখন ধরতে হবে, সেখানে মঙ্গলসূচক কিছু আসছে। কিন্তু এই ছোট ছোট ভুলের ভেতর কীসের মঙ্গল আসবে? কেন এসব ঘটল? আর এসব ভাবতে চাইল না শোয়েব। বিরক্তি ভরা মনটা ঘুমের কাছে ছেড়ে চোখদুটো বুজে নিল। মাথার কাছে প্রকাণ্ড খোলা জানালা। শোঁ শোঁ করে সুতীব্র ঠাণ্ডা আদুরে হাওয়া পর্দা উড়িয়ে ঢুকছে। গভীর ক্লান্তিতে ডুবো ডুবো মন তন্দ্রার ঘোরে তলিয়ে যাচ্ছে। চোখের বন্ধ ক্যানভাসে ধীরে ধীরে, বড়ো অস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠল ছবি। ঝাপসা, অস্বচ্ছ, ঘোলাটে দৃশ্যপট। নার্স ফাইরুজ উচ্চকণ্ঠে রেহানা হানিফকে সেই অজ্ঞাত পেশেন্টের জন্যে নিয়ে যাচ্ছে। শোয়েব রিসেপশনের কাছে দাঁড়াতেই টেলিফোন ছেড়ে সশ্রদ্ধ হাসি উপহার দিল মেয়েটা। কেমন যেন আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলল,
- স্যার, আপনার হাতটা ড্রেসিং করে দিই? ওভাবে রুমাল বাঁধলে সমস্যা হবে!
চশমার কাঁচ ভেদ করে সোজাসাপ্টা মেয়েটার মুখে চাইল সে। দুদণ্ড স্থির পানে তাকিয়ে থেকে দৃঢ়প্রোথিত স্বরে বলল,
- ধন্যবাদ সুমিত্রা। তুমি আমাকে পেশেন্টের অবস্থা জানিয়ে উদ্ধার করো। সেটা বেশি জরুরি দেখছি।
মেয়েটা মুখের উপর পাথুরে কট্টর জবাব পেয়ে থতমত খেয়ে গেল। দ্রুত অপ্রস্তুত ভাবটা সামাল দিয়ে ঠেলেঠুলে হাসি ছুঁড়ে বলল,
- অচেনা মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে স্যার। এইমাত্র খবর এল। ইন্টার্ণ ডাক্তার বলেছে পেশেন্ট এখন বিপদমুক্ত। আপনি কী তার সঙ্গে দেখা করবেন?
হাতের মুষ্টিবদ্ধ জায়গাটা সাদা রুমালে পেচাতে পেচাতে সেভাবেই ব্যস্ত স্বরে জবাব দিল শোয়েব,
- হ্যাঁ, দেখা করব। কেবিনটা কোনদিকে? ডান না বাম?
- উপরে গিয়ে সোজা হেঁটে ডানদিকের রুমটা স্যার। আপনার চিনতে সমস্যা হলে আমি আসি?
আবারও প্রস্তর-কঠিন জবাবে ব্যারিকেড রাখল সে,
- সমস্যা হলে আমি সেটা দেখে নিব। থ্যাংক ইয়্যু সুমিত্রা। নাইট ডিউটি রিল্যাক্সে হোক।
হাতে কোনোরকম রুমাল পেচিয়ে নিঃশব্দ পায়ে হাঁটা দিল শোয়েব। মাথাটা পিছু না ঘুরালেও সে জানে, সুমিত্রা দত্ত তার দিকেই মুচকি মিঠে হাসিতে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা খামখেয়ালি। অল্প বয়স। যে বয়সটা আবেগের ঘোরে বর্ষার মতো আছড়ে পড়ে, সে বয়সটা নিশ্চয়ই সর্বনাশী! এই সর্বনাশা ঝড়ঝঞ্ঝাকে উপেক্ষা করে নিঃশব্দ চিতার মতো উপরতলার কেবিনে ঢুকল শোয়েব। মেয়েটা যেন তাকে দেখে থমকানো দৃষ্টিতে চোখ পিটপিট করে চাইল।
- ভালো আছ? শরীর এখন কেমন?
কুশল প্রশ্নটা নিজ থেকেই ছুঁড়ে দেয় শোয়েব। তার সামনে থাকা মেয়েটি নেহাতই ছোট মানুষ। দেখলেই বোঝা যায় ভার্সিটি স্তরের দুরন্ত ছটফট শিক্ষার্থী। ফলে সম্বোধনটাকে 'আপনি' থেকে 'তুমি'তে নামিয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করল শোয়েব,
- সুস্থ বোধ করছ?
বলতে বলতেই ছোট্ট একটা স্টিলের টুল টেনে বসে পড়ল শোয়েব। কেবিনের উজ্জ্বল আলোতে মেয়েটা যেন চোখ ভরে ভরে তাকে দেখছে। কী দেখছে ওভাবে? তার চোখ, তার ঠোঁট, তার গলার উঁচু হাড্ডি, তার ভার-ভরন্ত পৌরুষ বুক সবকিছু! কৌতুহলে দেখতে দেখতে মেয়েটা বেশ চমকে উঠে মৃদু গলায় শুধোয়,
- আপনি কী এখানকার ডাক্তার? আমার হাতে-পায়ে ব্যাণ্ডেজ কী আপনি করেছেন?
মেয়েটার অস্থির মাখা চোখদুটো কী যেন জানার আকাঙ্ক্ষায় মুখিয়ে উঠল। হয়তো চাইছে, এই সুদর্শন শান্ত লোকটাই ডাক্তার হোক! ইনিই যেন মুখ ফুটে বলুক ওর সম্পূর্ণ দেখভাল সে-ই করেছে। শোয়েব মেয়েটার চোখ দেখে মনের অবস্থা ঠাহর করে চোরা-সুলভ হাসলো। ভার ভার হাতদুটো বুকের কাছে আবদ্ধ করতেই স্বাভাবিক গলায় শুধোল,
- আমি ডাক্তার হলে কেমন ফ্যাসিটিলিস আমার কাছ থেকে আশা করছ? মনে হচ্ছে তুমি চাচ্ছ, আমি নিজেকে যেন ডাক্তার বলে পরিচয় দেই।
কথাটা শুনে ধ্বক করে উঠল মেয়েটার বুক! সেকেণ্ডের ভেতর সমস্ত মুখ আকণ্ঠ ব্রীড়ায় জবুথবু হয়ে ঢোক গিলল। বুঝতে পারলো সামনে বসা এই দেবদূত লোকটি আয়নার মতো ওকে পড়ে দেখছে। তৎক্ষণাৎ নিজেকে শুদ্ধ প্রমাণের জন্য জোর গলায় বলে উঠে,
- আশা? আশা করিনি তো। আমি জাস্ট নরমালি জিজ্ঞেস করেছি আপনি আসলে ডাক্তার কিনা। যেভাবে এতো দ্রুত গাড়িতে করে হসপিটালে আনলেন, এটা তো সাধারণ কেউ করতে পারতো না। আপনার পরিচয়টা দিবেন?
বুকের কাছে হাত ভাঁজ করা শোয়েব শান্ত নীল চোখদুটো কিঞ্চিত খাটো করল। সরুদৃষ্টিতে কী যেন পরোখ করতেই গম্ভীর সম দমটা ছাড়তে ছাড়তে জবাব রাখল,
- তোমার নাম বলো। এখানে এই সন্ধ্যায় কেন এমন জায়গায় এসেছ? আমি ধরে নিচ্ছি তুমি একা আসোনি। আসার কথাও নয়। সঙ্গের মানুষজন কোথায়?
লোকটার পরপর 'তুমি' করে বলাতে বুক কেমন মোচড়ে উঠে ওর। লোকটার গায়ে আধভেজা নীলবর্ণ শার্ট। বৃষ্টির পানিতে ঝরঝরে চুলগুলো ভিজে আঙুলের স্পর্শ পেতে মুখিয়ে আছে। বসার ভঙ্গিতে ব্যক্তিত্বসুলভ পরাক্রান্ত মর্যাদা। ওর আহ্লাদী চোখদুটো ওই সম্ভ্রন্তসূচক আকর্ষণীয় চোখজোড়াতে আবদ্ধ করে বলল,
- আমি রোজা। পুরো নাম রোজা হায়দার। আমার দলের ওরা হোটেল প্যারাডাইস লাউঞ্জে উঠেছে। এখানে এসেছি ট্যুরিস্ট স্পটগুলো ভিজিট করতে। সবই আমাদের চমৎকার ভাবে কাটছিল। কিন্তু . . কিন্তু সন্ধ্যের প্ল্যানে ওরকম একটা দুর্বৃত্তের দল এসে সব ভেস্তে দিল। ওরা ভয়ে দৌড়ে পালাল, আর আমি . . .। বাকিটা আপনি নিজেই আন্দাজ করে নিতে পারবেন।
সম্পূর্ণ কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার পর মাথাটা ঈষৎ নাড়লো শোয়েব। অর্থাৎ, পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। মনে মনে প্যাজেলের টুকরোগুলো ঠিক করে বসাতেই হঠাৎ একটা জায়গায় শূন্যতা টের পেল। চট করে রিমলেস চশমার চোখদুটো প্রখরদীপ্ত হয়ে রোজার দিকে দৃষ্টি তাক করে বলল,
- রিসিটের সেই মেয়েটা কী হয়? বোন?
রোজা তৎক্ষণাৎ ভিড়মি খেয়ে চটজলদি জিভ কামড়ে ফেলল। মাথাটা ডানে বাঁয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলল,
- না, বোন কীসের! শী ইজ মাই ফ্রেণ্ড। ওর নাম শেহজানা। আমরা ওকে জানা বলে ডাকি। ওর ভালো নাম শাওলিন। আমরা একই ডেপ্টে, একই কলেজে পড়তাম। বতর্মানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন পড়ছি। নার্স জানালো ওর নাকি প্রচণ্ড জ্বর। জ্বরের জন্য সেন্সলেস অবস্থা। এখন কী করব বুঝতে পারছি না। ওর বাবা-মা জানলে রক্ষে নেই! খুব বিপদ হবে। খুব!
রোজার আতঙ্ক ভরা কণ্ঠে কী যেন একটা সুর ছিল। ভয়, দুশ্চিন্তা বা অন্যকিছুর আভাস! সামান্য জ্বর আসা নিয়ে ওরকম ভয় পাবার কী আছে? ওর বাবা-মা জানলে অবশ্যই শাষণের জায়গা থেকে দু চারটা কথা শোনাবে, কিন্তু তাই বলে ওরকম কী বিপদ? ঘটনা কী? শোয়েব কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নয়। কিন্তু রোজার মুখটা ভয়ে এইটুকুনি হয়ে গেছে। ভীতু মুখে বারবার ঢোক গিলতেই অন্যমনষ্ক সুরে বলতে লাগল,
- ওদিকের কেউ জানতে পারলে . . . আঙ্কেল বা আন্টি . . . খুব বিপদ হবে। কেউ জানে না ও যে জঙ্গলি জায়গায় এসেছে। আল্লাহ রহম করো!
অব্যক্ত ভয়ে রোজার মুখটা আরো পাংশুবর্ণ দেখাচ্ছে। বেডে আধশোয়া অবস্থায় গায়ের চাদরটা মুঠোর ভেতরে খামচে ধরেছে। অমন বিস্ময়কর অবস্থা দেখে শোয়েব বুকের কাছ থেকে আস্তে আস্তে হাতদুটো শিথিল করে তাকাল। ভ্রুঁদুটো কুঁচকে তার প্রশস্ত মসৃণ পৌরুষ কপালে চিন্তার খাঁজ গেঁথে দিল। শোয়েব বেডসাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে রোজার দিকে বাড়িয়ে বলল,
- পানি খাও। বিপদ এর চেয়ে খারাপটাই হতে পারতো। তোমাদের ট্যুরিস্ট গাইড কেন ও জায়গার জন্য নিষেধ করেনি এটা আমাকে ভাবাচ্ছে। ভাগ্য যথেষ্ট ভালো বলব। আমার ডিউটি নর্থলেনের ওদিকে না পড়লে তুমি আজ খারাপ অবস্থায় পড়তে।
থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতটা পানির গ্লাস বুঝে নিয়েছে। একচুমুকে পানিটা সাবাড় করলেও চোখদুটো সম্পূর্ণ শোয়েবের দিকেই আকৃষ্ট ছিল। যেন জানতে চাইছে তার সত্যিকার পরিচয়, তার আসল ব্যাকগ্রাউণ্ড, তার সবকিছু! শোয়েব নির্ঝঞ্ঝাট সবটা আঁচ করতে পেরে বেশ সাবলীল স্পষ্ট সুরে জানিয়ে উঠল,
- শোয়েব ফারশাদ। ফরেস্ট এরিয়ার বর্তমান কর্মকর্তা। সম্পূর্ণ অঞ্চল আমার রেকিতে থাকে। তোমার দলবল বোধহয় নির্দেশনা অমান্য করে ওই জায়গাটায় গিয়েছিল। কাজটা একদম ঠিক করেনি। কাল সকালে এর একটা চূড়ান্ত ব্যবস্থা করব। ওকে, অলরাইট দ্যান, আজ আসতে হচ্ছে রোজা হায়দার। প্রোপার রেস্ট নাও। আসি।
এরপর সেই কেবিন থেকে পা চালিয়ে কেন জানি অন্যত্র জায়গাটায় চলে এল। সেই নির্দিষ্ট কেবিন . . . সেই দুরন্ত সাহসী মেয়েটা . . . সেই মেয়েটার অসহ্য জ্বরাক্রান্ত অবস্থা। শোয়েব আস্তে করে কেবিনের দ্বার ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। চোখের সম্মুখে দেখতে পেল রেহানা হানিফের মূর্তি। তবু দেখতে পাওয়া গেল না জ্বরের ঘোরে পুড়তে থাকা মেয়েটাকে। কেমন করে, কীভাবে অতো সাহস নিয়ে চলে আসার হিম্মত রাখে? ওর বাবা-মা কী জানে না ও কোথায় এসেছে? কেমন করে ভয়ংকর জায়গায় প্রকৃতি খুঁজতে বেরিয়েছে? থাইগ্লাসের আয়নায় তবু একঝলক দেখা গেল। শুধু একটুখানি অস্পষ্ট অবয়ব। কৃষ্ণকালো চুলে ওপাশ ফেরানো মুখটা ঢাকা। হাতটা বেডের বাইরে নিঃস্ব ভাবে ঝুলে আছে। ঘুমের ঘোরে মনে হলো, ওই তপ্ত হাতটা তুলে নিজের মুঠিতে জড়িয়ে রাখে। ওইটুকু হাত কী তার বিশাল পৌরুষ হাতের মুঠোয় লুকোবে না? আঙুলের ডগায় সমস্ত চুল সরিয়ে একবার কী দেখা মিলবে তার? একপলক, একবার, একটুখানি? শোয়েব অতলস্পর্শী গভীর নিদ্রায় ডুবে যায়। আর কিছু ভাবেনি। ফোনের ব্যাটারি রেড সিগন্যালে থাকায় আর খেয়ালই করেনি, সেই উদ্ভট ম্যাসেজটা এসেছে তার স্বপ্নে ভাবা স্বপ্নচারিণীর।
.
ঘুম থেকে উঠার পর ভ্রুঁ কুঁচকে আছে শাওলিন। প্রচণ্ড আজগুবি লাগছে ওর। কিছুতেই বুঝতে পারছে না ফোনটা ওয়াশরুমে কীভাবে গেল! সকাল সকাল হাত-মুখ ধোয়ার জন্য ওয়াশরুমে গেলে বেসিনের তাকে ফোনটা দেখতে পায়। ফোন কী হেঁটে হেঁটে ওয়াশরুমে ঢুকেছে? কেমন উদ্ভট ব্যাপার না? মনের মধ্যে প্রশ্ন জমিয়ে শেষপর্যন্ত আগাগোড়া ফোনের চেক করল শাওলিন। তেমন কিছু সন্দেহজনক লাগল না। বরং এখন মনে হচ্ছে, রাতে মুখ ধুতে গিয়ে নিজেই বোধহয় বেসিনের তাকে ভুলক্রমে ফেলে এসেছে। ইদানিং নিজের ভুলোমনার রোগে ও নিজেই অতিষ্ঠ! কোনোকিছু এক জায়গায় রাখলে সেটা আর মনে করতে পারে না। পাশের বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে এখনো ঘুমোচ্ছে রোজা। বাকিদেরও ঠিক একই অবস্থা। এখনো প্রভাতের আলো গায়ে মেখে কেউই শয্যা ছেড়ে উঠেনি। রাতে বেশ ঠাণ্ডা পড়ায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে জম্পেশ ঘুমটা হয়েছে। রুমের একপ্রান্তে একচিলতে বারান্দা। সকালের সোনা রোদ দুষ্টু শিশুর মতো লুকোচুরি করে পাতার ফাঁকফোঁকর গলে বেরিয়ে আসছে। পায়ের কাছে রোদের উষ্ণতা ছুঁয়ে বুক ভর্তি করে শ্বাস টানল শাওলিন। দুচোখ বন্ধ করে বারান্দার খোলা আবহাওয়ায় নিজেকে পাখির মতো মেলে দিল। কী সুন্দর . . কী উদার . . কী প্রাণখোলা সজীবতা! মন চায় এখানেই শুধু রয়ে যেতে। সবুজের গায়ে মিশে গিয়ে প্রভাতের আলো মুঠো মুঠো কুড়োতে। বেলীফুলের গন্ধ মাখানো হাওয়ায় চুল ভাসিয়ে দূর দিগন্তে হারিয়ে যেতে। শাওলিন অনেকদিন পর আবারও প্রাণখোলা হাসিতে দূরের পাহাড়গুলো দেখল। দেশের পাহাড়! স্বদেশের পাহাড়! প্রিয় মাতৃভূমির পাহাড়-চূড়ো! ওই দূর আসমানে আসমানী রঙ ফুটে সোনা রোদ ঝরাচ্ছে। পাহাড়ে, সবুজে, নীলে, স্বর্ণাভ রোদ্দুরে একাকার হয়ে বুকের কোথায় যেন আনন্দ বিকিরণ করছে। হঠাৎই ঘনঘোর বর্ষার মতো মুখের সবটুকু প্রাঞ্জলতা অমাবস্যার কোলে ঢেকে গেল। মুখের সরস হাসি, নিষ্পাপ চাহনি সবই নিষ্ঠুরভাবে নিংড়ে গেল। মুখ নীচু করে নিজের হাতের প্রতি দৃষ্টিপাত করল শাওলিন। কালো কামিজের হাতায় দুহাত কবজি পর্যন্ত ঢেকে আছে। আস্তে আস্তে ডানহাত দিয়ে বাঁহাতের উপর থেকে কালো হাতাটুকু সরাতে সরাতে কনুই পর্যন্ত থামল। আর উঠানোর সাহস পেল না ও। দাঁত খিঁচে বড্ড কঠোর হয়ে আসছে! যেন প্রাণপণ নিজেকে সামলানোর যুদ্ধ চালাচ্ছে ও। চামড়ার দগ্ধ বিশ্রী দৃশ্যটা দেখতে দেখতে চোখ ঝাপসা হয়ে এল। থরথর করে কাঁপতে লাগল ওষ্ঠদ্বয়। ধ্বক্ ধ্বক্ করে মারণ শব্দে ছুটছে হৃৎপিণ্ড! মাথার ভেতর সমস্ত স্মৃতি উত্তাল ঘূর্ণিঝড় পাকিয়ে প্রচণ্ড অস্থির করে দিল। শাওলিন অসহ্য অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়ে তাড়াতাড়ি হাতটা ঢেকে দিল। উত্থাল পাত্থাল নিঃশ্বাসে বেচইন হতেই বারান্দা ছাড়ল শাওলিন। দ্রুত রুমে ফিরে নিজের বিছানায় লম্বা লম্বা অপ্রকৃতিস্থ দম টানতে লাগল। একটুও ভালো লাগছে না। একটু শান্ত হচ্ছে না। লাগাতার চোখ বুজে শ্বাসক্রিয়া চালাতে থাকলে এমন সময় ফোন বেজে উঠল। বিশ্রী রিংটোনে চারধার কাঁপিয়ে তুললে বাধ্য হয়ে ফোনটা হাতে তুলল শাওলিন। তখনো শ্বাসক্রিয়া সেভাবেই চলছে ওর। তার মধ্যেই ফোনটা রিসিভ করে সামান্য ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে ছোট্ট স্বরে বলল,
- হ্যা..হ্যালো,
অসহ্য শ্বাসক্রিয়ার দরুন স্ক্রিনে নামটা খেয়াল করেনি শাওলিন। বুজে থাকা চোখদুটোর কোল ঘেঁষে দুফোঁটা অশ্রু শিশির ঝরল। তেমনি শ্বাস নিতে থাকলে ওপাশ থেকে অপরিচিত গলায় কে যেন ব্যগ্র সুরে বলল,
- তুমি শেহজানা বলছ কী?
আকস্মিক ধাক্কার মতো প্রচণ্ড পিলে চমকে উঠল ওর! কান থেকে ফোন নামিয়ে বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টিতে থমকে গেল। এই ব্যক্তি কে? কেন ওর নাম ধরে খোঁজ করছে? এখন তো আর সমস্যা হবার কথা নয়! দলের সবাই তো হোটেল রুমেই আছে। এমনকি রোজাও।
তবে কী . . . ?

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

 Follow Now Our Google News

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

৯ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা ফাবিয়াহ্ মমো সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন