উপন্যাস : আজ ওদের মন ভালো নেই
লেখিকা : নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১৪ এপ্রিল, ২০২৪ ইং
লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলার “আজ ওদের মন ভালো নেই” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি তার ফেসবুক পেজে ২০২৪ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা |
২৮ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
আজ ওদের মন ভালো নেই || নৌশিন আহমেদ রোদেলা (পর্ব - ২৯)
উজ্জ্বল সকাল।
মাথার উপর সোনার থালার মতোন সূর্য৷ মিথি বসে আছে জানালার পাশের একটা সীটে৷ তার পাশে বেঢপ আকৃতির একজন ভদ্রলোক। তার পর আরও অজস্র মানুষ। একের উপর আরেকের দীর্ঘশ্বাস। অফিস যাত্রা তো নয় এ যেন এক অঘোষিত যুদ্ধ। মিথি নীরবে বাইরে তাকিয়ে রইল। রাস্তায় দেখবার মতো কিছু নেই৷ গাড়ির পর গাড়ি, ধুলো, ধোঁয়া আর মানুষ। সঙ্গে বৈশাখের অসহ্য উত্তাপ। নর্দমার পাশে নিঃসঙ্গ কাকটাও যেন কাতর হয়ে আছে তৃষ্ণায়। বাসের ভেতরে ধীরে ধীরে অসহনীয় হয়ে উঠছে উৎকট ঘামের গন্ধ। মিথির গা গুলাচ্ছে। ঘন জ্যাম পেরিয়ে বাসটা যেন এগুনোর থেকে বিশ্রামই নিচ্ছে বেশি। মিথির একবার বাস থেকে নেমে যেতে ইচ্ছে হয়। পরমুহূর্তেই কী মনে করে উদাস হয়ে বসে থাকে। এক ঘন্টার পথে দুই ঘন্টা লাগিয়ে গন্তব্যে পৌঁছেই হড়হড় করে বমি করে ফেলে মিথি। স্যামন পিংক শাড়ি পরনেই বসে পড়ে উত্তপ্ত ফুটপাতের ওপর। আজ মিথির জীবনে একটা বিশেষ দিন। অদৃষ্ট বলে কোনো বস্তু থাকলে মিথির অদৃষ্ট সম্ভবত খুব খারাপ। তার জীবনের প্রতিটি বিশেষ দিনই দিনশেষে হয়ে যায় প্রচন্ড এক দুঃখ। এই যেমন, মানুষ জন্মদিনে আনন্দিত হয় আর মিথির মনে পড়ে, আজ মায়ের চলে যাওয়ার চব্বিশ বছর। মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজকের দিনের সূচনাটাই হয়েছে ভুল দিয়ে। আপাতত আজকের দিনটিতে বাস ছেড়ে একটা টেক্সি নেওয়ার দরকার ছিল। বঙ্গ ললনার মতো রাস্তাঘাটে অসুস্থ হয়ে পড়া তার দ্বিতীয় ভুল। এমনটা হয়েছে সম্ভবত কাল রাতের ছেলেমানুষির জন্য। সাব্বিরের বাসায় শিফট হওয়ার পর নিজের ঘরে দোর দিয়ে ঘুমিয়েছে সারা সন্ধ্যা, সমস্ত রাত এবং সকাল পর্যন্ত। সাব্বিরের ঘুম ভাঙার আগেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে এসেছে। খাওয়া-দাওয়া কিচ্ছু হয়নি কাল রাত্তির থেকে। মিথি আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। নিয়তির সঙ্গে অঘোষিত এক যুদ্ধ ঘোষণা করে বুকের ভেতর জ্বালিয়ে দিল দ্রোহের আগুন। চোখদুটোতে দারুণ জেদ। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে নিজের সাথে শেষ বোঝাপড়া করে একটা রিকশা ডেকে উঠে বসল মিথি। স্কয়ার গ্রুপ এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের রিসেপশনে পৌঁছে সে অনুভব করলো তার তিন নম্বর ভুল, শাড়ি। সে এখানে যে কাজে এসেছে সেজন্য কিঞ্চিৎ বোল্ড পার্সোনালিটির প্রয়োজন বোধহয় ছিল। শাড়িটা সেক্ষেত্রে কিছুটা বেমামান। তারওপর রিকশা থেকে নামতে গিয়ে ছিঁড়ে গেল আঁচলের কাছটা। মিথি তৃতীয়বারের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঝকঝকে, তকতকে লাউঞ্জে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর মিথির ডাক পড়ল কনফারেন্স রুমে। মিথি বড় একটা দম ফেলে কনফারেন্স রুমে ঢুকল। একজন গম্ভীর চেহারার ভদ্রলোক ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে ইশারায় মিথিকে বসতে বললেন। ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ মে আই হ্যাভ ইউর সিভি, প্লিজ?’
একটা এডভারটাইজমেন্টে ডিরেকশন দেওয়ার কাজে সিভির কী প্রয়োজন মিথি বুঝে উঠতে পারে না। সৃজনশীলতা থাকে মস্তিষ্কে। সিভি দিয়ে কী সেই সৃষ্টিশীলতার প্রমাণ দেওয়া যায়? মিথি মনে মনে ভ্রুকুটি করে নিজের ফাইলটা এগিয়ে দিল৷ ভদ্রলোক ফাইলে চোখ বুলাতে বুলাতে বললেন,
‘ ইউ আর আ নিউকামার!’
মিথি প্রত্যুত্তর করার আগেই ভদ্রলোক মাথা তুলে তাকালেন। গম্ভীর স্বরে বললেন,
‘ হুয়াই ডু ইউ থিংক উই শ্যুড কাম টু এন এগ্রিমেন্ট উইদ ইউ? উই হ্যাভ ম্যানি মোর অপশনস্। হোয়াট ইজ স্পেশাল এবাউট ইউ?’
গম্ভীর গলায় প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিয়ে নীরবে মিথির দিকে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোক। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে একেবারে নির্লিপ্ত হয়ে বসে রইল মিথি। এই কাজটা পেলে ক্যারিয়ারের দৌঁড়ে অনেক এগিয়ে যাবে সে। কিন্তু তার মন্দ ভাগ্য! সফলতা এতো সহজে তার আঁচলে ধরা দেবার নয়। যা হবার নয় তা হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে না। অতএব, মিথি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে এক টুকরো আত্মবিশ্বাসী হাসি হাসল।
দীর্ঘ এক ঘন্টা মিথির নানান পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ আলোচনা করার পর ভদ্রলোক মিথিকে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার প্রস্তাব দিলেন। কাল রাত থেকে কিছু না খাওয়া মিথির জন্য একটা ঘন্টা মনে হলো দীর্ঘ একটি বছর। বারবার হাত ঘড়ি দেখে, রেস্টরুমে গিয়ে চোখ-মুখে পানি ছিটিয়ে এবং অফিস থেকে সার্ভ করা কফি খেয়ে যখন বহু প্রতীক্ষিত ঘন্টাটি কাটলো তখন মিথির ডাক পড়ল এমডি স্যারের কক্ষে। ঘড়িতে তখন দুপুর দুটো। সাজসজ্জার সাথে সাথে মিথির মনোবলও দর্শনীয় হারে কমে এসেছে ততক্ষণে। মিথি মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। দারুণ ইন্টেরিয়রে সাজানো শীতল কক্ষে সাদা পাঞ্জাবি আর আধপাকা চুলের অত্যন্ত সুদর্শন প্রৌঢ়ের সামনে নিজের এই হালতে এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে বড় ঠুকনো বলে বোধ হলো। তার সম্পর্কে সামনের ভদ্রলোকটির মনোভাবও সম্ভবত একই। অফিস-রুমে ঢুকার পর তিনি কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে মিথিকে নিরক্ষণ করলেন। একবার চোখ ফিরিয়ে পাশে দাঁড়ানো এসিস্ট্যান্টের দিকে তাকালেন। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে শুধালেন,
‘ আপনার নাম মিথিলাতুন্নেসা?’
মিথি নিজের নাম নিয়ে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত বোধ করল। ঘাড় নাড়িয়ে বলল,
‘ জি।’
‘ নাটক সিনেমা বানানোটা কী শখ নাকি পেশা?’
‘ দুটোই।’
ভদ্রলোক মিথির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এবার একটু হাসলেন। বললেন,
‘ কিছু মনে করো না মা। তুমি বয়সে অনেক ছোট, তোমাকে তুমি করেই বলি। তুমি বোধহয় জানো না, তোমাকে দেখলে টলটলে দিঘির মতো আরাম লাগে। চোখের আরাম। এই ধরনের মেয়েদের আমি সারাজীবন ঘর-সংসার সামলাতে দেখেছি। ক্যামেরা ধরতে দেখিনি। দেখলেও সেটা এলোমেলো দুই-চারটা ক্লিক। সেখানে তুমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে এসেছ। আই এপ্রিশিয়েট ইট। তবে আগেই বলে রাখা ভালো, আমাদের চাহিদার সর্বোচ্চ পুরণ করে কাজটা করা কিন্তু খুব কঠিন হবে। আমাদের শর্তগুলোও অনেক শক্ত। কাজের ক্ষেত্রে কোনোরকম ফাঁক আমি পছন্দ করি না। আমাদের চাহিদা মতো কাজ না হলে তোমাকে ভর্তুকিও গুণতে হতে পারে। এতো বড়ো দায়িত্ব তুমি নিতে পারবে তো মা? সাফাতের কথা শুনে আর আমার এসিস্ট্যান্টের ইনফরমেশন দেখে মনে হয়েছিল পারবে। কিন্তু তোমাকে দেখে সাফাতের কথার সাথে ঠিক মিলাতে পারছি না।’
ভদ্রলোকের আন্তরিকতার প্রত্যুত্তরে একটা মাপা হাসি হাসল মিথি। নিজের যোগ্যতার উপর এই আক্রমণে ভেতরের আত্মসম্মানী মিথিটা ঝিলিক দিয়ে উঠল ধারালো তলোয়ারের মতো। মৃদু অথচ স্পষ্ট স্বরে বলল,
‘ আগে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী – এটা একটা প্রচলিত প্রবাদ হলেও আমার মনে হয় কাজের ক্ষেত্রে গুণটাকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া দরকার। আর আমি মনে করি, প্রাধান্য দেওয়ার মতো গুণ আমার আছে, স্যার। আপনি চাইলে বিচার করে দেখতে পারেন।’
মিথির আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন ভদ্রলোক। মিথির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
‘ বেশ! তোমাকে দুইদিন সময় দিচ্ছি। আমাদের চাহিদার দিকে খেয়াল রেখে তোমার কী কী প্ল্যান আছে তার কিছু নমুনা আমাদের দেখাও৷ তোমার আইডিয়া এবং কাজের শার্পনেস পছন্দ হলে এই কাজটা আমরা তোমাকে দিবো। দুইদিনে ইউনিক কিছু আইডিয়া রেডি করে দেখাতে পারবে তো?’
মিথি ঠোঁটের কোণে মাপা হাসি আর চোখে অবিশ্বাস নিয়ে বলল,
‘ পারব।’
______________
বারান্দার দরজা খোলা। বৈশাখের গরম হাওয়ায় সফেদ পর্দাটা মৃদুমন্দ উড়ছে। ইজেলে লাগানো ক্যানভাসে অর্ধসমাপ্ত একটি ছবি। রং-তুলি, ব্রাশ সকলই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। তার থেকে কিছুদূরেই খোলা পড়ে আছে ওয়াকম সিন্টিক। ল্যাপটপের শাটার লাগানো হয়নি। কয়েকটা রাফ কাগজ। আর দুই তিনটা খোলে রাখা বইয়ের পাতা উড়ছে পতপত করে। আর এইসবের মধ্যমণি সেজে মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে মৌনি। তার পাশেই আধ খাওয়া চায়ের কাপ। সমস্ত ঘর জুড়ে আশ্চর্য এক নীরবতার স্পর্শ। সেই নীরবতা ভঙ্গ হলো মৌনির পায়ের ধাক্কায় কাঠের ইজেলটা উল্টে গিয়ে। মৌনি এই প্রচন্ড শব্দে চোখ মেলে তাকাল। কালো মেঘের মতো এক রাশি চুল চুড়ো খোঁপা করতে করতে শোয়া থেকে উঠে বসল। চোখে-মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই মনে পড়ল, আজ তার জন্মদিন। জন্মদিন নিয়ে মৌনির আদিখ্যোতা কিছুটা পরবর্তশীল। জন্মদিন করতে ইচ্ছে হলে, এই দিনে সে বিশেষ খুশি। ইচ্ছে না হলেই, অখুশি। মৌনির বেশিরভাগ জন্মদিনই অবশ্য কাটে অ যুক্ত খুশিতে। বেশিরভাগ জন্মদিনেই জন্মদিনের দিন জন্মদিন তার পছন্দ হয় না। বেশিরভাগ সময়ই তার মনে হয়, অন্য কোনোদিন জন্মদিনটা করা গেলে সুবিধা হতো। মৌনির আজকের জন্মদিনটাও তার অ যুক্ত খুশি জন্মদিনগুলোর একটি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে শুভেচ্ছার সয়লাব। আঁকাআঁকি, কার্টুন ভিডিও, বুক রিভিউ আর টুকটাক লেখালেখি — সকল স্তরেই মৌনির মোটামুটি ভালো পরিচিতি আছে বলেই বোধহয় প্রতি বছর এই দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় তৈরি হয়ে যায় একটা উৎসব উৎসব আবহ। এই উৎসবে সবথেকে নির্লিপ্ত চরিত্র মৌনি নিজে। মৌনি ফোন হাতে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল। হাতের মোবাইলে আটশোর বেশি মিসড কল নোটিফিকেশন। মৌনি জানে এর প্রায় প্রত্যেকটাই জন্মদিনের উপঢৌকন জাতীয় টেলিফোন। তবে মৌনির অলিখিত নিয়ম হলো, জন্মদিনে সে কোনো কল রিসিভ করে না। কারো থেকে কোনোরকম উপহার গ্রহণ করে না। নিজের ঠিকানা কাউকে জানানো তার ভয়ংকর অপছন্দ। তারপরও কী করে কী করে যে তথ্যগুলো ফাঁস হয়ে যায় কে জানে! মৌনি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেঝে থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে একটু ভদ্রস্থ হতেই দরজায় করাঘাত পড়ল। জন্মদিনের দিন মৌনি যতই নির্লিপ্ত থাকুক। এই নির্লিপ্ত দিনে মিষ্টির আয়োজন করে আসা অনিবার্য। মৌনি এই অনিবার্য মিষ্টিকে ঘরে ঢুকার সুযোগ করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে দরজা খুলতেই চমৎকৃত হলো। দরজার বাইরে মিষ্টি নয়; দাঁড়িয়ে আছে পাশের রুমের জুনিয়র মেয়েটা। মৌনিকে দেখেই সে মিষ্টি করে হাসল। একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ শুভ জন্মদিন আপু। আজকে যে আপনার জন্মদিন জানতাম না তো! আপনার এক কাজিন এসে এই পার্সেলটা দিয়ে গেল বলে জানলাম। ছেলেটা বেশ অনেকক্ষণ আপনার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আপনি বোধহয় ঘুমুচ্ছিলেন তাই টের পাননি।’
মৌনি কপাল কুঁচকে খানিক বিভ্রান্ত গলায় শুধাল,
‘ কাজিন?’
‘ জি আপু। উনার নামটা তো ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে বলছিলেন, উনি আপনার মামাতো ভাই হন।’
মৌনির কপালের ভাঁজ এবার আরও স্পষ্ট হলো। সন্দিহান কণ্ঠে শুধাল,
‘ ওর নাম কী কাব্য?’
মেয়েটি উজ্জ্বল হেসে বলল,
‘ জি আপু৷ এমনই কোনো এক নাম বলেছিলেন বোধহয়।’
কাব্য তাকে বাড়ি বয়ে উপহার দিতে এসেছে ভেবেই আশ্চর্য হলো মৌনি। মেয়েটিকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘরে এসে পার্সেলটা খুলতেই বেরিয়ে এলো একটা কাস্টমাইজড বুক৷ বইয়ের মলাটে আদিম নকশা। যেন কোনো অভিশপ্ত রাজপুরীর নিষিদ্ধ কোনো বই। নকশার ভাঁজে ভাঁজে অবছা এক নারীর ছায়া। হাওয়ায় উড়ছে যার দীর্ঘ কেশ। স্বাধীন তার মসলিন পোশাক। ঠোঁটের আবছা হাসির দিকে তাকালে বোধহয় এই বুঝি পাখা মেলে উড়ে যাবে কোনো এক অজানা গন্তব্যে। বইয়ের মাঝামাঝি দারুণ ফ্রন্টে লেখা বইয়ের নাম, ‘দ্য ফেইরি টেল’। মৌনি বইটা উল্টেপাল্টে দেখল, কোথাও লেখকের নাম নেই। বইটা তার অপরিচিত। কিন্তু এই রকম চমৎকার প্রচ্ছদ আর প্রাচীন আবহের বইটি হাতে পেয়েই পুলকিত হয়ে উঠল তার মন। ফুরফুরে মনে প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাতেই দারুণ চমকে গেল। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের সূচনাতেই মৌনির আবছা একটা ছবি। ছবির মাঝামাঝিতে লেখা অধ্যায়ের নাম, দ্য প্রিন্সেস। তার পরের পৃষ্ঠাগুলো জার্নালের মতো করে সাজানো। প্রতিটি পৃষ্ঠাতেই মৌনির বিভিন্ন বয়সের ছবি। তার পাশে ছবির সাথে মিলিয়ে খুবই নান্দনিক উপায়ে লাগানো হয়েছে মৌনির প্রিয় বইগুলোর টুকরো টুকরো অংশ। একটি ছবিতে মৌনি বসে আছে দাদাজানের দিঘিপাড়ের সিঁড়িতে। গায়ে তার স্বচ্ছ সাদা শাড়ি। কাঁধের আঁচলটা প্রায় খসে পড়ছে কাঁধ থেকে। পায়ে আলতা। মৌনি এক হাতে শাড়ির আঁচল সামলে গাঢ় কাজল চোখে তাকিয়ে আছে দিঘি পারের দিকে। সেই ছবির নিচে কেটে লাগানো হয়েছে মৌনির খুব প্রিয় জীবনানন্দের কবিতা-
‘ হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি আমি পৃথিবীর পথে-
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে
মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার-অশোকের
ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি ; আরও দূর অন্ধকারে
বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন। ‘
জার্নালের আয়োজনটা এতো চমৎকার, এতো বাস্তব যে এক মুহূর্তের জন্য ভাবতে ইচ্ছে হয়, মৌনিই যেন নাটোরের সেই বনলতা সেন। মৌনি চমৎকৃত হলো। বইয়ের প্রতিটি পাতায় পাতায় সে জীবনের কিছুক্ষণ যাপন করে এলো তার প্রিয় সকল উপন্যাস হয়ে। কখনও বা নেচে বেড়ালো কাব্যের পদ্মাবতী হয়ে। আশ্চর্য এক পুলকে পুলকে ভরে গেল মৌনির হৃদয়। তার পছন্দের খেয়াল রেখে সেই অনুযায়ী বই পড়ে তার থেকে ছবি অনুযায়ী প্রিয় লাইনগুলো সংগ্রহ করে যে এই উপহারটি তৈরি করেছে তার ধৈর্য্যের কথা চিন্তা করে আশ্চর্যান্বিত হলো মৌনি। চোখে মুখে বিস্ময়ভাব নিয়েই প্রথম অধ্যায় শেষ করে দ্বিতীয় অধ্যায়ে পদার্পন করল সে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতে রং-তুলি আর ইজেল ক্যানভাসের ছবি৷ তার মাঝামাঝিতে লেখা, অধ্যায়ের নাম - ‘দ্য প্যারাডাইস’৷ এই অধ্যায়ে মৌনির এ যাবৎ কালে আঁকা শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোর সংগ্রহ। যেগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিকেই টাকার দায়ে বিক্রি করেছিল মৌনি। তৃতীয় অধ্যায়ে দেখা গেল, খবরের কাগজে প্রকাশিত মৌনির যাবতীয় সাহিত্য চর্চার ছোট্ট ছোট্ট অংশ। প্রত্যেকটি লেখাই খবরের কাগজ থেকে কেটে কেটে লাগানো হয়েছে বইয়ের পাতায়। নিচে লিখে দেওয়া হয়েছে লেখা প্রকাশের তারিখ। এই অধ্যায়ের নাম দেওয়া হয়েছে – দ্য লাইফ। চতুর্থ অধ্যায়ে সংগ্রহ করা হয়েছে মৌনির আঁকা সমস্ত জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র। তারা হলেন – ‘দ্য পিপল’ অধ্যায়ের সদস্য। শেষ অধ্যায়ে মৌনি খুঁজে পেল তার সকল স্বপ্নের ছবি। যে স্বপ্নের প্রত্যেকটিতে পাখির মতো উড়তে চায় মৌনি। হাসতে চায়, বাঁচতে চায়। চিৎকার করে গোটা পৃথিবীকে সচকিত করতে চায়। এই অধ্যায়টির নাম রাখা হয়েছে — দ্য ড্রিম। ড্রিম বটে!
বইয়ের প্রতিটি পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর অনেকটা সময় মুগ্ধতা আর বিস্ময়ে বিবশ হয়ে বসে রইল মৌনি। মৌনি সবসময়ই নিজেকে ভালোবাসতে ভালোবাসে। কিন্তু এই বইয়ের প্রতিটি পাতায় উপহারদাতা মৌনিকে যে প্রচন্ড আরাধ্য, প্রচন্ড অপার্থিব করে তুলে এনেছে! এতোটা অপার্থিবও তো নিজেকে কখনও ভাবেনি মৌনি! একজন মানুষ তাকে ঠিক কতটা নিঁখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করলে একটি বইয়ে মধ্যে পুরে দিতে পারে তার সমস্ত জীবন, আশা, স্বপ্ন, গ্লানি, সমস্ত জীবনবোধ! মৌনি আশ্চর্য হয়। বই হাতে কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে বসে থেকে বইয়ের সাথে পাওয়া চিঠিটা খুলে। ছোট্ট, অগোছালো এক চিঠি —-
‘ শুভ জন্মদিন মন।
কেমন আছ?
আমি জানি, তুমি চিঠি ভালোবাসো। তুমি কখনও চমকাও না। তাই ভেবেছিলাম তোমার জন্মদিনে একটা চিঠি লিখে তোমাকে চমকে দিব। কিন্তু এটুকু লেখার পর আর কী লেখা যায় ভেবে পাচ্ছি না। তুমি যখন এই চিঠিটা পাবে তখন সম্ভবত আমি সুদূর চট্টগ্রামে ডিফেন্সের ট্রেনিং-এ ব্যস্ত থাকব। তোমাকে এখনও জানানো হয়নি, আমি বিমানবাহিনীর জন্য এপ্লাই করেছি। সেনাবাহিনীর প্রতি তোমার দুর্বলতা আছে, জানি। বিমানবাহিনীকেও কী তুমি ততটাই পছন্দ করো মন? আমি একবার ভেবেছিলাম, কোর্স ফোর্স করে পাইলট বনে যাব। তোমার এই যে পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়ানোর শখ? তোমার সেই শখ পূরণের কোনো এক সফরে আমি হবো গর্বিত পাইলট। সেদিন চারদিক সচকিত করে একটু পর পর ঘোষণা করা হবে, ‘পৃথিবীর সবথেকে চমৎকার মেয়েটি আমাদের বিমানে করে তার স্বপ্ন পূরণ করতে যাচ্ছে। আমরা তার স্বপ্ন পূরণের অংশ হতে পেরে গর্বিত৷’ তুমি সেদিনও নিশ্চয় অপ্রস্তুত, অপ্রতিভ হয়ে আমাকে চার্জ করবে? হুমকি ধমকি দিয়ে অস্থির করে ফেলে বলবে, ‘আমাকে নামিয়ে দাও শাওন। এক্ষুনি ইমার্জেন্সি ল্যান্ড করাবে। তোমার মতো মাথা পাগল পাইলটের বিমানে আমি চড়ব না। অসম্ভব!’
মন!
চিঠিতে আর কী লিখতে হয় আমি জানি না মন। তোমার মতো অতো কাব্যও তো করতে জানি না। তুমি যদি আমার প্রেমিকা হতে তাহলেও কিছু কাব্য করার চেষ্টা করা যেত। প্রেমের খাতিরে একটু রোমান্টিক কবি হওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তুমি তো আমার বন্ধু। বন্ধুকে নিয়ে কী আর কাব্য করা যায়? কাব্য না করা গেলেও জীবনের প্রথম কারো জন্য চিঠি লেখার দুঃসাহস করে ফেললাম। তুমি তো মস্ত সেলিব্রিটি। এসব চিঠি-ফিটি তোমার কাছে নিশ্চয় দুধভাত? কিন্তু মন, তোমার কাছে আমার চিঠিটা অসংখ্য চিঠির একটি হলেও আমার কাছে এটা আমার যাপিত জীবনে লেখা একমাত্র! বলো মন, এখানে, ঠিক এখানেই বোধহয় আমাদের সবথেকে বড় পার্থক্য?
মন?
তুমি বন্ধু হিসেবে চমৎকার একজন মানুষ, মন। তোমাকে বন্ধু হিসেবে পাওয়াটা সম্ভবত আমার জীবনের আনন্দময় ঘটনাগুলোর অন্যতম। তোমার খুব আকাশ পছন্দ। তুমি বোধহয় জানো না, মাঝেমাঝে আমি তোমাকে প্রচন্ড মিস করলে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি আকাশে। মনে হয়, এই বুঝি তুমিও তাকাবে আকাশের দিকে। আমার সমস্ত মন খারাপ শুষে নিবে মিষ্টি এক হাসি দিয়ে। তুমি যখন এই চিঠিটা পাবে তখন আমি কোথায় থাকব জানি না। আমাদের সম্পর্কের সমীকরণ কেমন হবে জানি না। কিন্তু সব ভুলে তুমি একটু আকাশের দিকে তাকিও? জেনো, আমি তোমার পথ চেয়ে বসে আছি। সম্ভবত আমি তোমাকে প্রবলভাবে মনে করছি।’
মৌনি চিঠি পড়ার সাথে সাথেই খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। বুকের কোথাও একটা বয়ে গেলো অকারণ এক কষ্ট। দু'চোখ ভরা ব্যথা নিয়ে মৌনি ফিসফিস করে বলল,
‘ শাওন! শাওন! শাওন! তুমি প্লিজ ভালো থেকো?’
_______________
বৈশাখের দাবদাহে ধূসর শহর। ব্যস্ত পথচারী, ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া সহস্র যান, ফুল বিক্রি করা পথশিশু, গাছের ছায়ায় রিকশাচালকের নিরুদ্বেগ ঘুম। সকলেই চঞ্চল, সকলেই ক্লান্ত। এই ক্লান্ত শহরের এক ধারে, স্কয়ার গ্রুপ এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের অফিসের সম্মুখ দাঁড়িয়ে আছে ছিপছিপে একতরুণী। মাথাটা একটু উঁচু করে সে তাকিয়ে আছে রৌদ্রজ্বল আকাশের দিকে। বড় ক্লান্ত, মলিন তার মুখ। অথচ আশ্চর্য দ্যুতি তার দু'চোখে। অদূর ভবিষ্যতে কতো যুদ্ধ, কতো উত্থান পতন, কতো পরিশ্রমই না লেখা আছে তার অদৃষ্টে! অথচ সে নিরুত্তাপ। এই পৃথিবীর ভালোবাসাকে সে ভয় করে। ভয় করে আদর, স্নেহ, সম্পর্ক। তার কাছে ভয়হীন কেবল পরিশ্রম। ছোটবেলা থেকে গোঁয়ারের মতো খেঁটে খেঁটেই তো এতটুকু এসেছে সে! এবারও পারবে নিশ্চয়? ভালোবাসা, আদর, স্নেহ, মানুষ সকলেই তো হারিয়ে যায় একদিন। ম্লান হয়। প্রতারণার শিষ ওঠায়। পরিশ্রম তো কখনও ধোঁকা দেয়নি কাউকে। অদৃষ্টের দোহায় দিয়ে হাত ফসকে পিছলে যায়নি। মিথির চোখের দৃষ্টি আরও উজ্জ্বল হয়। পৃথিবী, সমাজ, ভালোবাসা আর অতি সন্তপর্ণে লুকিয়ে রাখা একটি ঘরের লোভ — সমস্ত কিছু একটা বাক্সবন্দি করে ছুঁড়ে ফেলে নিজের থেকে বহু বহুদূর। ওদিকে আর তাকাবে না মিথি। বারবার একই অপমান আর নয়। নিজেকে ছোট করে দেখতে দেখতে ক্লান্ত সে। অন্যের জীবনে অস্তিত্বহীন, পরগাছার মতো বেঁচে থাকতে আর ইচ্ছে হয় না মিথির৷ এবার সে নিজেকে ছাড়িয়ে যাবে। ছাড়িয়ে যাবে নিজের ব্যক্তিগত দুঃখ, অনুভূতি আর ভালোবাসাকেও। বুকের ভেতর আত্মপ্রত্যয়ের তীব্র শিখা জ্বালিয়ে লম্বা একটা দম নিতেই পেছন থেকে ভেসে আসে একটা কণ্ঠস্বর,
‘ মিথি? এই মিথি? শুনছেন?’
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মিথি। একটা পাজেরো গাড়ি থেকে মাথা বের করে তাকেই হাতছানি দিয়ে ডাকছে সাফাত। মিথি শাড়ির আঁচলে নাকের ঘাম মুছে এগিয়ে গেল সাফাতের গাড়ির কাছে। মাথা নিচু করে গাড়ির ভেতরে তাকাল। সাফাত ঠোঁটের কোণে বিশ্ব জয়ী হাসি নিয়ে শুধাল,
‘ স্কয়ারে এসেছিলেন? ওই কাজটার জন্য এসেছিলেন বুঝি?’
মিথি মাথা নাড়ল। সাফাত শুধাল,
‘ কাজ হলো?’
‘ এখনও হয়নি। তবে হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। তারা সম্ভবত আমাকে পরীক্ষা করে দেখছেন। একটা হোমওয়ার্ক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।’
কথাটা বলে মিষ্টি করে হাসল মিথি। কোনো কৃত্রিমতা, কোনো দায়বদ্ধতা ছাড়া মিথির এই সহজ হাসি দক্ষিণা হাওয়ার মতো কোমল লাগল সাফাতের মনে। মাথা নাড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
‘ আমার বিশ্বাস, আপনার হয়ে যাবে। কাজের প্রতি আপনার ডেডিকেশন ভালো। কোনো প্রয়োজন হলে নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবেন। আপনার সাথে সাথে এটা এখন আমারও মান সম্মানের প্রশ্ন মিথি।’
প্রত্যুত্তরে আশ্বস্তের হাসি হাসল মিথি । সাফাতের মুখ আরও গম্ভীর হলো৷ মুখ গম্ভীর করে শুধাল,
‘ বাড়ি ফিরবেন তো? আপনার বাড়িটা যেন কোনদিকে? চলুন, আপনাকে নামিয়ে দিচ্ছি।’
মিথি প্রস্তাবটা নাকচ করে বিনয়ী কণ্ঠে বলল,
‘ আমি বাস ধরে চলে যাব ভাইয়া। খুব বেশি দূর না। সমস্যা হবে না। ধন্যবাদ।’
সাফাত প্রত্যুত্তরে মুখ গম্ভীর করে রইল। কোনো রকম জোরজবরদস্তি করলো না। মিথি তাকে বিদায় জানিয়ে চলে যাওয়ার পরও অনেকটাক্ষণ নীরবে বসে রইল গাড়ির ভেতর। মাঝের কয়েকদিনের অদর্শনে মিথির কথা প্রায় ভুলেই বসেছিল সাফাত। কিন্তু আজ আবারও শাড়ি পরা, কাজল ল্যাপ্টানো অপার্থিব মিথিকে দেখে আগের মতোই অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে বুকের ভেতর। মিথির দিঘির জলের মতো টলটলে চোখে যে ধূসর সন্ধ্যা ভর করে থাকে সর্বক্ষণ সেই সন্ধ্যার বিষণ্ণ সুর এসে বাজছে সাফাতের কানের কাছে। সাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে সিদ্ধান্ত নিল, মিথি মিথি চিন্তাটাকে আর কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। তার জীবনে যথেষ্ট দুঃখ আছে। অন্য একটি মেয়ের বিষণ্ণতার সুর শুনে ব্যথিত হওয়ার দরকার তার নেই।
____________
দুপুরের খাবার সময় পেরিয়ে গিয়েছে। নাহিদের ঘুম ভেঙেছে আসরের কিছু পর৷ বৈশাখের তপ্ত সূর্য কিছুটা কোমল হয়ে এসেছে। সোনালি রোদ্দুরে এখন আর আগের ধার নেই। নাহিদের মা শাহিনুর খাবার টেবিলে খাবার আগলে বসে আছেন। বহুদিন পর নাহিদ বাড়ি এসেছে। বাড়ি, পরিবার, বাবা-মা সকলের প্রতিই ছেলেটা ভারী উদাসীন। কারো প্রতি মায়া নেই। মোহাব্বত নেই। শাহিনূর যে একমাত্র ছেলেকে দু'চোখ ভরে দেখবেন। একটু আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন সেই সুযোগটিও নেই। নাহিদ নিজের ঘর থেকে তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে মায়ের সামনের একটা চেয়ার টেনে বসল। ঠোঁটের কোণে সর্বক্ষণের মিষ্টি হাসিটা টেনে বলল,
‘ কেমন আছ, আম্মু?’
শাহিনূর উত্তর দিতে পারলেন না। অবাক হয়ে দেখলেন ছেলের আশ্চর্য ছন্দপতন। এই কয়েকদিনেই কেমন রোগা হয়ে গিয়েছে শরীর৷ কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে পড়েছে। এমনিতেও নাহিদ দীর্ঘদেহী পুরুষ। রোগা হওয়ায় হাত-পাগুলো দেখাচ্ছে আরও বিশাল। ঢলঢলে মুখটাতে অবহেলার কালো দাগ। শাহিনূর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালেন,
‘ তোর স্বাস্থ্যটা এতো খারাপ হলো কী করে বাবা? অসুখে পড়েছিলি এর মধ্যে? দুনিয়ার ছেলেপেলে ছুটিছাটায় বাড়ি আসছে। তুই কেন আসিস না?’
উত্তরে আগের মতোই মৃদু হাসল নাহিদ। কয়েকদিনের অবহেলায় চেহারার চাকচিক্যে ভাটা পড়লেও চিবুকে ঝুলে থাকা আভিজাত্য তাকে দেয় অদ্ভুত এক চৌম্বকীয় আবেদন। কৌতুকপূর্ণ চোখদুটো কিছুটা নিষ্প্রাণ হয়ে এলেও কোথাও না কোথাও রেখে গিয়েছে আগের সেই বেপরোয়া ছাপ। শাহিনূর কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে ছেলের খাওয়া দেখলেন। তারপর হঠাৎ মনে হয়েছে এমন ভঙ্গি করে শুধলেন,
‘ তোর ওই বন্ধু মিষ্টি কেমন আছে রে?’
নাহিদ হাসে। ছোট করে উত্তর দেয়,
‘ ভালো।’
মিষ্টির প্রসঙ্গ আসতেই কথা থেকে উড়ে আসে রিফা। ভাইয়ের চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে বলে,
‘ জানিস ভাইয়া? সেইদিন আমি টাউনহলের কাছে মিষ্টি আপুকে দেখলাম। তার ছোটবোনকে নিয়ে রিকশা করে যাচ্ছে।’
নাহিদ চোখ তুলে ছোটবোনের আগ্রহী মুখের দিকে তাকাল। মুখ গম্ভীর করে বলল,
‘ এই মহান কার্য সম্পাদন করার জন্য আমরা আপনাকে কীভাবে সম্মানিত করতে পারি?’
তারপর বাম হাত বাড়িয়ে বোনের মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘ পড়াশোনা নেই তোর? বসে বসে সারাদিন রাস্তায় কে, কখন, কোন ঘটিকায় কোথায় যাচ্ছে সেসব খবর মুখস্থ করিস।’
তৎক্ষনাৎ রিফা মুখ ফুলিয়ে প্রতিবাদ করল,
‘ বসে বসে মুখস্থ করেছি তোমাকে কে বলল? রাস্তায় কী বসার জায়গা আছে?’
নাহিদ বোনের দিকে কৃত্রিম রাগ নিয়ে তাকাল। শাহিনূর ছেলের মন ভালো করতে খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন,
‘ তোর বন্ধু মিষ্টি মেয়েটা দেখতে ভারি সুন্দর। ওর ছোট বোন তো রিফাদের স্কুলেই পড়ে। সেদিন স্কুলের গেইটে রিফা দেখাল আমাকে। দেখলে কেবল তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে।’
নাহিদ হেসে ফেলল। খাওয়া থামিয়ে মায়ের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল। চোখের চাহনিতে আশ্চর্য কৌতুক নিয়ে বলল,
‘ মিষ্টির সাথে আমার কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই আম্মু। এরপর থেকে ভারি সুন্দর মেয়েটিকে একটু কম কম দেখো। অন্যের পুত্রবধূকে এতো গভীর চোখে দেখে লাভ কী বলো তো?’
ছেলের সরাসরি কথায় কিছুটা হতচকিত হয়ে গেলেন শাহিনূর। কিছুটা বিভ্রান্তও হলেন। হাওয়ায় হাওয়ায় মিষ্টিকে নিয়ে সেই স্কুলের দিনগুলো থেকেই শুনে আসছেন তিনি। এখনও ভাইবোনদের মধ্যে মিষ্টিকে নিয়ে গা টেপাটিপি দেখে ভেবেছিলেন ছেলে বোধহয় সেই মেয়েকেই বিয়ে করবে। তাহলে হঠাৎ সম্পর্কটা ভেঙে গেল কী করে? শাহিনূর কোনো প্রশ্ন না করে চিন্তিতমুখে ছেলের শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বহুদিন পর ভাইকে পেয়ে তুবড়ি ছুটল রিফার মুখে। বাড়ি ফেরার তাড়না না থাকলেও মা-বেনের সাথে এই পারিবারিক সময়টুকু ভালো লাগছিল নাহিদের। সেই ভালো লাগায় শনির গ্রহণ লাগিয়ে বাড়ি ফিরলেন বাবা। খাবার টেবিলে নাহিদকে দেখে তিনি কোনোরকম উচ্চবাচ্য করলেন না। মেয়েকে কাছে ডেকে তার জন্য আনা খাদ্যদ্রব্য তাকে বুঝিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেলেন পরম স্নেহে। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসলেন টেবিলে। মুখোমুখি খেতে বসেও বাবা-ছেলের মধ্যে কোনোরূপ বাক্য বিনিময় হলো না। শাহিনূর স্বামীকে খাবার দিলেন। খাবারের এক লোকমা মুখে নিয়েই তুবড়ি ছুটলো বাবার মুখে। তারকারিতে লবণ কম হওয়া নিয়ে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে সেই প্রসঙ্গ এগুলো নাহিদের দিকে। শাহিনূরও কম নন। স্বামীর কোনো কথাই তিনি সহজে মাটিতে ফেলতে দেন না। তাতেই চেতে গেলেন গৃহস্বামী। নানান কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে উচ্চকণ্ঠে প্রায় চিৎকার করে বললেন,
‘ মাতারি! তুই এক মাতারি। পয়দা করছিস আরেক গাঞ্জাখোর। সেই গাঞ্জাখোররে আবার বইসা বইসা খাওয়াস। খাওন তোর বাপের বাড়ি থেকে আনোস তুই? তোর বাপ দেয় খাওয়ার টাকা? আমার টাকায় তুই কেমনে মদ গাঞ্জাখোরদের পেটে ভাত ঢুকাস। আবার আমার ভাই-বোনেরে কথা শুনাস। তুই আমার বোনেরে কী বলছিস? তুই আমার বোনরে কিছু বলার কে? খারাপ তো আসলে তোদের জাত। তুই এক মা*। তোর বাপ আরেক চালবাজ। পোলা পয়দা করছিস…’
নাহিদ এতোক্ষণ নির্লিপ্ত মুখে বসে থাকলেও এবার নিশ্চুপে উঠে গেল টেবিল থেকে। বাবা-মা এখন বিশ্রীরকম ঝগড়া করবেন। বাড়িতে এতো বড় জোয়ান ছেলে আছে অথবা স্কুল পড়ুয়া মেয়ের কথা তাদের মাথায় থাকবে না। ঝগড়ায় তারা ব্যবহার করবেন ভয়ংকর অশ্লীল সব ভাষা। যে সকল ভাষা শুনলে নাহিদের মাঝে মাঝেই মরে যেতে ইচ্ছে হয়। নাহিদ নির্বিকারমুখে নিজের ঘরে দোর দেওয়ার সময় দেখল নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো ভাইয়ের দিকেই তাকিয়ে আছে রিফা। দু'চোখে তার তীব্র ভয়, শঙ্কা। নাহিদ বোনের দিকে এক নজর তাকিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে কানে হেডফোন গুঁজে দিলো। হেডফোনে তীব্র কোনো বাজনা বাজছে। কিন্তু কোন গানের বাজনা সেদিকে কোনো খেয়াল নেই নাহিদের। হেডফোনের তীব্র সঙ্গীত ঘরের বাইরের ভাঙচোরের আওয়াজ ঢেকে ফেলতে পারছে না। নাহিদের চোখ-মুখে থমথমে নীরবতা থাকলেও চোখের সামনে কেবল ভেসে উঠছে একটু আগে বোনের অসহায় দৃষ্টিজোড়া। ছোটবেলায় সে-ও ঠিক এভাবেই অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছে। রিফাকে আজ যেমন নাহিদ কাছে টেনে নেয়নি। সেদিন তাকেও কাছে টানার মতোন কেউ ছিল না। নাহিদ তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু এই অসুস্থ পরিবেশে রিফা কী করে বেঁচে আছে? দু'জন প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারীই বা এমন কদার্য উপায়ে কী করে ঝগড়া করতে পারে? নাহিদের চিন্তার মধ্যেই দরজায় করাঘাত পড়ল। নাহিদ আগের মতোই নির্লিপ্তমুখে বসে থেকে স্থির চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরেই দরজাটা সটান খুলে ছুটে এলো রিফা। ভাইয়ের কাছে এসে অস্থির গলায় বলল,
‘ ভাইয়া! ভাইয়া বাবা-মা মারামারি করছে। তুমি গিয়ে থামাও ওদের। বাবা মাকে মারছে।’
বোনের কথায় নাহিদের মধ্যে কোনো হেলদোল হলো না। রিফা কিছুক্ষণ ভাইকে ডেকে নেওয়ার চেষ্টা করে আবারও ছুটলো বাইরের ঘরে। কিছুক্ষণ পর আবারও ফিরে এলো ভাইয়ের কাছে। এইবার রিফার অবস্থার বেশ পরিবর্তন হয়েছে। মেয়েটা ভয়ে, আতঙ্কে হাপুস নয়নে কাঁদছে। হাত-পা তার থরথর করে কাঁপছে। সে কাঁপা হাতে ভাইয়ের বাহু টেনে ধরে বলল,
‘ ভাইয়া! ভাইয়া! মা বাবার মাথা ফাঁটিয়ে ফেলেছে। বাবা এখন মাকে বটি দিয়ে মারতে যাচ্ছে। তুমি চলো। চলো তুমি। বাবা মাকে মেরে ফেলবে ভাইয়া। বাবা মাকে মেরে ফেলবে।’
নাহিদ শান্ত চোখে বোনের ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রিফা ভাইয়ের এই কঠিন মূর্তি দেখে চিৎকার করে বলল,
‘ তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না? তুমি বুঝতে পারছ না বাইরে কী হচ্ছে? যাবে না তুমি ওখানে? যাবে না? তুমি না গেলে আমি একাই যাব।’
নাহিদ এবার হাত বাড়িয়ে শক্ত হাতে চেপে ধরল বোনের হাত। বোনের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে আশ্চর্য শীতল কণ্ঠে বলল,
‘ কোথাও যাবি না তুই। চুপচাপ আমার পাশে বসে থাক।’
রিফা উন্মাদের মতো বলল,
‘ বসে থাকব? তুমি পাগল হয়ে গিয়েছ ভাইয়া? তুমি বুঝতে পারছ না? বাবা মাকে মেরে ফেলবে, তুমি বুঝতে পারছ না?’
নাহিদ তবু স্থির, শান্ত। বোনের চোখে চোখ রেখে ততোধিক শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ প্রতিদিন মরার থেকে একদিনে মরে যাওয়া ভালো না?’
রিফা অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। এই নিষ্ঠুর, পাষণ্ড মানুষটা আসলেই তার ভাই!
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
৩০ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা নৌশিন আহমেদ রোদেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে তা অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন