উপন্যাস        :         কেয়া পাতার নৌকা
লেখিকা        :          রাজিয়া রহমান
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ২২ই ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ইং

লেখিকা রাজিয়া রহমানের “কেয়া পাতার নৌকা” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২৪ সালের ২২ই ফেব্রুয়ারী থেকে লেখা শুরু করেছেন। 
কেয়া পাতার নৌকা || রাজিয়া রহমান
কেয়া পাতার নৌকা || রাজিয়া রহমান


৮ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

কেয়া পাতার নৌকা || রাজিয়া রহমান (পর্ব - ৯)

আজ রাবেয়ার বিয়ে। সকাল থেকে আকাশ কালো হয়ে আছে।তরু বসে আছে রান্নাঘরে। মুরগির চামড়া বাছতে বসেছে তরু।
বলা যায় মায়ের কাছ থেকে পালাতেই তরু এখানে এসে বসে আছে।
মায়ের দিকে তাকাতে পারছে না তরু।মায়ের অশ্রুভেজা চোখের দিকে তাকালেই তরুর বুকটা কাঁপে।
মায়ের দিকে তাকালেই তরুর ইচ্ছে করে বলে যে মা তুমি যেও না,আমার কাছে থাকো।আমি থাকতে পারবো না তোমাকে ছাড়া মা।
কিন্তু বলা যায় না।কান্নারা গলায় এসে আটকে আছে। মায়ের দিকে তাকানোই যায় না।
রাবেয়া জড় বস্তুর ন্যায় বসে আছে। কোনো আবেগ নেই,অনুভূতি নেই।কেউ রাবেয়ার মতামতের কোনো দাম দেয় নি।
মেয়েটা এখনো ছোট, মেয়েটা বুঝতে পারছে না কিছুই।বুঝতে পারলে কখনো এই কাজে রাজি হতো না। মেয়েটা কিভাবে থাকবে একা একা?
রাবেয়ার কেমন কলিজা ছিড়ে যাওয়ার মতো ব্যথা হচ্ছে।
তরুর বাবা মারা গেছে যেদিন সেদিন যেমন লেগেছে রাবেয়ার আজও তেমন লাগছে।
আজকের পর তরুর বাবা ও নেই,মা ও থাকবে না।
পাত্রপক্ষ থেকে মেহমান এসেছে ৩০ জন।বিয়ের সম্পূর্ণ খরচ তরুর চাচা করছে।ভাইয়ের এতো লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ ভোগ করতে হলে একটু খরচাপাতি ও করা লাগবে।নয়তো লোকের চোখে ভালো হবে কিভাবে!
পাত্রের দুই বোন মিলে রাবেয়াকে সাজাতে লাগলো। রাবেয়ার কেমন হাসি পেলো। এই বয়সে আবার বিয়ের সাজ!
কেমন হাসির কথা!
বিধবার শরীরে আজ বিয়ের লাল বেনারসি উঠছে।আহারে জীবন!
রাবেয়াকে কোনো মতে সাজানো হলো।আয়নায় নিজেকে দেখে রাবেয়া চোখ বন্ধ করে ফেললো। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।তরু কই?
সকাল থেকে মেয়েকে দেখা না রাবেয়া।
কাজী এলো বিয়ে পড়াতে।রাবেয়াকে কবুল বলতে বলা হচ্ছে। রাবেয়া আকুল হয়ে কাঁদছে আর বলছে আমার তরু কই?আমার তরুরে ডাকেন।আমার মেয়ে না এলে আমি কবুল বলবো না।
রাবেয়ার কান্না দেখে বিরক্ত হয়ে পাত্রের বোন বললো, "এতো নাটক কিসের এখন বিয়ের দিন?বিয়ের আগে মেয়ের জন্য এই আদর কই ছিলো? এতো আদিখ্যেতা হলে বিয়েতে কেনো মত দিয়েছে?"
রাবেয়ার বুকে তীরের মতো বিঁধলো কথাগুলো। তরুকে পাওয়া গেলো না।রাবেয়া কাঁদতে কাঁদতে কবুল বললো।
কি অদ্ভুত অনুভূতি!
তরুর বাবার সাথে বিয়ের দিন ও কবুল বলার সময় রাবেয়া কেঁদেছিলো অথচ সেদিনও আজকের মতো কষ্ট হয় নি রাবেয়ার।আজকে যেমন মনে হচ্ছে এই বুঝি নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে তার।
তরু বসে আছে ফাইজানের রুমে।ফাইজান নিচে উঠানে প্যান্ডেলে মেহমানদের খাওয়ার ওখানে ব্যস্ত। তরুকে সবার কাছ থেকে লুকাতে এখানে এনে বসিয়ে রেখেছে আমেনা।কেননা আলমগীরের ভয় রাবেয়া তরুকে দেখলে দুর্বল হয়ে পড়বে।
আর এর চাইতে নিরাপদ জায়গা নেই।এখানে কেউ তরুকে খুঁজবে না।
আমেনা তরুকে বললো, "তরু,তুই যদি চাস তোর মায়ের বিয়েটা সুন্দর করে হোক,ঝামেলা ছাড়া তাহলে এখানে বসে থাক কিছুক্ষণ। বের হবি না।তুই ওখানে থাকলে পাত্রপক্ষ নানা রকম কথা বলতে পারে। তোর মায়ের সংসার সুখের করতে হলে তোকে এখানে লুকিয়ে থাকতে হবে কিছুক্ষণ। "
তরু চাচীর কথায় রাজি হলো। আমেনা তরুকে এখানে রেখে বাহিরে থেকে তালা লাগিয়ে দিলো দরজায়।যাওয়ার সময় বলে গেলো আধাঘন্টা /এক ঘন্টা পরে এসে দরজা খুলে দিবো।তোর মায়ের কবুল বলা পর্যন্ত তুই আড়ালে থাকিস।
রাবেয়া বারবার নিজের ভাই বোনদের বললো তরু কই,ওকে ডাকেন।
কেউ অতটা আগ্রহ নিয়ে তরুকে খুঁজলো না বরং সবাই খুশি হলো তরু না থাকায়।তরুকে দেখলে রাবেয়া কান্নাকাটি করে সিনক্রিয়েট করবে।সবাই চায় সুন্দর ভাবে সমাধান হয়ে যাক।
সত্যি সত্যি তরুকে ছাড়াই সব কাজ হয়ে গেলো। রাবেয়া শুধু পাগলের মতো তরু তরু করতে লাগলো।
তরু অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে।কেউ আসছে না।তরু কয়েকবার লতাকে ডাকলো,চাচা কে ডাকলো।কেউ শুনতে পেলো না।বিয়ে বাড়ির এতো চিৎকারের মধ্যে তরুর দুর্বল আওয়াজ কারো কানে যায় নি।
তরুর কেমন বুকের ভেতর পুড়ছে।মা'কে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। অথচ পারছে না বের হতে এখান থেকে। মা'কে কি আজকে তরু একবার দেখতে পারবে না?
বিদায়ের সময় রাবেয়া গলা ফাটিয়ে মেয়েকে ডাকতে লাগলো। ফাইজান অনেকক্ষণ ধরে মনে মনে তরুকে খুঁজছে।কিন্তু দেখছে না।
কাউকে জিজ্ঞেস ও করতে পারছে না তরুর কথা। তরুর মায়ের কান্না দেখে ফাইজানের বুকটা কেমন খালি খালি লাগতে লাগলো। রাবেয়া পাগলের মতো চিৎকার করছে।ছাদে থেকে তরুও চিৎকার করে কাঁদছে মা'কে ডেকে।কিন্তু ভাগ্য ভীষণ নিষ্ঠুর।আমেনা বললো না তরু কোথায় আছে।
সবাই রাবেয়াকে বললো, "এরকম করিও না।মেয়েটা হয়তো মন খারাপ দেখে কোথাও নিরিবিলিতে বসে আছে।সব ঠিক হয়ে যাবে।এসব চিন্তা বাদ দিয়ে তুমি নতুন জীবনের চিন্তা করো।"
তরু কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারালো ফ্লোরে।
মেহমানরা সব বিদায় নেওয়ার পর ফাইজান দম ফেলার ফুসরত পেলো।লতার বাবা নিজেই ফাইজানকে সকালে বিনীতভাবে অনুরোধ করে বললো, "বাবা আমাদের তো কেউ নেই তেমন, তুমি যদি আজকে একটু মেহমানদের খাওয়ার, অন্যান্য সব কিছু দেখা শোনা করতে বড় উপকার হতো আমাদের। তুমি ছাড়া নিজের লোক তো কেউ নেই।"
ফাইজান তাই সকাল থেকেই ব্যস্ত ছিলো। বিকেলে এসে রুমে ঢুকলো। এই তালাটা আমেনার দেওয়া।একটা ছাবি ফাইজানের কাছে অন্যটা আমেনার কাছে।
ভেতরে এসে ফাইজান চমকে উঠে। তরু মাটিতে লুটিয়ে আছে অজ্ঞান হয়ে।
তরু এখানে কেনো?
ফাইজান বুঝতে পারছে না। টেবিলের উপর থেকে পানি এনে তরুর চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলো ফাইজান।তরুর জ্ঞান ফিরলো না।
তরুকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো ফাইজান।হাত পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে তরুর।
সকাল থেকে আকাশ অন্ধকার হয়ে ছিলো। সবাই ভয়ে ছিলো বৃষ্টি আসে যদি।বৃষ্টি এলো বিকেলে।মেহমান বিদায় হওয়ার পর।
ফাইজান রুমের জানালা বন্ধ করে দিলো। দরজাটা খুলে রাখলো ফাইজান।কেউ এলে যাতে কোনো খারাপ কিছু না ভাবে।
সরিষার তেলের বোতল এনে তরুর হাতে পায়ে ম্যাসাজ করলো ফাইজান।কিছুক্ষণ পর তরুরু যখন জ্ঞান ফিরলো তখন চারদিকে অন্ধকার। বিদ্যুৎ ও নেই।
তরু অন্ধকারে লাফিয়ে উঠে বসলো। ফাইজান চেয়ারে বসে ছিলো। মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করতেই তরু ঘাবড়ে গেলো ফাইজানকে দেখে।পরমুহূর্তেই তরু জিজ্ঞেস করলো, "আমার মা কই?"
ফাইজানের বুকটা ভারী হয়ে গেলো এই প্রশ্ন শুনে। তরুর মা তরুকে পাগলের মতো খুঁজেছে।অথচ মা মেয়ে কেউ কাউকে দেখলো না।তরু বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে বের হতে যাবে সেই মুহূর্তে ফাইজান বললো, "আন্টি নেই তরু,নিয়ে গেছে ওনাকে।"
তরুর হাত পা কেমন জমে গেলো শুনে। সেখানেই ধপাস করে বসে গেলো তরু।নিশ্বাস বন্ধ হওয়া যন্ত্রণা বুকে চেপে বললো, "মা নেই?"
ফাইজান এগিয়ে এসে তরুর হাত ধরে বসে পড়লো ফ্লোরে। তারপর নরম স্বরে বললো, "নিজেকে সামলাও তরু।তোমার নিজেকেই নিজের অভিভাবক হতে হবে। তুমি সাহসী মেয়ে তরু,এভাবে ভেঙে পড়ো না তুমি। "
তরুর দুই চোখ দিয়ে শ্রাবণের ধারা বইতে লাগলো। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে তরুর।মা নেই?
মা চলে গেছে? এই বিশ্ব সংসারে তরুর আর কেউ নেই আজ থেকে?
তরুর মা ও নেই বাবা ও নেই।তরু এতিম!
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো তরু।ফাইজান কোনো কিছুর পরোয়া না করে তরুর মাথাটা নিজের কাঁধে টেনে নিয়ে বললো, "ভেঙে পড়ো না তরু,কে বলেছে তোমার কেউ নেই?তোমার মা আছেন।তোমার আমি আছি।তুমি চাও আর না চাও তরু,তরু তুমি আমার। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।ভয় পেও না তরু।মনে সাহস রেখো।তুমি নিজেই চেয়েছো আন্টির জীবনটা সুন্দর হোক।তোমার এই চোখের পানি দেখলে কি আন্টি ভালো থাকবেন?
তুমি তো সাহসী মেয়ে তরু।সাহসী মেয়েরা সব সময় বুকে সাহস রাখে।"

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

 Follow Now Our Google News

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

১০ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা রাজিয়া রহমান বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহন করেন। লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন তিনি। তরুণ এই লেখিকা বৈবাহিক সূত্রে লক্ষ্মীপুরেই বসবাস করছেন। বর্তমানে তিনি একটি পুত্র সন্তানের জননী। পেশাগতভাবে তিনি গৃহিনী হলেও লেখালেখির প্রতি তার ভিষন ঝোক। আর তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও শখের বশে ধারাবাহিকভাবে লিখে যাচ্ছেন একের পর এক উপন্যাস। ২০২২ সালের মধ্যদিকে গর্ভকালিন সময়ে লেখিকা হিসেবে হাতেখড়ি নিলেও এরই মধ্যে লিখে ফেলেছেন “তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর” ও “শালুক ফুলের লাঁজ নাই” -এর মতো বহুল জনপ্রিয় উপন্যাস।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন