উপন্যাস : শালুক ফুল
লেখিকা : রাজিয়া রহমান
প্রকাশনা : বইটই এ্যাপ
প্রকাশকাল : আগষ্ট, ২০২৪ ইং
রচনাকাল :
লেখিকা রাজিয়া রহমানের “শালুক ফুল” নামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকার অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২৮ সালের আগষ্ট মাসে অনলাইনভিত্তিক প্রকাশণা মাধ্যম ‘বইটই’ এ্যাপে প্রকাশিত হয়েছে।
![]() |
শালুক ফুল || রাজিয়া রহমান |
শালুক ফুল || রাজিয়া রহমান (পর্ব - ১)
“শালুক শোন, এদিকে আয়।”
৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে শালুক ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। ধ্রুব ভাই দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
লম্বা, হ্যাংলা একটা মানুষ অথচ গলায় এতো জোর কেনো তার?
দুই কাঁধের উপর শালুকের দুই বেণি সগর্বে দুলছে আপন মহিমায়।
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বললো, “আমার গাছ থেকে নয়নতারা ফুল ছিঁড়লি কেন?”
শালুক ঠোঁট বাঁকায়। এই সামান্য কথার জন্য এভাবে ধমক দিচ্ছে তাকে? পাগল না মাথা খারাপ?
তাছাড়া ফুল যখন ঝরে পড়ে যেত তখন তো ফেলেই দিতো। কোনো কাজে কি আসতো?
শালুক ফুলগুলো কাজে লাগিয়ে, ওদের জীবন সার্থক করে দিয়েছে।
শালুক জবাব দিলো, “চোখে কি কম দেখেন, ধ্রুব ভাই?
আমার চুলে দেখেন না, বড় চাচি ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে।”
ধ্রুব এগিয়ে এসে বললো, “এই গাছের পেছনে আমার কত যত্ন, কত পরিশ্রম করতে হয় তা কি তুই জানিস?”
“আমার এই চুলের পেছনে মা, বড় চাচি, ছোট চাচি কি পরিমাণ শ্রম দেয়, এনি আইডিয়া হ্যাভ ইউ?”
ধ্রুব নাক উঁচিয়ে বললো, “গাধি, এসব ভুলভাল ইংরেজি তোকে কে শেখায়?”
শালুক বিনুনি ঝাঁকিয়ে বললো, “ভুল আর ঠিক তো মেইন ফ্যাক্ট না ধ্রুব ভাই, ইংরেজিতে কথা বলাটাই আসল। কয়জন পারে এরকম স্মার্টনেস দেখাতে?”
ধ্রুব রেলিঙের উপর বসে বললো, “স্মার্টনেসের কি ছিরি, তা তো নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছি রে বোকা ফুল।”
শালুক হেসে বললো, “বিশ্বাস করলেন না তো, শুনেন তাহলে কি হয়েছে সেদিন। বাসে উঠেছি স্কুলের জন্য। হাফ ভাড়া দিয়েছি ওই ব্যাটা স্টাফ কিছুতেই নিবে না। বলছে ফুল ভাড়া দিতে হবে। যেই না এই জার্নি বাই বাস রচনাটা গড়গড় করে বলতে শুরু করলাম ব্যাটা সাঁইসাঁই করে চলে গেলো সামনে থেকে। ভেবেছে না জানি কোন বিদ্বান মানুষের সাথে সে তর্ক করতে গিয়েছে।”
ধ্রুব হেসে বললো, “কারেকশন প্লিজ, বিদ্বান পুংলিঙ্গ। এর স্ত্রী লিঙ্গ হলো বিদুষী।”
প্রচণ্ড বিরক্তিতে শালুকের কপাল কুঁচকে গেলো। রাগে আর কিছু না বলে চলে গেলো নিজের রুমে।
এজন্যই এই মানুষটাকে শালুকের প্রচণ্ড বিরক্তিকর লাগে। মনে হয় সে একেবারে সবজান্তা। সবসময় একটা ভাব নিয়ে থাকে জ্ঞানী জ্ঞানী।
শালুক গিয়ে নিজের রুমে এসে বই নিয়ে বসলো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। শালুকের যদিও এক বিন্দুও পড়ায় মন নেই কিন্তু তবুও বই নিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে হবে।
ধ্রুব নয়নতারা গাছটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গাছ থেকে ১০ টা ফুল মিসিং। সে আনমনে হেসে ফেললো হঠাৎ করেই।
এই নয়নতারা গাছটার চাইতে তার শালুক ফুলটা আরো বেশি যত্নের আর ভালোবাসার।
ধ্রুব আপনমনে বললো, “তোর জন্য এরকম হাজারটা ফুল এনে দিতে পারি বোকা ফুল। শুধু তোর আনন্দ, তোর খুশি দেখার জন্য।”
শালুক রাতে খাবার টেবিলে বসে নাক সিকেই তুলে রাখলো। শুঁটকি ভুনার গন্ধ আসছে। চারিদিকে তাকিয়ে অবশেষে দেখতে পেল, ধ্রুবর প্লেটে অনেকটা পরিমাণে শুঁটকি ভুনা।
শালুক ইয়াক বলে উঠে গেলো। ধ্রুব কটমট করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
খাবার নিয়ে এই মেয়েটার এতো নখরা!
তার এতো প্রিয় শুঁটকিকে কি-না ইয়াক বলে!
খাবার পর্ব তেমন জমলো না শালুকের। মনে মনে প্ল্যান করেছে আজকে রাতে একটা মুভি দেখবে। মুভিটা ভীষণ হরর তবে কিছু রোমান্টিক সিন ও আছে। শালুক তাই একাই দেখবে।
রুমে গিয়ে বসতেই শালুকের মা এসে বললেন, “তোর স্কুলে তোদের মডেল টেস্ট কবে থেকে রে?”
শালুক পিটপিট করে মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের মতিগতি বুঝতে পারছে না। মা শালুকের পড়ালেখা নিয়ে তেমন ঘাটায় না।আজকে যখন জিজ্ঞেস করছে নিশ্চয় আজকে শালুকের বই ছেড়ে রাত ১২ টার আগে উঠার চান্স নেই।
শালুক জবাব না দিয়ে টেবিলের উপর ছোট মেডিসিন বক্সটা বের করে নিলো।
শালুক জানে মা এখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শালুককে পর্যবেক্ষণ করবেন। তারপর শালুকের শরীর খারাপ বুঝতে পারলে আর পড়ালেখার কোনো কথা তুলবেন না।
বক্স থেকে একটা মাথা ব্যথার মলম বের করে শালুক কপালে ও ঘাড়ে দিলো।
শালুকের মা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন।মেয়ে অসুস্থ অথচ তিনি কি-না মেয়ের সাথে এসেছেন পড়ালেখা নিয়ে কথা বলতে। এমনিও এই মেয়ের মেধা কম।
মা উঠে চলে যেতেই শালুক লাফিয়ে উঠে। দরজা বন্ধ করে উড়াধুড়া ডান্স করে নেয়। প্ল্যান সাকসেসফুল।
আজকে শাপলার সাথে ঘুমাবে না শালুক। আপার জন্য রাতে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারে না ও।
বাহিরে অন্ধকারে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে। বাহিরে অন্ধকার হওয়ায় থাই গ্লাস দিয়ে ঘরের ভেতরের সবটাই লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এই নীরব রাত্রি সাক্ষী, আড়ালে দাঁড়িয়ে ধ্রুব কত বার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শালুককে দেখে।
জীবনে এতো যন্ত্রণা, এতো হতাশার ভিড়ে এই মুখটাই তো ধ্রুবর বেঁচে থাকার, ভালো থাকার পেছনের অনুপ্রেরণা।
কবেই তো পুরো পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতো ধ্রুব, কিন্তু পারলো কই!
এই কেশবতী, বোকা ফুলটাকে ছেড়ে যেতে যে মন চায় না।
সবার আড়ালে দাঁড়িয়ে ধ্রুব মন ভরে দেখছে শালুককে।
শালুককে নাচতে দেখে হেসে ফেললো ধ্রুব। কি জন্য এতো আনন্দ হচ্ছে জানা দরকার।
শালুক সবেমাত্র মুভিটা দেখতে শুরু করেছে, ৫ মিনিট ও হয় নি।
এরই মধ্যে দরজায় টোকা পড়লো। মুহূর্তেই বিরক্তি প্রকাশ পেলো শালুকের চোখে-মুখে। এই সময় কার ইচ্ছে করছে ওর রুমে আসতে?
চোখ মুখ মলিন করে, শালুক দরজা খুললো। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে। শালুকের দিকে না তাকিয়ে বললো, “কী করছিস? পড়ছিস?”
“না ধ্রুব ভাই, আমার ভীষণ পেট ব্যথা করছে।শুয়ে পড়েছি।”
ধ্রুব সরাসরি তাকালো শালুকের দিকে। কি অবলীলায় মিথ্যা কথা বলছে শালুক!
পড়ালেখা ছাড়া সবকিছুতেই তার পারফরম্যান্স ভালো। ধ্রুব বললো, “টেস্ট পেপার নিয়ে আয়।”
শালুকের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। পুরো দুনিয়ায় কি শালুকেরই কপালটাই ফাটা হতে হলো!
এত কায়দা করে মা-কে ম্যানেজ করে নিলো আর এখন কি-না!
শালুক হতাশার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ধ্রুব মনে মনে বললো, “এই চোখের মায়ায় ডুবতে ডুবতে একদিন এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবো।”
মুখে বললো, “আজকাল কি শাবানার মুভি দেখছিস নাকি! শাবানার মতো দুঃখী দুঃখী লুক দিচ্ছিস কেনো? তুই কি গরিবের শাবানা নাকি?”
শালুক চোখে-মুখে যন্ত্রণার ছাপ ফুটিয়ে বললো, “আমার ভীষণ পেট ব্যথা করছে ধ্রুব ভাই। আমি শুয়ে পড়েছি অলরেডি। এখন পড়ার মতো এনার্জি নেই আমার।”
শুতে গিয়ে ও হাসনা আবারও উঠে এসেছেন মেয়েকে দেখতে। শালুকের মাথা ব্যথা কমলো কি-না কে জানে!
আদা দিয়ে এক কাপ চা খেলে মেয়েটার ভালো লাগতে পারে ভেবে হাসনা উঠে এলো জিজ্ঞেস করতে চা খাবে কি-না।
এসে দেখে ধ্রুব শালুকের রুমের বাহিরে বজ্রকঠিন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। শালুক মা-কে দেখেই আনন্দিত হয়ে উঠলো।
হাসনা এগিয়ে এসে ধ্রুবকে বললেন, “কিরে, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে? শালুকের সাথে কোনো দরকার?”
ধ্রুব চাচির দিকে তাকিয়ে বললো, “ও-কে বলেছি টেস্ট পেপার নিয়ে আসতে চাচি।”
হাসনা বললো, “ওর শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। মাথাব্যথা করছে নাকি ওর। আমিই বললাম আজকে না পড়তে।”
ধ্রুব সরাসরি শালুকের দিকে তাকিয়ে বললো, “তোর মাথা ব্যথা করছে?”
শালুক মাথা নাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ।”
“কিন্তু একটু আগে যে আমাকে বললি তোর পেট ব্যথা করছে? তাহলে!”
শালুকের চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেলো। মিথ্যে কথার এই একটা যন্ত্রণা। কাউকে বলতে গেলে ও সেটা মাথায় রাখতে হয় যেন আবার বলতে গেলে ভুল না হয়ে যায়।
হাসনা শালুকের দিকে তাকালো। এই মেয়েটা এত ফাঁকিবাজ হয়েছে লেখাপড়া নিয়ে!
ধ্রুব ইংরেজি টেস্ট পেপার শালুকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “বই হচ্ছে সব রোগের মহৌষধ। পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, কাটা, ছেড়া, ফাটা, জ্বর, কাশি সব রোগের একটাই ঔষধ। তা হচ্ছে বই। এই চারটা স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্ন সলভ করবি এখন বসে বসে। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য টেস্ট পরীক্ষার পর ঘুম হারাম। ঘুমকে না বলবি।”
শালুক বিড়বিড় করে বললো, “এর প্রতিশোধ আমি নিবো ধ্রুব ভাই।”
হাসনা শালুকের এই গাফিলতিতে বিরক্ত। এমনিতেই তিনি চিন্তা করছেন এই মেয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট কি হবে সেটা নিয়ে, সেখানে শালুক কি-না নিজেই এরকম গাফিলতি করছে।
থমথমে মুখে শালুক বই নিয়ে বসে। ধ্রুব কে তার মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর মানুষ। মনে মনে শালুক বললো, “তুই জীবনে শান্তি পাবি না ধ্রুব ভাই, অভিশাপ দিলাম।”
নাকের জল,চোখের জল এক করে শালুক বই নিয়ে বসে।
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
রাজিয়া রহমান’র গল্প ও উপন্যাস:
শালুক ফুলের লাজ নাই, তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর, তুমি অন্য কারো ছন্দে বেঁধো গান, তুমি অপরূপা, কেয়া পাতার নৌকা,
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা রাজিয়া রহমান বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহন করেন। লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন তিনি। তরুণ এই লেখিকা বৈবাহিক সূত্রে লক্ষ্মীপুরেই বসবাস করছেন। বর্তমানে তিনি একটি পুত্র সন্তানের জননী। পেশাগতভাবে তিনি গৃহিনী হলেও লেখালেখির প্রতি তার ভিষন ঝোক। আর তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও শখের বশে ধারাবাহিকভাবে লিখে যাচ্ছেন একের পর এক উপন্যাস। ২০২২ সালের মধ্যদিকে গর্ভকালিন সময়ে লেখিকা হিসেবে হাতেখড়ি নিলেও এরই মধ্যে লিখে ফেলেছেন “তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর” ও “শালুক ফুলের লাঁজ নাই” -এর মতো বহুল জনপ্রিয় উপন্যাস।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন