উপন্যাস        :         আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখিকা        :          নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ             :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ ইং

লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আজ ওদের মন ভালো নেই” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা


১৭ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব -১৮ )


ইট-পাথরের শহরে এক টুকরো প্রাচীনত্ব শুষে নিয়ে অলস দাঁড়িয়ে আছে সাব্বিরের কলাবাগানের ভাড়া বাড়ি। ঘাস-গুল্মে ছাওয়া এই বাড়িতে সময়ে সময়ে ভেসে বেড়ায় মায়া মায়া সুবাস। গ্রীষ্মের তীব্র রোদও এখানে ছড়ায় আশ্চর্য কাব্যিক ঢঙে। সাব্বিরের জ্বর-ক্লান্ত মন সেই কাব্যে দেখে মিথিকে। ভীষণ দুপুর। ঘরের পর্দারা উড়ছে। ঘরের মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে গ্রীষ্মের রোদ। সাংসারিক কাজে ব্যস্ত মিথির গোলাপি শাড়ির আঁচল খেই হারাচ্ছে বারেবারে। সেই আঁচল কোমরে গুঁজে কপালে, কপোলে খুচরো চুল ল্যাপটে মিথি যখন অতিষ্ঠ হয়ে তাকাচ্ছে। তাকে দেখাচ্ছে কাল্পনিক প্রেমিকার মতো স্নেহময়। কোথায়, কে যেন গমগমে কণ্ঠে আবৃত্তি করছে,
‘ বহুদিন ভালোবাসাহীন, বহুদিন উথাল-পাথাল
বহুদিন কারো হাত পড়েনি কপালে
বহুদিন দু'চোখের অশ্রু কেউ মুছায়নি আর ;
বহুদিন দূর দ্বীপে, বহুদিন একা নির্বাসন —’
কে আবৃত্তি করছে এমন দরদ মাখা কণ্ঠে? কণ্ঠটা সাব্বিরের বড় চেনা। এক সময় সাব্বিরের মনে পড়ে, এ তো তারই কণ্ঠ! এই কবিতাটা তার ভীষণ প্রিয়। তারপরের লাইনটা যেন কী? জ্বর গায়ে ছিন্ন ছিন্ন টুকরো কথা মনে পড়ে সাব্বিরের। কবিতার মতো মোহনিয়া মিথির দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে আরও একটা লাইন,
‘ বহুদিন ভালোবাসাহীন, বহুদিন এলোমেলো।
বহুদিন বুকের ভেতর এই খাঁ খাঁ গ্রীষ্মকাল
দীর্ঘ গুমোট..’
উঁহু। গ্রীষ্মকাল না। সাব্বিরের বড় শীত করছে। তবে কী শীত এলো? ভরা শীতে সাব্বির হাতের মধ্যে অনুভব করে উষ্ণ কর স্পর্শ। কে সেই উষ্ণতা? বসন্ত? না, না। বসন্ত নয়, মিথি। সাব্বির তার হাতের মুঠো আরও শক্ত করে ধরে। হাত ধরেই সে রুষ্ট হয়। এই হাতে কী যেন নেই। মিথি মিথি সুবাসটা ফুরিয়ে গিয়েছে। কার এতো বড় দুঃসাহস সেই মিষ্টতা চুরি করে? জ্বরের ক্লান্তিতে অবসন্ন চোখ বোজেই তীব্র জেদ নিয়ে কাছে টানে সেই হাত। উষ্ণতাটা এবার তার বুক ছোঁয়। তখনই অনেক দূর থেকে কে যেন কথা বলে ওঠে,
‘ বৃষ্টি আপা, আপনে স্যারের ঘরে কী করেন?’
বৃষ্টি! বৃষ্টি নামল নাকি আবার? এমন বৃষ্টি হলে মিথি বাড়ি ফিরবে কী করে? ঘরে কী ছাতা আছে? চিন্তিত হয় সাব্বির।
‘ স্যার না কইছে তার ঘরে আওন নিষেধ। স্যার জ্বরে বহুশ। আপনে কোন আক্কেলে এই ভর দুপুরে স্যারের ঘরে আহেন?’
উফ! এতো কথা কে বলছে? ঘরদোর ভেঙে যাচ্ছে নাকি? মিথি এমনিতেই রেগে আছে। এমন কিচিরমিচির করলে মিথির রাগ ভাঙবে কী করে? সাব্বির চোখ খোলে তাকানোর চেষ্টা করে। অনেক দূরে বেঢপ আকৃতির কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কে যেন? সাব্বির তাকে চিনে। নামটা মনে পড়ছে না। বেঢপদেহী এগিয়ে এলো। ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
‘ স্যার আপনে বৃষ্টি আপার হাত ধইরা আছেন ক্যান? আপামণি জানলে কেমুন রাগ হইব? সুন্দরীদের রাগ হইল আগুনের নাহাল৷ সহজে পানি করনের উপায় নাই।’
সাব্বির কিছুক্ষণ বুয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা যেন চেতনা ফিরে পেল। ধীরে ধীরে ধরে রাখা হাতের মালিকের দিকে তাকিয়ে চমকে গেল। হাত ছেড়ে দিয়ে তড়িৎ গতিতে উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে গেল তার। একহাতে কপাল চেপে ধরে বিষণ্ণ কণ্ঠে শুধাল,
‘ বৃষ্টি তুমি? তুমি এখানে কী করছ?’
বৃষ্টি সাব্বিরের শিয়রের কাছে বসে ছিল। এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আপার কাছে শুনলাম আপনার জ্বর। জ্বরের কারণে সকালের নাস্তাও এটেন্ড করতে পারলেন না। তাই ভাবলাম দেখে আসি। আমি তো আর আপনার বউয়ের মতো অবিবেচক নই। বরের এমন জ্বর রেখে কেউ কাজে যায়?’
সাব্বিরের জ্বর বাড়ছে। এতো কথার অর্থ সে ধরতে পারছে না। সে কিছু বলার আগেই ঝংকার দিয়ে উঠল বুয়া। মিথিকে তার বড় ভালো লেগেছে৷ তার ভালো মানুষ স্যারের সাথে কী সুন্দর মানায় তাকে! দুটোতে মিলে যেন রাজযোটক। সেই ছবির মতো রাজযোটকে বৃষ্টির ছায়া তাকে খুবই ক্ষিপ্ত করে তুলছে। সে প্রায় ঝগড়া করার মতো করে বলল,
‘ নিজের সোয়ামীর সঙ্গে বিবেচক হইব না অবিবেচক, সেইটা আপনেরে ভাবতে কইছে ক্যারা?’
বৃষ্টি জ্বলন্ত চোখে বুয়ার দিকে তাকাল। সাব্বির অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন মনে করার চেষ্টা করল৷ ম্লান কণ্ঠে বলল,
‘ তুমি আর এসো না বৃষ্টি। তুমি এলে মিথি ক্ষেপে যায়। ও এমনিতেই রেগে আছে।’
বৃষ্টি ব্যথিত চোখে সাব্বিরের দিকে তাকাল। বিষণ্ণ চোখে দেখা গেল অপমানের ছায়া। কঠিন কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি তো দেখি ভেড়া প্রজাতির প্রাণী সাব্বির ভাই। বউয়ের লেজে লেজে ঘুরে বেড়ান। বউয়ের কথাতে কী সামাজিকতা বিসর্জন দিবেন এবার?’
বুয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
‘ বিয়া করছে তো বউয়ের লেজ ধইরা ঘুরব না তো আপনের লেজ ধইরা ঘুরব? বেলেহাজ মাইয়া মানুষ।’
বৃষ্টি কঠোর কণ্ঠে বলল,
‘ বুয়া বুয়ার মতো থাকুন। আমার সাথে তর্ক করার যোগ্যতা আছে আপনার? মূর্খ মেয়ে মানুষ।’
বুয়া এবার ভয়ংকর হৈচৈ শুরু করল। অকথ্য, গ্রাম্য গালিগালাজে উত্তপ্ত করে তুলল পরিবেশ। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে মুখ ভেঙিয়ে গলার স্বর তুঙ্গে তুলে বলল,
‘ মূর্খ হইছি ভালা হইছি। তোর মতো শিক্ষিত হইয়া ভর দুপুর আরেক জনের সোয়ামীর সঙ্গে শুইতে তো যাই নাই রে ছিনাল।’
বৃষ্টির কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। ছিঃ! যাকে এতোদিন গ্রাম্য সরল রমনী ভেবে এসেছে তার মুখের ভাষা এত জঘন্য! বৃষ্টি শীতল কণ্ঠে বলল,
‘ ভাষা ঠিক করুন। এরপরও এই বাড়িতে আপনি কাজ করতে পারবেন বলে আপনার ধারণা?’
বুয়া প্রায় নেচে উঠে বলল,
‘ তোর কামের মুহে জুতা মারি। আমারে তুই কামের ডর দেহাস? আমি, কমলার মায়ের কামের অভাব আছে? আমারে মূর্খ কস। আমি বাড়ি বাড়ি গিয়া তোর নষ্টামির কতা প্রচার করমু। ঢাকা শহরে মাইক মাইরা কমু। আমারে চিনছস তুই?’
বৃষ্টি আর একটা কথাও না বলে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ঘর থেকে বেরিয়েই দেখল সিঁড়ির গোড়ায় থমথমে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে তার আপা। অপমানে বৃষ্টির চোখে জল চলে এলো। সে এতোটা খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি সাব্বিরের কাছে। সাব্বির অসুস্থ শুনে প্রাণ অস্থির হচ্ছিল বলেই…!
বৃষ্টি বেরিয়ে যাওয়ার পরও একা একাই বুলি ছুটাচ্ছিল বুয়া। এতোসব চেঁচামেচির কোনো অর্থই সাব্বির ধরতে পারছে না। সে দুর্বল গলায় বুয়াকে ডাকল। সাব্বিরের কাছে যেতেই একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেল বুয়া। সাব্বির বলল,
‘ আমার জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন বুয়া? অ্যাম্বুলেন্স হলে বেশি সুবিধা হয়। আমি আমার ফোনের পাসওয়ার্ড মনে করতে পারছি না। আমার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি। যতটুকু মনে হচ্ছে, আমার অবস্থা খুব একটা ভালো না।’
বুয়া ত্রস্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আমি ব্যবস্থা করতেছি স্যার। হাসপাতালে ভর্তি আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। আমার এক ভাইগ্ন্যা হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়। আপনে কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না।’
সাব্বির দুশ্চিন্তা করল না। মূলত দুশ্চিন্তা করবার মতো ক্ষমতা এই মুহূর্তে তার আছে বলে মনে হলো না। বুয়া কাকে যেন ফোন করতে করতে বলল,
‘ তয় আপামণির নাম্বারডা থাকলে ভালা হইত। আপামণি চোক্কের পলকে সমাধান করি ফেলত৷ তার চেহারা দেইখাই বুঝা যায় তার চেনাশোনা ভালা।’
ঘন্টা তিনেক পর শাহবাগকে বাদের তালিকায় ফেলে সাব্বিরকে মহাখালির এক হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। সেই হাসপাতালে বুয়ার জানাশোনা আছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর সাব্বিরের শরীরিক অবস্থা হলো আরও খারাপ। পরীক্ষা করে দেখা গেল, ডেঙ্গু পজিটিভ। প্লাটিলেট কমতে কমতে দশ হাজারে নেমে এসেছে। নিজের প্রতি উদাসীন সাব্বির ডাক্তার হয়েও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি নাকি ইচ্ছে করেই ঘটতে দিয়েছে তা বিরাট এক প্রশ্ন হয়ে থেকে গেল।
_____________
দুধ ফরসা মুখ, পনিটেল করা চুল, গোলাপি সাধারণ কামিজ আর জিন্স পরিহিতা মেয়েটিকে অবাক হয়ে দেখছে সাফাত। মেকাপ নিতে বসার পর যখন মেয়েটা স্ক্রিপ্ট হাতে এলো। পরিচালকের প্রধান বার্তা বাহকের চরিত্রে নিজেকে চমৎকার মানিয়ে নিয়ে সাফাতকে নানান কথা বলছিল, বলতে দোষ নেই সাফাত তখনও আয়নার ভেতর দিয়ে তাকেই দেখছিল নির্নিমেষ। গার্ডেন ছাতার নিচে বসে নিজের শটের জন্য অপেক্ষা করতে করতেও রোদ চশমার আড়াল থেকে বার কয়েক ফিরে ফিরে তাকিয়েছে সাফাত। পাঠকরা এই দৃষ্টিকে মুগ্ধতা ভেবে রোমান্টিক হয়ে যেতে পারেন৷ কিন্তু তাদের সেই ভাবনাকে টেক্কা দিয়ে সে চোখে খেলা করছে গাঢ় বিস্ময়। এই মেয়েটা যেন এক আশ্চর্য! ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়? নাকি ওরা আসলেই দু'জন? সেদিন সাধারণ সুতি শাড়িতে যে অপরূপাকে সাফাত দেখেছিল। সে যেন আজ বিলীন। চেহারা ব্যতিরেকে পোশাক, ব্যবহার, চাহনি কোথাও তার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। সেইদিন যে মায়া দেখেছিল সেই কাজল ল্যাপটানো চোখে। মনে হচ্ছিল এই হৃদয় হারিণী উঠে এসেছে কোনো রবীন্দ্রীয় উপন্যাস থেকে। আজ সেই মায়া, সেই আবহ সবই কেমন ধূসর। সেদিন তার মধ্যে ছিল আশ্চর্য এক বিষণ্ণ ক্লান্তি। চোখের দিকে তাকালেই তাকে একটু বিশ্রাম দেবার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠছিল প্রাণ। কিন্তু আজ সে চৈত্রের দুপুরের মতো শুষ্ক, রিক্ত। তার কোথাও যেন একটুখানি রস নেই। তার মেকি হাসিতেও সহস্র বছরের করের চাপ। চোখদুটো ধু-ধু শূন্য মাঠ। সাফাত আশ্চর্য হয়। সেই মায়াবি, রবীন্দ্র সৌন্দর্য হারিয়ে যাওয়ায় বুকের ভেতর অদ্ভুত এক ব্যথা অনুভূত হয়। সেদিন, সেই রাত্রি এবং তার পরের দিনগুলোতে মেয়েটিকে নিয়ে সত্যিই ভেবেছিল সাফাত। তাকে ভাবলেই শহরের সব দুশ্চিন্তা পিছু ফেলে হিজল তলার টলটলে দিঘির মতো এক টুকরো স্নিগ্ধ প্রশান্তি ছুঁয়ে যেত বুক। সেই প্রশান্তি হারিয়ে সাফাতের আপনজন হারানোর মতো ব্যথা হলো। থমথম মুখ করে বলল,
‘ মোখলেসুর সাহেবকে ডাকো তো আশরাফ।’
আশরাফ বিনীত কণ্ঠে শুধাল,
‘ কেন স্যার?’
‘ কেন সেটা যদি তোমাকেই বলি তাহলে ওনাকে কী বলব? তোমাকে ডাকতে বলেছি ডাকবে। কথায় কথায় কেন কেন আমার পছন্দ না। মনে রাখবে, তুমি আমার এ্যাসিস্ট্যান্ট। বউ না।’
আশরাফ মাথা নেড়ে ছুটে গেল মোখলেসুর আলমের কাছে। একটু পর ত্রস্ত পায়ে ফিরে এসে বলল,
‘ মোখলেসুর সাহেব নায়িকার শট নিচ্ছে স্যার। বলেছেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসবে। স্যার? আমি কী সেকেন্ড গণনা শুরু করব? গণনা করে দেখলাম, ব্যাটা ঠিক সময়ে আসছে কি-না। টাইম ইজ আ বিগ ম্যাটার। কত মিনিট দেরি করল তার উপর নির্ভর করবে এখানে আপনার যোগ্য আপ্যায়ন হচ্ছে কি-না!’
সাফাত উত্তর না দিয়ে মুখ গম্ভীর করে বসে রইল। মোখলেসুর সাহেব এলেন বেশ সময় নিয়ে। শুটিং বয়কে এক কাপ চা দিতে বলে সাফাতের দিকে তাকিয়ে হাসলেন,
‘ কী অবস্থা সাফাত? কোনো সমস্যা?’
সাফাত উত্তর দিল না। আশরাফ তখনও গণনা করছে, পাঁচ হাজার একশো তিন। পাঁচ হাজার একশো চার। পাঁচ হাজার একশো পাঁচ…। মোখলেসুর আলম কয়েক সেকেন্ড আশরাফের দিকে তাকিয়ে থেকে রাম ধমক দিয়ে বললেন,
‘ এই মিয়া তুমি এক দুই গুণছ কেন? এটা কী প্রাইমারি স্কুল? আমি নামাতার ক্লাস নিচ্ছি? যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ বন্ধ!’
আশরাফ যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ বন্ধ করল না। তবে গলার স্বর কমিয়ে প্রায় শব্দহীন হয়ে গেল। মোখলেসুর সাহেব বিরক্তি নিয়ে আশরাফের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটা মানুষ সম্পূর্ণ শব্দহীন হয়ে চোখ-মুখ নাড়ছে ব্যাপারটা যথেষ্ট কদাকার। তিনি অস্বস্তি নিয়ে সাফাতের দিকে তাকালেন,
‘ তোমার এই এ্যাসিস্ট্যান্টের মাথায় কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে নাকি?’
সাফাত গম্ভীর মুখ করে বলল,
‘ ওর কথা বাদ দিন। কাজের কথায় আসুন।’
মোখলেসুর সাহেব কপালে অস্বস্তির ভাঁজ নিয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ, বলো। ঘটনা কী?’
‘ ঘটনা তো আপনি কিছুই খবর রাখেন না মোখলেস ভাই। কস্টিটিউম একটাও তো মানের না। গায়ে দিলেই কুটকুট করে গা চুলকায়। আপনাকে আমি আগেই বলেছিলাম, কিছু কিছু কাপড় পরলে গরমে আমার এলার্জিক রিয়েকশন হয়। আপনি ব্যাপারটা খেয়াল রাখবেন না? মুখের মধ্যে যদি সর্বক্ষণ এলার্জির চাপ থাকে শটের এক্সপ্রেশন দিব কী করে?’
কিছুটা তপ্ত শোনাল সাফাতের কণ্ঠ। মোখলেসুর সাহেব বললেন,
‘ বলো কী! কস্টিউম ঠিকঠাক আছে কি-না দেখার দায়িত্ব তো ছিল মিথির। সে ডিজাইনারকে আগে থেকে সাবধান করে দিবে না?’
সাফাত প্রত্যুত্তরে থমথমে মুখে বসে রইল। মোখলেসুর সাহেব শুটিং সেটের এক ছেলেকে দিয়ে মিথিকে ডেকে পাঠালেন। মিথি কাছে আসতেই গম্ভীর কণ্ঠে কিছুক্ষণ ধমকা-ধমকি করলেন। তবে ধমকের পরিমাণ কিছুতেই সহনীয় মাত্রা পেরুল না। তার ক্ষীণ ধারণা, সাফাতের মিথির প্রতি একটা দুর্বলতা আছে। নয়তো অতো বড়ো একটা নিউজ নিজের গায়ে টেনে নেওয়ার মতো মানুষ সাফাত না। সম্ভবত দু'জনের মধ্যে মান-অভিমান পর্ব চলছে। গতকাল সাফাতের গাড়িতেই ফিরেছিল মিথি। আর সকাল থেকে দু'জনেরই মুখ ভার। এই মনোমালিন্য মেটাতে সাফাত বোধহয় জোরপূর্বক একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে মিথির সাথে একান্ত কিছু সময় কাটাতে চাইছে। মোখলেসুর সাহেব দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে মিথিকে সাফাতের কাছাকাছি রাখার বন্দোবস্ত করলেন। সাফাতকে এখন একটু তোয়াজে রাখা জরুরি। মুখ গম্ভীর করে বললেন,
‘ তুমি এখন আবার নতুন করে সাফাতের গায়ের মাপ নিবে মিথি। কোন কোন কাপড় তার জন্য আরামদায়ক। সব ইন ডিটেলস্ নোট করে নতুন আউটফিট বানাতে দিবে। বারবার একই ভুল গ্রাহ্য করা হবে না। তোমার জন্য আমার ক্ষতি বই লাভ কিছু হচ্ছে না!’
পুরোটা সময় মিথি নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে রইল। কোনোরকম প্রত্যুত্তর করার চেষ্টা করল না। মিথির সান্নিধ্যে এসে সাফাতের মেজাজ ক্রমশ খারাপ হতে লাগল। নোটবুক আর কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নির্লিপ্ত মিথির কোনো প্রশ্নর উত্তরই সে দিল না। মিথিকে তার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। আশ্চর্য এক আক্রোশে শরীর মন শক্ত হয়ে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, এই মেয়েটির জন্যই সেই গোধূলি বেলার মেয়েটি হারিয়ে গিয়েছে। একটা টলমলে দিঘির নির্মম মৃত্যু ঘটেছে। এই মেয়েকে অতি অবশ্যই কঠিন একটা শাস্তি দেওয়া দরকার। মিথি শুটিং সেটের এক ছেলেকে ডেকে সাফাতের মাপ নিতে বলতেই ম্যাজারমেন্ট টেপ টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল সাফাত। রাগে চোখ-মুখ লাল করে ফেলল। ঘোষণা করল,
‘ সে আজ কোনো শট দিবে না। আগামী কালও দিবে না। সে এই নাটকে আর কাজই করবে না।’
খবর পেয়ে ছুটে এলেন মোখলেসুর সাহেব। মিথির দিকে তপ্ত চোখে তাকিয়ে সাফাতকে বললেন,
‘ কী সমস্যা সাফাত? মিথি কোনো ভুল করেছে?’
সাফাত চোখ-মুখ লাল করে বলল,
‘ এই মেয়েকে কাজ থেকে আউট করুন। এর চেহারা দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ে এখানে কাজ করলে আমি এই নাটকে আর কাজ করব না। আপনারা অন্য অভিনেতা দেখুন।’
মোখলেসুর সাহেব মহা মুশকিলে পড়লেন। বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘ নাটকের শুটিং সেভেন্টি পার্সেন্ট কমপ্লিট। এখন তুমি এমন করলে কীভাবে চলবে সাফাত? তুমি মাথা ঠান্ডা কর। আমরা আলোচনা করি।’
তারপর তিনি মিথির দিকে তাকালেন। ধমক দিয়ে বললেন,
‘ মিথি তুমি এক্ষুনি সাফাতকে সরি বলবে। সরি বলো।’
মিথি নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল,
‘ সরি ভাইয়া।’
সাফাত উত্তর না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। মোখলেসুর সাহেব আদেশের সুরে বললেন,
‘ আজ তুমি বাসায় চলে যাও মিথি। তোমার সাথে এই ব্যাপারে পরে কথা হবে।’
মিথি নির্লিপ্তমুখে এফডিসি থেকে বেরিয়ে এলো। পৃথিবী দেখল চির অভিব্যক্তিহীন এক তরুণী। কেবল মিথি জানল, অপমানে ভাঙতে ভাঙতে এক সময় আর অবশিষ্ট কিছু থাকে না। শরীর কাঁপতে থাকে অপমানের যন্ত্রণায়। আত্মবিশ্বাস গুড়িয়ে ধুলোর মতো পড়ে থাকে রাস্তার ধারে। চোখের সীমানা লঙ্ঘন করতে চায় অশ্রু। মিথি দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়াল। ব্যস্ত শহরে ব্যস্ত মানুষের ভীড়। পা ফেলার তিল জায়গা নেই। এতো ব্যস্ত জনপদেও নিজেকে কী ভীষণ একা, নিরাশ্রয়, অসহায়, ক্লান্ত বোধ করল মিথি! অনুভব করল, এই নশ্বর জীবনে সবথেকে বড় ক্লান্তি হলো অভিযোগ বয়ে বেড়ানোর ক্লান্তি। এই পৃথিবীতে আটশো কোটি মানুষ নিত্য শ্বাস নিচ্ছে এর মধ্যে একটি মানুষ নেই যার কাছে অভিযোগ জানাতে পারে সে। সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করাও আজকাল হাস্যকর ঠেকে তার। এই জীবন, এই পৃথিবী, এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ এবং স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা সবার প্রতিই আশ্চর্য এক কৌতুক বোধ করে মিথি। মাঝে মাঝে বোধহয় ঘৃণাও হয়। তীব্র থেকে তীব্রতর ঘৃণা। তার ঘৃণা যতই তীব্রতর হোক, দয়াময় সৃষ্টিকর্তা বোধকরি ততটা নির্দয় হতে পারেন না। মিথির বুক ব্যথা যে তার হৃদয়েও ব্যথা দেয় সে কথা জানাতেই বুঝি নেমে আসে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিদের দল। আকাশ পানে মেলে রাখা শুভ্র মুখশ্রীতে একটি একটি করে জলবিন্দু পড়তে পড়তেই শুরু হয় তুমুল বর্ষণ। এই প্রবল বর্ষণেও টলে না মিথি। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয় ঠাঁই। বৃষ্টির ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে বুকের ভেতরের ক্লান্তি যেন ধুয়েমুছে যেতে চায়। কোথা থেকে, কে যেন মনের ভেতর ভীষণ ভরসা দেয়। বল আসে। দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বদ্ধ পরিকর হয় মিথি। পৃথিবী যত নিষ্ঠুরই হোক না কেন, এই জীবনটাকে যাপন না করে এই পৃথিবী ছাড়বে না মিথি। নিজের প্রাপ্য স্বীয় ভাগ্য খাতায় লিপিবদ্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত সে লড়বে। ছিনিয়ে নিবে বিজয়। নিবেই।
___________
ধানমন্ডি লেকের পাড়ে বসে দুই বন্ধু গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে স্বপ্ন বিষয়ক বইয়ে। নীলক্ষেত থেকে ‘স্বপ্ন ও স্বপ্নের ব্যখ্যা’ নামে একটা বই উদ্ধার করতে পেরেছে তারা। বইয়ের প্রেক্ষাপট খারাপ না। দুই বন্ধুর অখণ্ড মনোযোগ ছিন্ন করে খুব কাছে বেজে উঠল একটা নারীকণ্ঠ,
'এক্সকিউজ মি? আপনি নাহিদ না?'
নাহিদ বই থেকে চোখ তুলে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বিস্মিত চোখে তাকাল। ঠোঁট উল্টে বলল,
' অবশ্যই আমি নাহিদ। বাবা-মা ছেলেবেলায় এই নামের আকিকা দিয়েছেন বলেই জানি। কিন্তু আপনি? দুঃখিত, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।'
মেয়েটা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
' আমি শিফা। বেশ কয়েক বছর আগে আপনি আমাকে খুব সাহায্য করেছিলেন। আমি ভীষণ বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম, আপনি আমার রিকশা ভাড়াটা দিয়ে দিলেন। মনে পড়েছে?'
নাহিদের মনে পড়ল না। সে খুব আশ্চর্য হয়ে বলল,
' তাই?'
মেয়েটি স্মিত হেসে সম্মতি জানাল। নাহিদ-সৌধ দু'জনেই বুঝল মেয়েটা বাজে বকছে। নাহিদ সব সময় চাপার উপর থাকে। বড় বড় চাপা মেরেই খালাস। যতটুকু আয় করে তাতে বিলাসবহুল জীবন কাটায় কিন্তু সেই কষ্টার্জিত পয়সা কোনো মেয়ের পেছনে খরচ করবে এমন বেকুব সে না। নাহিদ মেয়েদের সাথে নিরন্তর ফ্লার্ট করে, মধু মধু কথা বলে কিন্তু ওই মুখের মধু পর্যন্তই। এই জীবনে মা, বোন আর সৌধ ছাড়া কারো পেছনে বিশেষ করে কোনো মেয়ের জন্য যে সে এক পয়সাও খরচা করেনি সে একেবারে দলিল আকারে লিখে ফেলা যাবে। তবে তার কোমল, সুন্দর মুখ দেখে মেয়েটির তাকে দয়ার সাগর মনে হলে দোষ দেওয়া যায় না। তার চেহারা কিছুটা ওই ধরনেরই। কিন্তু এই খুকিকে কে বুঝাবে, যা দেখা যায় তা সর্বদা সত্য হয় না। মেয়েটি খুব কৃতজ্ঞতার সাথে নাহিদকে ধন্যবাদ জানিয়ে লাজুক কণ্ঠে বলল,
' সেদিন আপনি এতো বড় উপকার করেছিলেন অথচ ঠিক করে ধন্যবাদ দেওয়াও হয়নি। আমার মা এখনও মাঝে মাঝে আপনার কথা বলে। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি কী আপনার ফোন নাম্বারটা পেতে পারি? আসলে আমার মা আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে অস্থির হয়ে আছে।'
নাহিদ তার বৃদ্ধা মাকে আর অস্থির করল না। সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে মেয়েটিকে একবার পরখ করে চুপচাপ ওয়ালেট থেকে বের করে দিল নিজের কার্ড। মেয়েটি কার্ডটা দেখে বিড়বিড় করে বলল,
' জার্নালিস্ট!'
' কেন? পেশাটা আপনার পছন্দ হয়নি?'
মেয়েটি কানের পেছনে চুল গুঁজে আলতো কণ্ঠে বলল,
' না, না। তা কেন? আমি বরং জার্নালিস্টদের একটু বেশিই পছন্দ করি।'
নাহিদ রোদ চশমা খুলে মিষ্টি করে হাসল। সে জানে, নারী মহলে তার চেহারাখানার কদর ভালো। বিধাতা কী মনে করে তার মতো শয়তান ছেলের এমন নিষ্পাপ মুখ দিলেন কে জানে? মেয়েটা নাহিদের ঠোঁটে জাদুর হাসি দেখে যেন আরও গলে গেল। নাহিদ তাকে গলতে দিয়ে আলতো করে বলল,
' বেঁচে গেলাম!'
মেয়েটি অবাক হয়ে শুধাল,
' এ কথা কেন?'
' আপনি জার্নালিস্টদের অপছন্দ করলে এই পেশা ছেড়ে না খেয়ে মরতে হতো আমায়৷ আমি এই এক কাজ ছাড়া আর কিছু পারি না। আবার আপনি যা অপছন্দ করেন তা করে খেয়ে পরে বেঁচে থাকব। সেই সাধ্যও আমার নেই। বিপদ না?'
নাহিদ ফ্লার্ট করছে বুঝতে পেরেও লজ্জায় লাল হলো শিফা। প্রশ্রয়ের কণ্ঠে বলল,
' আপনি তো খুব দুষ্টু! দেখে বুঝা যায় না।'
নাহিদ অপরাধ স্বীকার করে বলল,
' আপনার মধ্যে যে চুম্বক আছে সেটাও দেখে বুঝা যায় না। এখন অবশ্য বুঝতে পারছি। আপনাকে দেখেই হৃদয় থেকে অদ্ভুত চৌম্বকীয় বলে শুধু দুষ্টু দুষ্টু কথাগুলোই বেরিয়ে আসছে।'
স্বস্তা ফ্লার্টিং মেথোড। তারপরও মেয়েটি হেসে ফেলল। দূরে পাঁচ-ছয়জনের একটা গ্রুপ প্রায় দূরবীক্ষণ যন্ত্র তাক করে রেখেছে তাদের দিকে। নাহিদদের থেকে বিদায় নিয়ে মেয়েটি সেই গ্রুপে ফিরে যেতেই দলের মধ্যে একটা হৈ হৈ পড়ে গেল। সৌধ সেদিকে একবার তাকিয়ে বলল,
' তোর নাম্বার পাইয়া খুশিতে ঝুমঝুম করতেছে মাইয়ারা৷'
নাহিদ সে কথার প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে আবারও বইয়ের পাতায় চোখ বুলাল। এমন সময় কল করল মিষ্টি। নাহিদ ফোন রিসিভ করতে করতেই সৌধ আকাশের দিকে মুখ করে বলল,
‘ চল উঠি। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।’
নাহিদ হাতের ইশারায় সৌধকে থামিয়ে দিয়ে ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে মিষ্টির রিনরিনে কণ্ঠ ভেসে এলো,
‘ তুমি কী আজ ফ্রী আছো?’
নাহিদ ঋজু হয়ে বসল। মিষ্টির কণ্ঠটা ভালো শুনাচ্ছে না। কৌতূহলী হয়ে শুধাল,
‘ আমি তো সবসময়ই ফ্রী। তোমার কিছু লাগবে?’
‘ আমার জ্বর। ময়মনসিংহ যাব ভাবছি। তুমি যাবে আমার সাথে?’
নাহিদ তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল,
‘ অবশ্যই যাব। কখন বের হবে তুমি? আমি কী আসব তোমার বাসার সামনে?’
মিষ্টি ম্লান কণ্ঠে বলল,
‘ না। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছি। মহাখালীর দিকে যাচ্ছি। তুমি মহাখালী আসো।’
নাহিদ উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ আসছি।’
নাহিদকে উঠে দাঁড়াতে দেখে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল সৌধ,
‘ কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ মিষ্টির শরীর খারাপ। তুই লাঞ্চ করে বাসায় চলে যা। আমি ওকে ময়মনসিংহে পৌঁছে দিয়ে আসি।’
সৌধ বলল,
‘ কোনো রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চটা করে যা। সকালেও কিছু খাওয়া হয়নি আমাদের।’
নাহিদ তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘ না রে। খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে।’
‘ দেরি আর কী? মেয়ে মানুষের রেডি হতেই দুই-তিন ঘন্টা শেষ। আর চলে এলে পাঁচ মিনিট দাঁড়াবে, সমস্যা কী?’
নাহিদ শুনল না। টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে লাফিয়ে একটা রিকশায় উঠে বসে বলল,
‘ মেয়ে মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে কী রে? অপেক্ষা তো করব আমরা। অপেক্ষা করা প্রেমিকদের মৌলিক ধর্ম হওয়া উচিত বদ্দা।’
মহাখালী পৌঁছে প্রেমিকের ধর্ম নিষ্ঠার সাথে পালন করে গেল নাহিদ। প্রথম আধাঘন্টায় মিষ্টি ফোন করে জানাল সে পথেই আছে। জ্যামে আটকে আছে। তারপর একে একে কেটে গেলো এক, দুই, তিন ঘন্টা। ঢাকা শহরে তখন ঝুম বৃষ্টি। নাহিদ এতক্ষণ একটা ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখন আর টিকতে পারল না। দুশ্চিন্তায় মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার। এখানে এসে পৌঁছানোর এক ঘন্টা পর থেকে আর মিষ্টিকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন করলেই ওপাশ থেকে ভেসে আসছে একটা পরিচিত যান্ত্রিক স্বর, ‘আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
নাহিদ মিষ্টির ফোন বন্ধের পেছনে নানান কারণ কল্পনা করে নিল। কিন্তু কোনো কারণই যুৎসই লাগছে না। কী এমন হতে পারে যার জন্য চার ঘন্টা অপেক্ষা করেও মিষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না? বৃষ্টির কারণে কী মিষ্টি ফিরে গিয়েছে? ফোনে চার্জ নেই বলে নাহিদকে জানাতে পারছে না? কিন্তু বাড়ি ফিরলেও তো এতোক্ষণে ফোন চার্জ হয়ে যাওয়ার কথা। নাহিদ অনেকক্ষণ মহাখালীর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে ফার্মগেইট মিষ্টির বাসার সামনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বৃষ্টিতে ভিজে নেয়ে, রাস্তার হাঁটু সমান পানি উপেক্ষা করে যখন নাহিদ ফার্মগেইট গিয়ে পৌঁছাল সেখানে গিয়ে খবর পেল, মিষ্টি বাসায় নেই। সেই দুপুরে বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়েছে আর ফিরে আসেনি। দুশ্চিন্তায় যেন এবার মাথা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো নাহিদের। এই দিন-দুপুরে শহরের রাস্তা থেকে কোথায় উধাও হয়ে যাবে মিষ্টি? কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়নি তো? অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় করার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে মৌনিকে টেলিফোন করার চিন্তা করল সে। এখানেও এক সমস্যা। মৌনির ফোন নাম্বার তার কাছে আছে কিনা কে জানে? এর আগে কখনও মৌনির সাথে ফোনে কথা হয়েছে বলেও তো মনে পড়ে না। বহু দুশ্চিন্তার মধ্যে এক টুকরো স্বস্তি দিতে অবশেষে মৌনির ফোন নম্বর পাওয়া গেল। এখন নাম্বারটা চালু থাকলেই হয়। প্রথম প্রথম ফোন নেওয়ার পর নাম্বার আদান-প্রদান হয়েছিল বোধহয়। মৌনি এখনও এই সীমই চালায় কি-না কে জানে? বহু জল্পনা-কল্পনা শেষে মৌনির ফোনে কল ঢুকল। কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছে না। মৌনির এই এক ফালতু স্বভাব আছে বটে। তার মন চাইলেই সে ফোন টোন বয়কট করে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চাইলেই তাকে ফোনে পাওয়া সম্ভব না। নাহিদ দাঁতে দাঁত চেপে অদৃশ্য কাউকে গালি দিল। তিনবারের চেষ্টায় মৌনি ফোন তুলে খুব বিরক্ত হয়ে শুধাল,
‘ কে বলছেন?’
নাহিদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ নাহিদ।’
মৌনি অতি বিস্ময়ে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসল। অবাক হয়ে বলল,
‘ নাহিদ! বাপরে! হঠাৎ আমাকে ফোন? কী অবস্থা তোর?’
‘অবস্থা ভালো। তুই কেমন আছিস?’
‘ গ্র্যান্ড।’
নাহিদ কণ্ঠকে যথাসাধ্য সহজ রাখার চেষ্টা করে বলল,
‘ আচ্ছা, তোর বান্ধবী কোথায়? ওকে ফোনে পাচ্ছি না। জানিস কিছু?’
মৌনি চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
‘ ও তো ময়মনসিংহ যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে কথা হলো। ওর ফোনের বোধহয় চার্জ শেষ। আমাকে ওর মামার ফোন থেকে ফোন করল। ওর মামা বোধহয় এসেছিলেন নিতে। ওনার পোস্টিং তো আবার সাভারেই।’
নাহিদ ঝুম বৃষ্টির মধ্যে ফোন কানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মিষ্টি তাকে মহাখালী দাঁড় করিয়ে রেখে ময়মনসিংহের পথে যাত্রা করেছে এই অবিশ্বাস্য খবরের আগে তার মাথায় এলো, প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। কাল রাত থেকে টানা উপোস চলছে তার।

আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান 

সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।


চলবে ...

১৯ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন