উপন্যাস        :         আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখিকা        :          নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ             :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ ইং

লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আজ ওদের মন ভালো নেই” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা


১৬ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব -১৭ )


ধূসর আঁধার কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটেছে। মিথির ভেজা বসন শুকিয়ে গিয়েছে গায়ের উত্তাপে। শুভ্র মুখটা মূর্তির মতো স্থির। হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, ভোরকে চমকে দেবে বলে, আধো আলো আধো অন্ধকারে কেউ স্থাপন করেছে কোনো মোহনিয়া প্রতিমা। ইট-পাথরের দালান ফাঁকি দিয়ে আসা ফিনফিনে হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছে তার শুষ্ক, অবিনস্ত চুল। জানালার কাছে একটা কৃষ্ণ কাক ভোরের ঘুম ভাঙাতে গলা তুলতেই নড়ে উঠল সেই মূর্তি। কী এক ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠে এসে দাঁড়াল ঘরের একমাত্র আয়নার সম্মুখে। গভীর চোখে দেখল নিজেকে। সাথে সাথেই অবর্ণনীয় এক ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গেল মুখ। শয্যার পাশে গুছিয়ে রাখা এন্টিকের ফুলদানিটা তুলে নিয়ে নির্লিপ্তমুখে ছুঁড়ে মারল আয়নায়, ঠিক নিজের মুখ বরাবর। নিষ্পাপ আয়না মিথির প্রতিচ্ছবি হয়েই যেন ভেঙে পড়ল তীক্ষ্ণ ঝনঝন শব্দ তুলে। পৃথিবী দেখল কাচ। কেবল মিথি দেখল, কাচ নয়। আয়নার সাথে ভেঙে পড়ল তার সমস্ত আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান আর সরল একটা হৃদয়।
‘ কী করছিস কী? কী হয়েছে তোর?’
দরজার কাছ থেকে ভেসে এলো বড় খালামণির ভীত কণ্ঠ। স্থূল শরীরের অতিকায় মানুষটির মুখখানা শুকিয়ে গিয়েছে আতঙ্কে। মিথি কাল রাত ভোর করে বাড়ি ফিরেছে। অতো রাত করে মিথি কখনও ফিরে না। মা’হারা মিথির মুখে-চোখেও তিনি দেখেছেন সব হারানোর ছাপ। তারপর থেকে নানান ধরনের দুশ্চিন্তা অস্থির করে তুলছে তাকে। ঘুমুতে পারছেন না। তিনি শুনেছেন এসব নাটক-সিনেমার মানুষ খুব একটা ভালো হয় না। তাদের চরিত্রে একশো একটা গন্ডগোল। মিথির সাথে তেমন কিছু হয়নি তো? আতঙ্কে গলা শুকিয়ে আসে তার। দ্বিধান্বিত হয়ে মিথির সারা গায়ে চোখ বুলান। মিথি ঘাড় ফিরিয়ে খালামণির দিকে তাকায়। সহজ কণ্ঠে বলে,
‘ আয়নাটা ভেঙে গেল।’
‘ভেঙে গেল?’ নাকি ‘ভেঙে ফেলা হলো?’ প্রশ্নটা করার সাহস পান না সরদা। সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বলেন,
‘ আয়না ভাঙার জিনিস ভাঙবেই। ওসব আয়না ফায়না নিয়ে চিন্তা করিস না। তোর খালুকে বলে আজকেই নতুন একটা আনানোর ব্যবস্থা করব।’
মিথি কঠিন কণ্ঠে বলল,
‘ না।’
‘ না। না কেন? মেয়ে মানুষ তুই। আয়না ছাড়া চলবে তোর?’
‘ চলবে। না চললে আমি নিজেই কিনব। তোমাকে সেই কষ্ট করতে হবে না।’
সরদা ব্যথিত চোখে ভগ্নীকন্যার দিকে তাকালেন। মন খারাপ করে বললেন,
‘ তোকে আমি একটা ড্রেসিং টেবিলও কিনে দিতে পারব না?’
মিথি কঠিন কণ্ঠে বলল,
‘ না। পারবে না। এই পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা ব্যতিত কারো দয়া নিতে আমি প্রস্তুত নই। মাঝে মাঝে মনে হয়, সৃষ্টিকর্তার দয়ারই বা কী দরকার? তিনি আজ পর্যন্ত কম দয়া তো আমাকে করলেন না?’
শেষ বাক্যটিতে ঝরে পড়ল শিশির বিন্দুর মতো অন্যরকম এক বিষণ্ণতা। সরদা সে বিষণ্ণতা লক্ষ্য করলেন না। বললেন,
‘ দয়া? আমি তোকে দয়া করবার কে রে? মায়েরা বুঝি দয়া করে? মায়েরা ভালোবেসে দেয়।’
‘ তুমি তো আমার মা নও।’
চাবুকের মতো তীক্ষ্ণ উত্তর দিল মিথি। শক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ যা আমার না। তার সদৃশ কিছু একটা পেয়ে খুশি হতে চাই না আমি খালামণি। ভালোবাসা একটা ফালতু কনসেপ্ট। আমি চাই না, পৃথিবীর কেউ আমাকে ভালোবাসুক। মায়া করুক। দয়া করুক। পৃথিবীর চরম নির্মমতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে চাই আমি। তারপর সগর্বে ঘোষণা করতে চাই, তোমরা আমার কেউ না। আই সারভাইভড্ অল এলোন।’
কথা শেষ করে থামল মিথি। কিছু একটা ভেবে বলল,
‘ তবে তুমি আমার জন্য যতটুকু করেছ তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ খালামণি। থেংকিউ ভেরি মাচ। আমি ভাবছি, আগামী মাস থেকে এই ঘরে থাকবার আর খাবার ভাড়া দিব আমি। টোটাল এমাউন্ট কত হবে বল তো খালামণি?’
সরদার মনে হলো মেয়েটা অতিরিক্ত আঘাতে উম্মাদ হয়ে গিয়েছে। চিন্তা-ভাবনায় স্থিরতা নেই। আবোলতাবোল বকছে। তিনি ঠান্ডা মাথায় প্রথমেই আসন্ন বিপদের কথা ভাবলেন। ইতস্তত করে বললেন,
‘ মিথি? তোর কোনো মেডিক্যাল হেল্প লাগবে? এই ধরনের ঘটনার পর এই ইস্যুটা নিয়ে সবার আগে চিন্তা করতে হয়। যদি একটু উনিশ-বিশ হয়ে যায় তাহলে…’
মিথি স্থির চোখে সরদার দিকে তাকাল। খালামণি যা ভাবছেন কাল রাতে নিজের সঙ্গে এমনই কোনো দুর্ঘটনা মনেপ্রাণে চেয়েছিল মিথি। সাব্বিরের ওই প্রত্যাখানের পর নিজের কাছে নিজেকে এতোটাই নোংরা ঠেকছিল যে বারবার মনে হচ্ছিল আরও নোংরা কিছু ঘটুক। এতোটা নোংরা যে মিথির মনের অপবিত্রতাকে খণ্ড বিখণ্ড করে দিক। এইযে নিজেকে এতো ছোট করল, নিচে নামাল, নষ্ট করল তার একটা কঠিন শাস্তি মিথির প্রয়োজন। অথচ বিধিবাম! ওমন মধ্যরাতে একলা মিথি নিজেকে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দীর্ঘক্ষণ রাস্তা ধরে হাঁটল। উবার করে কলাবাগান থেকে মীরপুর এলো। অথচ কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না। কেন ঘটল না? মিথির ওই নির্লজ্জতা, ওই অপমান বুঝি ওর চেহারায় ল্যাপটে দিয়েছে কেউ? তার দিকে তাকালেই বুঝি সকলেই বুঝে যাচ্ছে, মিথি কত নিকৃষ্ট! কত নির্লজ্জ! যারা রাস্তার ধারে এলোমেলো হয়ে শুয়ে থাকা উম্মাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না, মিথি বুঝি তাদের থেকেও নীচ? জঘন্য? ছিঃ! মিথি থমথমে কণ্ঠে বলে,
‘ বুয়াকে একটু গরম পানি করে দিতে বলবে খালামণি? আমি আজ দীর্ঘসময় নিয়ে গোসল করব। কতটা সময় গোসল করলে শরীরের সাথে সাথে মনটাকেও ধুয়ে কচলে পরিষ্কার করা যাবে বল তো?’
____________
সকালে মৌনির ঘুম ভেঙেই ভয়ংকর মন খারাপ হয়ে গেল৷ গত রাতে সে সারারাত জেগেছে। ঘুমুতে গিয়েছে ভোরের আলো ফোটার পর। ভোর করে ঘুমুতে গেলে মৌনি সাধারণত অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। আশ্চর্য কারণে, আজ আটটা বাজতেই ঘুম ছুটে গেল। চোখ মেলে বাইরের রৌদ্রময়ী রূপ দেখে হঠাৎ করেই বুকের ভেতরটা কেমন অস্থির করে উঠল। মনে হলো, কে যেন কোথায় ভালো নেই। কার যেন খুব দুঃখ। তার বোধহয় মৌনিকে প্রয়োজন। মৌনি মেঘাচ্ছন্ন মন নিয়ে বিছানায় উঠে বসল। অজ্ঞাত কারো জন্য তার আকাশ ভেঙে কান্না পাচ্ছে। কার এতো দুঃখ? কে এতো দুঃখ পাচ্ছে? মৌনির একবার শাওনের কথা মনে পড়ল। গত সাতদিন ধরে ছেলেটার কোনো খোঁজ খবর নেই। কোথায় হারিয়েছে কে জানে? যেখানেই হারাক। সে এখন কেমন আছে? তার কী ভীষণ মন খারাপ? মৌনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে নিতেই দেখল, মিষ্টির অজস্র কল। মৌনি বুকের ভেতর অস্থিরতা অনুভব করল। মিষ্টির কিছু হয়নি তো? তৎক্ষনাৎ কল ব্যাক করতেই ওপাশ থেকে রিনরিনে কণ্ঠে এক পশলা অভিমান ভেসে এলো,
‘ আমার এত্তো জ্বর। আর তুই ফোনই ধরলি না। আমার মন খারাপ হয়েছে। তোর সাথে ব্রেক আপ।’
মৌনি কণ্ঠে নিঁখুত দুঃখ ফুটিয়ে বলল,
‘ ইশ! আই এ্যাম সোওওও সরি, জান। ঘুমুচ্ছিলাম। জ্বর কী করে বাঁধালি? ঔষধ নিয়েছিস?’
‘ হু। নিয়েছি। কিন্তু কমছেই না। ভাবছি বাড়ি যাব। আম্মু ওদিকে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। শোন, আম্মু যদি তোকে কল করে বলবি, আমার জ্বর আন্ডার কন্ট্রোল। তুই নিজে ঔষধ খাইয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছিস। নয়তো আম্মুকে তো চিনিস? সব ফেলে আমাকে নিতে চলে আসবে। এই গরমে জার্নি আম্মুর পোষাবে না।’
মৌনি ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ তারমানে জ্বর আন্ডারকন্ট্রোল না?’
‘ একশো তিন আর চার-এ আপডাউন করছে। তুই এখন অস্থির হয়ে যাস না। আমি ঠিক আছি। একটু পর ময়মনসিংহের বাস ধরব।’
মৌনি একবার বাইরের আবহাওয়া দেখল। মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ এই রোদে একা তোকে আমি এলাউ করব না। নির্ঘাত সেন্স হারিয়ে পড়ে থাকবি। আমি আসছি। বেশি পাকনামো করবে না তুমি। তোকে আমি ময়মনসিংহ দিয়ে আসব।’
মিষ্টি তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘ দূর! এই গরমে অযথা তোকে আসতে হবে না। মাইগ্রেনের যন্ত্রণায় ভুগবি। আমি নাহিদকে বলব ভাবছি, ও যাবে সাথে।’
‘ তুই শিওর?’
‘ হান্ড্রেড পার্সেন্ট। শোন না, তোকে আমি ফোন করেছি অন্য কারণে।’
‘ কী কারণ?’
‘ বাড়ি যাচ্ছি, বল তোর কী খেতে ইচ্ছে করছে? সাথে আনব।’
‘ এই অসুখ-বিসুখের সময় তোকে আমার ক্রেভিংস নিয়ে ভাবতে হবে না।’
‘ একশোবার ভাবব। বল তুই।’
মৌনি আকাশ-পাতাল ভেবে বলল,
‘ আমের আচার৷’
‘ ঝাল না মিষ্টি?’
মৌনি দুষ্টুমি করে বলল,
‘ আমি তোমাকে ভালোবাসলেও। খাওয়ার বেলায় ঝালকেই বেশি প্রায়োরিটি দিই ডার্লিং।’
মিষ্টি হেসে ফেলল। মৌনি তার মনের অস্থিরতা চাপতে না পেরে শুধাল,
‘ তোর মন ভালো মিষ্টি?’
মিষ্টি অবাক হয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ। কেন?’
মৌনি অন্যমনস্ক কণ্ঠে বলল,
‘ আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কেউ খুব কষ্ট পাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। কে এতো কষ্ট পাচ্ছে বল তো?’
মিষ্টি সে কথার উত্তর দিতে পারল না। মিষ্টির সাথে কথা বলে সারাটাদিন বিষণ্ণ কাটল মৌনির। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক হাসফাস। মনে হলো, সবাইকে একবার করে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? পরমুহূর্তেই ভাবল, কতজনকে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে ও? কোনো উপায় না পেয়ে সমস্ত দিন মৌনি ক্রমাগত প্রার্থনা করে গেল,
‘ সবার মন ভালো হয়ে যাক। সবার মন ভালো হয়ে যাক। প্লিজ!’
_____________
কাওরান বাজারের একটা সংবাদপত্রের অফিসে বসে আছে নাহিদ-সৌধ। সৌধর মন যথেষ্ট খারাপ। তার মনে হচ্ছে তাদের সমস্ত কষ্ট বৃথা যাবে। শেষ পর্যন্ত তাদের এই নিবন্ধটা কোথাও প্রকাশ করা যাবে না। তাদের কাছে যে তথ্য উপাত্ত আছে তা অতিমাত্রায় ভারী। এগুলো প্রকাশ পেলে ব্যবসায়ী মহলে একটা বিস্ফোরণ ঘটে যাবে৷ সরকার পরোক্ষভাবে চলে যাবে ব্যবসায়ীদের পক্ষে। সরকারের উত্থান পতনের পেছনে থাকা বাঘা বাঘা ব্যবসায়ীদের বেজার করতে চাইবে না সরকার। সাহস নিয়ে কোনো সংবাদপত্র এগিয়ে এলেও এর পরবর্তী ধকল সামলে উঠতে পারবে না। মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভবনাই প্রবল। এতোকিছু জানার পর কোনো সংবাদপত্র নেচে নেচে তাদের আর্টিকেল ছাপাবে না। এর আগে যে খবরের কাগজে কাজ করতো সেই সম্পাদক নরম-সরম ধাক্কা দেওয়ার মতো কোনো নিউজ চাচ্ছিলেন। কিন্তু নাহিদ যে কেঁচো খুঁড়ে সাপ তারও নিচে গিয়ে একেবারে অজগর টেনে বের করে আনবে তা তিনি প্রত্যাশা করেননি। অবশ্য তাকে দোষ দেওয়াও যায় না। নাহিদ কী জিনিস তা তো সৌধ ছাড়া আর কেউ জানে না। নাহিদকে অবশ্য খুব একটা দুঃখী মনে হচ্ছে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মন যথেষ্ট ফুরফুরে। মাত্রই কোটি টাকার টেন্ডার পেয়ে গেলে যে রকম ফুরফুরে হতে পারে সেই রকম ফুরফুরে। নাহিদ-সৌধর সামনে বসে থাকা আদিব হোসেন মনোযোগ দিয়ে তাদের নিবন্ধটা দেখলেন। তারপর অনেকক্ষণ মুখ গম্ভীর করে বসে থেকে বললেন,
‘ এই নিবন্ধটা কেবল আমি কেন? কোনো খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনই নিবে না। তোমাদের বয়স অল্প তাই বুঝতে পারছ না, সংবাদপত্রে খুব সত্য কথা লিখতে হয় না।’
নাহিদ শুধাল,
‘ যদি এমনই হয়, তাহলে সাংবাদিকতা পড়ার প্রয়োজন কী? সংবাদপত্রেরই বা প্রয়োজন কী? আপনারা সবাই ভণ্ডামির উপর সত্যবাদীর মুখোশ পড়ে চোখ-মুখ গম্ভীর করে বসে থাকার থেকে জনগনকে সরাসরি বলে দিলেই পারেন, আপনাদের এজেন্ডা হলো মুখরোচক মিথ্যা উৎপাদন করা?’
সৌধ পাশ থেকে ইশারায় নাহিদকে থামানোর চেষ্টা করল। আদিব হোসেন থমথমে মুখে নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চেহারা দেখে বুঝা না গেলেও এই ছেলের হিম্মত দেখে তিনি বেশ চমৎকৃত। বললেন,
‘ তোমার নামটা যেন কী?’
প্রথমে একবার নিজের নাম বলেছে নাহিদ। দ্বিতীয়বার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। আদিব হোসেন নাহিদের মনোভাব বুঝতে পেরে মনে মনে হাসলেন। বললেন,
‘ নাহিদ! মনে পড়েছে। শুনো নাহিদ, এই দেশটা চলছেই ভণ্ডামির ওপর। এই দেশের সরকার থেকে জনগন সব ফ্রড। শতভাগ সত্য দিলে ফরমালিন খেয়ে বেঁচে থাকা জাতির তা সহ্য হবে না। তাদের কাছে সহনীয় করার জন্যই সত্যের সাথে মেশাতে হবে মুখরোচক মিথ্যা।’
নাহিদ চোয়াল শক্ত করে বলল,
‘ গোটা একটা জাতি ভণ্ড বলে আমিও ভণ্ড হব। এমন কিছু আমি নিজের থেকে এক্সপেক্ট করি না। আমি যা করি সব খোলাখুলি। মিথ্যাও বলি খোলাখুলি, সত্যও বলি খোলাখুলি। খারাপ কিছু করলে সেটাও স্পষ্টভাবে খারাপ ভেবেই করি। খারাপের উপর ভালোর পট্টি পরানোর চেষ্টা আমার মধ্যে নেই। এইযে এই নিবন্ধ আমি তৈরি করেছিলাম দেশের মানুষের উপকারে। তাদের হজম হলো না। গ্রেট! আমি এখন এই তথ্য এমন কারো কাছে বিক্রি করব। যাতে জনগণ, সরকার উভয়ই কেঁদে কূল পাবে না।’
আদিব হোসেন চমকালেন। নাহিদ নামের ছেলেটির ভেতর আগুন আছে। অল্প বয়সী ছেলে সেই আগুন নিয়ে খেলছে অল্প বয়সী আবেগের তাড়নায় পড়ে। তিনি বললেন,
‘ কী করবে তুমি?’
নাহিদ উত্তর না দিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল। আদিব হোসেন বললেন,
‘ দেশের ক্ষতি হবে জেনেও তুমি এমন কোনো কাজ করবে? আমি তোমাকে এতক্ষণ পুরোদস্তুর দেশ ভক্ত ভাবছিলাম।’
নাহিদ হেসে ফেলল,
‘ নিজে জনগনের ইমোশনের উপর টাকার গাড়ি বসিয়ে অন্যজনকে দেশ ভক্ত ভাবেন কী করে? আর সেটা মিথ্যা হলে হতাশই বা কেন হোন বলুন তো? আপনারা কী ভাবেন? আপনারা বসে পেটের ভুঁড়ি বাড়াবেন। আর বাকি সবাই দেশভক্তির উপর রচনা লিখবে? এতোটা নিষ্পাপ আপনাকে ভাবিনি স্যার।’
আদিব হোসেন কিছু বললেন না। নাহিদ মাথাটা এগিয়ে এনে নিচু কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি আমাকে এখনও ঠিক বুঝতে পারেননি । আমি সম্পূর্ণ গ্রে শেডের মানুষ। আমি প্রাণখোলে ভালোবাসব। ভালোবাসার বদলে ঘৃণা পেলে ঘৃণার উপর ভয় তৈরি করার মতো ঘৃণা উপহার দেব। উপকার করতে চাইব। না নিলে নিজের স্বার্থ দেখে অপকার করতে আমার হাত কাঁপবে না। মূর্খ জনতার যদি সত্য খেয়ে পেট খারাপ হয় তাহলে ফরমালিনের পরিমাণ আরেকটু বাড়িয়ে দেওয়াই শ্রেয়, কী বলুন? এতে পরিশ্রমও কম।’
আদিব সাহেব উত্তর দিলেন না। নাহিদ নামক ছেলেটার মধ্যে যে আগুন তিনি দেখছেন। সে আগুন বিপদজনক, ক্রূর, নিষ্ঠুর। তিনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ বসে থেকে থমথমে কণ্ঠে বললেন,
‘ তোমরা এখন আসতে পারো।’
নাহিদ বিনাবাক্য ব্যয়ে উঠে দাঁড়াল। অফিস থেকে বেরিয়ে আসতেই সৌধর রোষের মুখে পড়তে হলো। সৌধ রাগারাগি করে চোখ-মুখ লাল করে ফেলে বলল,
‘ কী দরকার ছিল ওমন করে কথা বলার? ব্যাটাকে দেখেই মনে হচ্ছে হেব্বি ক্ষেপেছে। কেন তুই সবার সাথে শত্রুতা করছিস বল তো? এমনিতেই মরণ নাচছে মাথার ওপর। এতোটা বেপরোয়া হওয়াও উচিত না নাহিদ৷’
নাহিদ প্রত্যুত্তরে একটা সিগারেট ধরাল। একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে বলল,
‘ চল নীলক্ষেত যাই। স্বপ্নের মর্মার্থ টাইপ কোনো বই পাওয়া যায় কি-না দেখি।’
সৌধ আগের রাগ ভুলে গিয়ে আগ্রহ নিয়ে বলল,
‘ স্বপ্নের মর্মার্থ দিয়ে তুই কী করবি? স্বপ্নবাবা হয়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছিস না তো? পরিকল্পনা অবশ্য খারাপ না। বড় বড় দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে টিএসসিতে বসবি। পেছনে একটা সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকবে, এখানে স্বপ্নের অর্থ বিশ্লেষণ করা হয়।’
নাহিদ বলল,
‘ একটু কারেকশন। সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে, এখানে সুন্দরীদের স্বপ্নের অর্থ বিশ্লেষণ করা হয়। পুরুষ মানুষের স্বপ্ন নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। পুরুষ মানুষ আমার দু'চোখের বিষ। আচ্ছা, ঢাকা শহরের সব পুরুষকে হেমলক খাইয়ে মেরে দিয়ে কেবল রমণীদের শহর বানিয়ে দিলে কেমন হয় বল তো? চারদিকে কেবল থাকবে পূর্ণযৌবনা ললিতা।’
সৌধ হেসে ফেলল,
‘ এতো রমণীকে প্লিসড করতে পারবি তুই?’
‘ কেন তুই আছিস না? হেল্প করবি।’
সৌধ চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ দরকার নেই ভাই। পুরো শহরে কেবল দুটো পুরুষ বেঁচে থাকলে রমণীদের হাতে তাদের কী রকম বলি হতে হবে ভেবেই আমার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার থেকে আমি হেমলক খেয়ে নিব ভাই।’
নাহিদ হাসল। সৌধ বলল,
‘ আমরা কী সত্যি সত্যি স্বপ্ন বিষয়ক বই কিনতে যাচ্ছি নাকি?’
‘ হু।’
সৌধ অবাক হয়ে বলল,
‘ কেন? হঠাৎ তোর স্বপ্নের প্রতি ইন্টারেস্টেড হওয়ার কারণ কী?’
নাহিদ হতাশ কণ্ঠে বলল,
‘ কারণ ভয়াবহ। দুইদিন ধরে রাতে ঘুমুতে পারছি না বুঝলি? স্বপ্নে একটা বাচ্চা খুব জ্বালাচ্ছে।’
সৌধ অবাক,
‘ বাচ্চা!’
‘ হু। প্রতিদিন ঘুমটা গাঢ় হলেই বেয়াদবটা এসে হাজির। তারপর শুরু হবে একই জিনিস নিয়ে পকপক। এতো বাস্তব স্বপ্ন আমি আগে কখনও দেখিনি।’
‘ কী জিনিস নিয়ে কথা বলে?’
‘ তার মা সম্পর্কিত বিষয়।’
সৌধ অবাক,
‘ তার মা সম্পর্কিত বিষয়ে তোর সাথে আলোচনা করার কারণ কী? এই পুচকে পোলা তোর সাথে স্বপ্নে স্বপ্নেই তার মায়ের বিয়ে দিতে চায় নাকি?’
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ পোলাটাই আমার। সর্বক্ষণ বাবা বাবা বলে ডাকে। মনটা চায় দিই একটা চটকানা। আমার বিয়ের বয়স হয়েছে বল? আর তার উপর নাকি বাপ? আমার স্ট্রোক হয়ে যাবে একদিন।’
যেন বাচ্চাটা বাস্তব। এমনিই করে বুদ্ধি দিল সৌধ,
‘ তুই তারে বল, প্রমাণ কী আমি তোর বাপ? তুই এখনও পিওর ব্যাচেলর। প্রয়োজনে ডিএনএ টেস্টের ব্যবস্থা করা হবে। মগের মুল্লুক নাকি?’
নাহিদ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘ ডিএনএ টেস্টের দরকার হবে না। চেহারায় আমার ফটোকপি। চোখটা শুধু ওর মায়ের মতো।’
সৌধ অবাক হয়ে বলল,
‘ স্বপ্নে ওর মাকেও দেখছিস নাকি?’
‘ না। শুধু বাচ্চা।’
‘ তাহলে বুঝলি কী করে মায়ের মতো চোখ? মিষ্টির মতো নাকি?’
নাহিদ চিন্তায় পড়ে গেল। ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ সেটা তো জানি না। আমার সব মেয়ের চোখ একই রকম লাগে। কিন্তু স্বপ্নে আমি ঠিক বুঝতে পারি বাবুনের চোখদুটো ওর মায়ের মতো। চোখ ভর্তি অভিমান।’
সৌধ চিৎকার করে উঠে বলল,
‘ ও মাগো! নামও ঠিক করে ফেলেছিস দেখছি?’
নাহিদ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘ পরপর কয়েকদিন স্বপ্নে আসছে। ধমক দেওয়ার জন্যও তো নাম দরকার? নিজের ছেলেকে তো আর এই ছেলে এই ছেলে বলে ডাকা যায় না?’
সৌধ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ ছেলের স্বীকৃতি তো দিয়েই ফেলছ মামা। এখন আর স্বপ্নের বই দিয়ে কী করবা?’
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমার মনে হচ্ছে, এই স্বপ্নগুলোর কোনো অর্থ আছে। এমনও তো হতে পারে মস্তিষ্ক আমাকে কিছু বলতে চাইছে। ছেলে ব্যাপারটা আসলে কোন পিন কোড?’
______________
বাহিরের তীব্র দাবদাহের মতোই আগ্নেয়গিরির উত্তাপ ছড়াচ্ছে সাব্বিরের গা। গতকাল রাতের জ্বরটা বেড়েছে। জ্বর বেড়ে সবচেয়ে বেশি যে ঝামেলাটা হচ্ছে তা হলো, হিলুস্যিনেশন। মিথির সাথে তার কয়েক ঘন্টার সংসারটা জ্বরের কারণেই বোধহয় মস্তিষ্কে একেবারে সেঁটে বসেছে পোস্টারের মতো। মিথিহীন ঘরদোর অসহনীয় শূন্য লাগছে। মনে হচ্ছে, অনেক বছরের অভ্যস্ত বাস ছেড়ে হঠাৎ চলে গিয়ে সাব্বিরকে একেবারে একলা করে দিয়ে গিয়েছে মিথি। অথচ, সাব্বিরের কত যুগের একলা বাস! আবার মাঝেমাঝেই মিথির গায়ের মিষ্টি গন্ধটা নাকে লাগছে। মনে হচ্ছে, মিথি যেন আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দু'বার রান্নাঘরে বাসন নাড়ার আওয়াজ পেল। অথচ বুয়া কোন সকালে রান্না সেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। কয়েকবার শাড়ি গোছানোর আওয়াজ পেলো। একবার বারান্দায় মিথির সেই শীতল স্পর্শও টের পেলো কপালের ওপর। এতো স্পষ্ট সেই স্পর্শ! সাব্বির চমকে চোখ মেলার পর দেখল কোথাও কেউ নেই। হিল্যুসিনেশন। এই মিথিহীনতা নাকি মিথিময় হিল্যুসিনেশন কোনটার প্রভাবে কে জানে! দুপুরের পর সাব্বিরের জ্বর ভয়ংকর বেড়ে গেল। বাড়ল হিল্যুসিনেশনের দাপটও। চোখ বন্ধ করলে কেবলই মনে হতে লাগল মিথি সেদিনের মতোই গভীরভাবে চুমু খাচ্ছে তার ঠোঁটে। জ্বরের দাপটে সাব্বির মিথিকে মাথা থেকে সরাতে না পেরে এক সময় কাল্পনিক মিথির সাথেই টুকটাক গল্প শুরু করল। চোখ বন্ধ করে মনে মনে চলল সেই গল্প। সাব্বির বলল,
‘ মিথি? আপনি কী খুব রাগ করেছেন?’
‘ করা কী উচিত নয়?’
সাব্বির বলল,
‘ নিশ্চয় উচিত। অবশ্যই উচিত। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে এতেটা আঘাত করতে চাইনি।’
মিথি অভিমানী কণ্ঠে বলল,
‘ সেটার প্রকাশ তো দেখলাম না? এতো বড়ো একটা কাণ্ড ঘটিয়ে একবারও ক্ষমা চেয়েছেন আমার কাছে? উল্টো ফেলে চলে গেলেন।’
‘ সরি মিথি। আই এম এক্সট্রিমলি সরি।’
মিথির কপট রাগ,
‘ এমন ঠুনকো সরি আমার চাই না।’
সাব্বির উতলা হয়ে বলল,
‘ তাহলে কীভাবে সরি হব? আবার ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটাব? আপনার জায়গায় আমি? আমাকে ছুড়ে ফেলুন নাহয় আপনি? তবে হবে মিথি? আপনার রাগ কমবে?’
‘ কমবে।’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাব্বির অনুভব করল তার কপালে শীতল হাতের স্পর্শ। সাব্বির চমকে চোখ মেলে তাকাল। অবাক হয়ে দেখল, মিথির গম্ভীর মুখ। শাড়িতে স্নেহময়ী মিথি কী অভিমান নিয়েই না তাকিয়ে আছে তার দিকে! সাব্বিরের প্রথমে বিশ্বাস হতে চাইল না। জ্বরের তাপে চোখ বুজে আসছে। সাব্বির অর্ধ বোজা চোখে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ মিথি আপনি সত্যি এসেছেন? আমি ভেবেছিলাম, আপনি আর কখনও আসবেন না।’
মিথি প্রত্যুত্তরে মুখটা নিচু করে সাব্বিরের কাছাকাছি আনল। তারপর আবার দূরে সরে গেল৷ সাব্বিরের মনে হলো, মিথি রাগ করে ফিরে যাচ্ছে। প্রায়শ্চিত্ত না নিয়ে কী কেউ ফিরে যায়? সাব্বির তপ্ত হাতে খপ করে ধরে ফেলল মিথির হাত। দুর্বল হাতে কাছে টানল তাকে। বউয়ের কল্পনায় বিভোর সাব্বির যদি জানতো, ‘এ তার মিথি নয়। তার প্রণয় পিপাসায় অস্থির বৃষ্টি।’
______________
ঢাকায় রোদের তেজ বাড়লেও চট্টগ্রামে ঝরছে শীতল বৃষ্টিধারা। সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। আজকের ট্রেনিংয়ের সাময়িক সমাপ্তি। শাওন ডরমিটরির ভারী টেবিলের সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। সামনে সাদা কাগজ। সেখানে সে গোটা গোটা অক্ষরে লিখল,
‘ মন, তুমি কেমন আছ? আমাকে কয়েক সেকেন্ডের জন্যও কী তোমার মনে পড়ছে? আমার মনে পড়ছে। আমি থাকতে পারছি না। থেকে থেকে দমবন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, এখানে আসা আমার উচিত হয়নি। এভাবে বোধহয় ট্রেনিং শেষ করতে পারব না। আমাকে ফিরে যেতে হবে…’
এটুকু লিখে থমকাল শাওন। চিঠিটা দলিয়ে মুচড়িয়ে ফেলে দিল ময়লার ঝুড়িতে। এখানে তার বেসিক ট্রেনিং শুরু হয়েছে। মোবাইল, ডিভাইস সব জমা। কথা বলার মাধ্যম নেই। অথচ শাওনের প্রাণ খাঁ খাঁ করছে মৌনির একটা কথা শোনবার জন্য। চিঠি লিখে পাঠানোর সুবিধা অবশ্য আছে। কিন্তু তাতে কিছু লাভ হবে না। মৌনির কণ্ঠ তো সে শুনতে পাবে না। মৌনির মতো কেউ চমৎকার করে উচ্চারণ করবে না, ‘শাওওওন!’ শাওনের দমবন্ধ হয়ে আসতে চায়। দ্বিতীয় পৃষ্ঠা নিয়ে সে চিঠি লিখতে বসে মায়ের কাছে। মৌনির তাকে মনে করার কারণ নেই। কিন্তু মা বোধহয় দুশ্চিন্তা করছেন। মাকে একটা চিঠি লেখা যেতে পারে। শাওন কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে চিন্তা করল কী লেখা যেতে পারে। তারপর সব গুবলেট লাগিয়ে প্রথম কথাটি লিখল,
‘ মা? এখানে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এখানে আমি থাকতে পারছি না…’
ধ্যুৎ! এমন ডিপ্রেসিং চিঠি মাকে লেখা যাবে না। এমন চিঠি মৌনিকে লেখা যেতে পারে। প্রতিবার হতাশ হয়ে পড়লে শাওন তো ঘুরেফিরে মৌনির কাছেই যায়। প্রেমিকের মতো ভালোবাসা চাইলেও একেবারে দূর দূর করে ফিরিয়ে দেয় না মৌনি। খুব কাছের বন্ধুর মতো এতো কোমল করে কথা বলে, শাওনের মন জুড়িয়ে যায়। যেমন জুড়িয়ে যায় মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে। ঘুরেফিরে আবারও সেই মৌনির চিন্তাতেই আটকে যায় শাওন। উফ! এমন হলে কী করে চলবে? ট্রেনিংয়ের এতোগুলো দিন সে কী করে থাকবে? অসম্ভব! মরে যাবে শাওন। ভাবতে ভাবতে মায়ের কাছে লেখা চিঠিটাও দুমড়েমুচড়ে ফেলল শাওন। ইমাদ অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল তাকে। এবার বলল,
‘ এতো অস্থির হচ্ছ কেন? স্মোক করবে?’
শাওন মাথা নেড়ে বলল,
‘ আমি স্মোক করি না। তুমি আমাকে এখান থেকে পালাতে সাহায্য করবে?’
হতবাক হয়ে গেল ইমাদ। অবাক হয়ে বলল,
‘ পালাবে মানে? কী আশ্চর্য! পালাবে কেন?’
শাওন উত্তর দিল না। ইমাদ বলল,
‘ ট্রেনিং বেশি হার্ড মনে হচ্ছে? এটা প্রথম প্রথম সবারই মনে হয় শাওন। আমারও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে গিভ আপ করে দেওয়া উচিত না। তুমি এই পর্যন্ত আসতে পেরেছ অর্থাৎ তোমার মধ্যে কিছু স্পেশালিটি আছে। ডোন্ট ওয়েস্ট ইট। আর কয়েকটা দিন সময় দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এবারও কোনো উত্তর দিল না শাওন। ইমাদ কিছুক্ষণ তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুধাল,
‘ আর ইউ মিসিং ইউর গার্ল? হোয়াট ওয়াজ হার নেইম? মৌনি?’
শাওন বিষণ্ণ চোখে তাকাল। ইমাদ তার কাঁধ চাপড়ে বলল,
‘ একটা মেয়ের জন্য এতো দুর্বল হওয়া পুরুষ মানুষের সাজে না, ম্যান। সব মেয়েই তো একইরকম। আমি তোমাকে মেয়ে পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।’
‘ আমাকে মৌনি পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো ইমাদ। শুধু মৌনি। ও ছাড়া কোনো নারীকে আমার নারী মনে হয় না।’
ইমাদ ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
‘ তুমি নারীদের দেখতেই শিখোনি বস। সমস্যা নেই। আমি শিখাব। স্মোক করবে?’
শাওন ইমাদের বাড়িয়ে দেওয়া শলাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আমি স্মোক করি না ইমাদ।’
ইমাদ অবাক হয়ে বলল,
‘ স্মোক করো না? কী বল? এখানেও কী ওই মেয়েটির হাত আছে নাকি?’
শাওন একটু তপ্ত হলো,
‘ ডোন্ট কল হার ‘ওই মেয়েটি’। এটা ওর জন্য অপমানজনক। ওর একটা সুন্দর নাম আছে ইমাদ।’
ইমাদ দুই হাত তুলে সেরেন্ডার করার ভঙ্গিমা করে বলল,
‘ ওকে ওকে বস। রেগে যেও না। আই উইল এড্রেস হার রেসপেক্টফুলি। তবে মৌনি কিন্তু তোমায় একেবারে ভেড়া বানিয়ে রেখেছে। গ্রো আপ ম্যান! নিশ্চয় সে সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না বলে তুমি স্মোক করো না?’
শাওন সেকথার উত্তর দিল না। ইমাদ বুঝল তার ধারণাই ঠিক। নীরবতাই সম্মতির লক্ষ্মণ। ইমাদ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
‘ তোমাকে আমি ভেড়া থেকে পুরুষ করব দাঁড়াও। এই একপাক্ষিক ভালোবাসাতে কী মজা আছে বল তো? তুমি তো লাইফের আসল মজাই ধরতে পারোনি শাওন।’
শাওন হতাশ মুখে বসে রইল। ইমাদকে এখন আর তার ভালো লাগছে না। এই পৃথিবীর কাউকে তার ভালো লাগছে না। বুকের ভেতরের প্রতিটি স্পন্দনের সাথে মৌনিকে চাইছে তার মন। এক মাস হয়ে গিয়েছে সে মৌনিকে দেখে না। এক সপ্তাহ ধরে মৌনির সাথে কথা হচ্ছে না। শাওন সিদ্ধান্ত নিলো সে পালাবে। এসব ট্রেনিং ফ্রেনিং তাকে দিয়ে হবে না। অসম্ভব!

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

১৮ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন