উপন্যাস : দোলনচাঁপার সুবাস
লেখিকা : তাসফিয়া হাসান তুরফা
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং
লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফার “দোলনচাঁপার সুবাস” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা |
৪৬ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা (পর্ব - ৪৭)
নিশীথদের গাড়ি পৌঁছালো সবার পরে। ওরা দুজন বাড়ি যেয়ে দেখে সবাই ইতিমধ্যে পৌঁছে বর-কনেকে স্বাগতম জানাতে প্রস্তুত! নিশীথ দোলাকে সোফায় বসিয়ে সবার সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। রাত হয়ে যাওয়ায় দাদু ঘুমোতে চলে গেলো। বাকি বড়রাও যে যার মতো উঠে গেলো। এখন শুধু নিশীথের কাজিনরা বসে আছে। এরই মাঝে নিশীথের রুম থেকে ওর বন্ধুরা বেরিয়ে এলো। আকাশ, কবির,তূর্য এসেই নিশীথের দিক তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। বুঝাই যাচ্ছে, ওরা তিনটে মিলেই নিশীথের বাসরঘর সাজিয়েছে। একিসাথে চাপাস্বরে ফিসফিসিয়ে নিশীথকে কিছু একটা বলে ওরা হাসা শুরু করলো। নিশীথ প্রথমে রাগার ভান করে ওদের মারলেও পরক্ষণে ওদের সাথে হাসতে আরম্ভ করলো। ছেলেগুলোর অঙ্গভঙ্গি, চাপা কথার গুঞ্জনে একিসাথে নিশীথের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখায় দোলার বুঝতে বাকি রইলোনা ওরা কি নিয়ে হাসাহাসি করছে! ফলে, লজ্জায়-অস্বস্তিতে ও আরও জড়সড় হলো। এরই মাঝে নিশীথের কাজিন বোনেরা এসে দোলাকে নিশীথের রুমে নিয়ে গেলো।
ঢিপঢিপ হৃদয়ে ফুলসজ্জিত বিছানায় বসে আছে দোলা। নিশীথ কতক্ষণে রুমের ভেতর ঢুকতে পারবে কে জানে? বাইরে ওর কাজিনরা আর বন্ধুরা মিলে যে দর কষাকষি করছে ওর সাথে, ওদের হইহুল্লোড়ে সারাদিনে ক্লান্ত দোলার মাথা ধরে গেলো! মন চাইলো সব ভারী পোশাক-গহনা খুলে এক্ষুনি সাধারণ জামা পড়তে কিন্তু চাইলেই তো আর সব করা যায়না। তাই ধৈর্যের সঙ্গে বসেই নিশীথের প্রতিক্ষা করলো। একিসাথে দোলা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, আজ যে করেই হোক না কেন- নিশীথের থেকে সবকিছুর জবাব নিবে। কেন সে ইংগেজমেন্টের আগে সেদিন ওর সাথে ওমন আচরণ করেছিলো! কেনই বা ওকে বিয়ে করবেনা বলে ওসব নাটক করছিলো! দোলার মনে পুরনো কথার স্মৃতিচারণ হয়। সেদিন বিকেলে নিশীথের বলা কথাগুলো মনে পড়তেই নিজের অজান্তে চক্ষুদ্বয় ভরে উঠে জলে। ঠিক সে সময় কাজিনদের পাওনা মিটিয়ে নিশীথ ঘরে ঢুকে। দোলা চোখের পানি মুছতে যেয়ে নিশীথকে দেখে জমে গেলো। নিশীথ কিছু না বলে নীরবে খাটে বসা দোলার দিক এগিয়ে আসতেই মেয়েটা নড়েচড়ে বসলো। নিশীথ এসে পাশে বসে ধীরহাতে ওর ঘোমটা খুলতেই দোলা মাথা আরও নিচু করে গলার সাথে লাগিয়ে ফেললো। নিশীথ ডানহাতে ওর থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলতেই দোলার চোখে পানি দেখে অবাক হলো। বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করলো,
---এখনো কাদছো কেন, দোলনচাঁপা? কিছু হয়েছে কি? নাকি শরীর খারাপ লাগছে?
নিশীথের চিন্তায় মনে মনে দোলার একটু ভালো লাগলেও ও নিজেকে নরম হতে দিলোনা। বরং, কোনো উত্তর না দিয়ে ঝট করে নিজের উপর থেকে নিশীথের হাত সরিয়ে দিলো। নিশীথ চমকে গেলো। দোলা চুপচাপ উঠে ড্রেসিংটেবিলের সামনে যেয়ে একমনে নিজের পরিহিত গহনা খুলতে আরম্ভ করলো। নিশীথ কতক্ষণ বোকার মতো সেদিক চেয়ে রইলো। তবে কিছুক্ষণের মাঝেই ওর চেয়ে থাকা মুগ্ধতায় পরিণত হলো। ওর মনে এলো, আজ থেকে দোলনচাঁপা ওর বউ। ওর রুমে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে বধূরুপে নিজের গহনা খুলছে, মেয়েটাকে দেখতে কতটা মায়াময়ী লাগছে তা কি সে জানে? দোলা না জানলেও নিশীথ জানে! তাইতো সে আর নিজের জায়গায় বসে থাকতে পারলোনা। দ্রুত উঠে দোলার কাছে হেটে গেলো। ততক্ষণে দোলা চুড়িগুলো সব খুলে ফেলেছে প্রায়। গলার মালা খুলবে সে মুহুর্তে নিশীথ ওকে বাধা দিলো।
---আপনার করার দরকার নেই। আমি একাই পারবো!
---দরকার আছে কিনা সেটা আমাকেই বুঝতে দাও!
দোলা হাত সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই নিশীথ হাত ধরে ফেললো। ও আয়নায় তাকাতেই নিশীথের গভীর চাহনি দেখে বেশ খানিকটা কাবু হলো। বাধা দেবার শক্তি হারালো৷ ওকে থামতে দেখে নিশীথ নিজের মতো করে সব করলো। একে একে গলার মালা থেকে শুরু করে দোলার মাথার আঁচলসহ যাবতীয় সব ভারী জিনিস খুলতে সাহায্য করলো। গহনা ও আঁচলের ভার কমাতে দোলা অনেকটাই স্বস্তি পেলো। নিশীথ কিছু বলতে যাবে এর আগেই লাগেজ থেকে সুতি শাড়ি বের করে নিশীথের দিকে তাকিয়ে বললো,
---ওয়াশরুম কোনদিকে?
নিশীথ কোনদিকে দেখিয়ে দিলো। দোলা তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। নিশীথ সেদিকে চেয়ে ভাবলো, দোলা কি এখনো ওর উপর রাগ করে আছে? নয়তো এমন বিহেভ করছে কেন? রুমে ঢোকার পর থেকে একটা কথাও বললোনা ওর সাথে। এরকম তো করার কথা না! দোলার মান কিভাবে ভাঙানো যায় এ ব্যাপারে নিশীথ ভাবতে লাগলো! প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগিয়ে দোলা গোসল করে বের হয়ে দেখলো, নিশীথ রুমে নেই। মেয়েটা অবাক হয়ে এদিক-ওদিক চাইলো৷ নিশীথকে না পেয়ে তোয়ালা দিয়ে মাথা ঝেড়ে বারান্দায় মেলে দিতে গেলো। বারান্দা থেকে বেরোতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে চট করে নিশীথ ওকে ধরে ফেললো। দোলা ভীত স্বরে শুধালো,
---কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?
---তুমি বের হতে সময় নিচ্ছিলে তাই ভাবলাম আমিও ততক্ষণে অন্য বাথরুমে গিয়ে গোসল করে আসি। তাই বাইরে গিয়েছিলাম।
---ওহ!
নিজের কোমড়ে জড়িয়ে ধরে থাকা নিশীথের হাত সরাতে সরাতে দোলা জবাব দিলো। নিশীথ তো হাত ছাড়লোইনা উলটো আরও জোরে চেপে ওকে ধরে বললো,
---কেন? আমায় রুমে না দেখে ভয় পেয়েছিলে বুঝি?
---ভয় পাবো কেন? আজব!
---না মানে, বিয়ের রাতে জামাই পালিয়ে গেছে ভেবে যদি ভয় পাও!
নিশীথ মজা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু এ মুহুর্তে এমন বিশ্রী মজা দোলার মোটেও পছন্দ হলোনা। বরং ও তেলেবেগুনে জ্ব'লে উঠলো। বললো,
---পালানো তো আমার উচিত। যে বলেছে তার সাথে আমার স্ট্যাটাস মিলেনা, আমি তার যোগ্য না এমন লোকের সাথে থাকার কোনো মানে আছে?
দোলার ঝাঝালো কথায় ওর কোমড়ে আবদ্ধ নিশীথের দৃঢ় বন্ধন শিথিল হয়ে এলো। চাপা ধম'কে রুষ্ট হয়ে বললো,
---দোলনচাঁপা! এখন কি এগুলো কথা বলার সময়?
---তো কখন সময়, নিশীথ? আপনিই বলুন। সবকিছু যখন আপনার ইচ্ছাতেই হয় তখন আপনিই বলে দিন কখন সময় হবে এসব কথা বলার?
---বাপরে! একটু থামো তো। এত রাগ পুষে রেখেছো আমার উপর?
নিশীথ আদুরে স্বরে দোলাকে থামানোর চেষ্টা করলো। দোলা এবারও শান্ত হলোনা। ভেতরে ভেতরে ফুসে উঠায় নাকের পাটা ফুলে ফেঁপে উঠলো। তা খেয়াল করে নিশীথ হুট করেই ওর নাকের ডগায় চুমু খেলো। বিষয়টি এত দ্রুত ঘটলো যে দোলা থতমত খেয়ে গেলো। দোলা তাকালেও নিশীথ থামলোনা। একে একে দুই গালে ও পরক্ষণে ওর কপালে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দিলো। দোলা বুঝলো এসব কোনদিকে যাচ্ছে। কিন্তু আগে ওর নিশীথের কাছে জবাব চাই। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিশীথকে থামানোর চেষ্টা করে বললো,
---আজকে সবার আগে আপনার কাছে আমি জবাব চাই, নিশীথ। কেন করেছিলেন সেদিন আমার সাথে ওমন? আর কেন-ই বা ওভাবে ইনসাল্ট করেছিলেন? জবাব দেন প্লিজ!
দোলার নাছোড়বান্দা আচরণে নিশীথ ক্ষ্যান্ত হয়! নিজেকে এতক্ষণ শান্ত রাখলেও এবার ধৈর্যহারা হয়ে যায়। দোলার বাহু চেপে ধরে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,
---এতকিছু বলার পেছনে কারণ হলো, একটা ছোট্ট পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। বুঝেছো?
---কিসের পরীক্ষা?
দোলার কণ্ঠে বিস্ময়। নিশীথ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। কণ্ঠে বিষাদের ছাপ লাগিয়ে বলে,
---আমি দেখতে চেয়েছিলাম আমার দোলনচাঁপা আমাকে হারানোর ভয়ে কি করতে পারে! আমি দেখতে চেয়েছিলাম তুমিও আমার প্রতি ততটাই ব্যাকুল কিনা, যতটা আমি তোমার জন্য ব্যাকুল থাকি! আমি অনুভব করতে চেয়েছিলাম আমার প্রতি তোমার পাগলামি যেমনটা আমি তোমার প্রতি করে থাকি...
নিশীথ থামে। দম নিয়ে মুহুর্তে গর্জে উঠে বলে,
---কিন্তু বিনিময়ে আমি কি পেয়েছি জানো? এক সমুদ্র হতাশা! ট্রাস্ট মি, দোলনচাঁপা। আমার প্রতি তোমার উদাসীনতা আমায় ভীষণ কষ্ট দিয়েছে এবার! কিভাবে পারলে তুমি আমার ব্যাপারে না জেনেও বিয়েতে রাজি হতে? অন্য কাউকে বিয়ে করতে একটুও দ্বিধাবোধ হলোনা তোমার? নাকি আমার প্রতি তোমার অনুভূতি এতটাই ঠুনকো যে তুমি স্বেচ্ছায় নিজেকে অন্য কারও হতে দিতে...
---নিশীথ!
দোলা রে'গে নিশীথের মুখ চেপে ধরে ডানহাতে। অনেক বলে ফেলেছে ছেলেটা। একে আজ থামাতে হবে। নয়তো বিষয়টা ওদের দুজনের সহনশীলতার বাহিরে পৌঁছে যাবে!
"কি বললেন আপনি? আমার মনে আপনার জন্য কোনো অনুভূতি নেই, তাইতো?"
দোলার প্রশ্নে নিরব হয়ে গেলো কক্ষ। নিরব রইলো কক্ষে অবস্থানরত মানব। নিশীথের মুখ থেকে দোলা হাত সরিয়ে নেয়। তবু ওর তরফ থেকে কোনো জবাব না আসায় দোলা পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
---কিছু বলেছি আপনাকে। শুনতে পাননি?
---শুনেছি।
নিশীথ গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়। দোলা রে'গে বলে,
---তাহলে জবাব দিচ্ছেন না কেন?
---ইচ্ছে হয়নি তাই!
---উফ! আপনি এত্ত ত্যা'ড়া কেন?
দোলা বিরক্তিতে চিল্লায়। নিশীথ মুখের গাম্ভীর্য বজায় রেখেই ভ্রু কুচকে তাকায়। দোলা নিজেকে থামায়। থামিয়ে বলে,
---সেদিন পার্কে যখন আমি ডেকেছিলাম তখন আপনি আমায় কি কি বলেছিলেন, ইনসাল্ট করেছেন সেসব মনে আছে তো?
---আছে!
---তবে আপনি নিজেই ভাবুন, একজন মেয়ে যার মধ্যে নূন্যতম আত্মসম্মানবোধ আছে, তাকে যদি কেউ এভাবে সূক্ষ্মভাবে অপমান করে তবে কি সে ওই ব্যক্তিকে বিয়ে করতে রাজি হবে?
দোলার ঠান্ডা গলায় ছোড়া প্রশ্নে নিশীথ চটে গেলো। গমগমে গলায় বললো,
---কি এমন অপমান করেছি শুনি?
দোলা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো। মুখে বিতৃষ্ণাভাব ফুটিয়ে বললো,
---আবার শুনতে চান? কত কিই তো বলেছিলেন। আমার মতো মেয়ে আপনার সাথে যায়না আর...
---ওহ রিয়েলি? এই কথাটা যেন কে আগে তুলেছিলো বলো তো! আমি না তুমি?
নিশীথ কথা কাটায় দোলার মুখ গম্ভীর হয়। ওকে চুপ থাকতে দেখে নিশীথ পুনরায় বলে,
---ভালোভাবে মনে করে দেখো, আমি বলার অনেক আগে তুমি নিজেই আমায় বলেছিলে এসব কথা। তখন আমি কি জবাব দিয়েছিলাম এসব কি ভুলে গেছো? নাকি ক'দিন আগে ইচ্ছা করে তোমার কথা তোমায় ফিরিয়ে দিলাম সেটাই শুধু মনে রেখেছো?
দোলা নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,
---মনে আছে সবই। কিন্তু আপনি কোন কারানে বলেছিলেন তা তো আমি আর জানতাম না, তাইনা? আপনি নিজেই ভাবুন, এতদিন ভালোবাসার কথা বলে আসা মানুষ যদি বিয়ের কথা শুনে হুট করে এমন কিছু বলে তবে যেকেউ সাধারণভাবে কি মনে করবে? অবশ্যই ভুল বুঝবে। তাই আমি নিজেও ভুল বুঝেছিলাম!
---এটাই তো আমার অভিমান, দোলনচাঁপা!
নিশীথ বড় এক শ্বাস ছেড়ে বলে। দোলা বিভ্রান্ত চোখে তাকায়। ওর চাহনি লক্ষ্য করে নিশীথ এগিয়ে আসে। দোলার দুই বাহু চেপে ধরে নিজের দিক টেনে নেয়। হকচকিত দোলার হাতদুটোর অবস্থান হয় নিশীথের উদোম পিঠে। নিশীথ চোখে রাগ মিশিয়ে বললো,
---কেন তুমি আমায় ভুল বুঝলে? কেন তুমি একবারো ভেবে দেখলেনা আমি কোন কারণে তোমার সাথে ওভাবে আচরণ করছি? একটু কি ভাবা যেতোনা? তুমি না হয় রাগ করলে, কেন ইংগেজমেন্টের আগ পর্যন্ত একটা দিন আমায় ফোন দিয়ে বলতে পারলেনা, তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করবেনা। কেন বিয়ের আগে একটাবারও আমার সেদিনের ওমন ব্যবহারের সাফাইজবাব তুমি চাইলেনা, দোলনচাঁপা?
দোলা নিশীথের চোখে চোখ রাখতে পারেনা। মুখ অন্যদিকে করে নেয়। নিশীথের তা পছন্দ হয়না। এক হাতে বাহু ধরে রেখে, অপরহাতে দোলার মুখ নিজের দিক ঘুরিয়ে নেয়। পুনরায় বলে,
---আমার উপর অন্তত এতটুকু আস্থা তোমার থাকা উচিত। তোমার নিশীথ কখনো তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবেনা এটুকু বিশ্বাস রাখা প্রয়োজন ছিলো। তুমি না হয় আমাকে না-ই ভালোবাসলে, কিন্তু আমি যে তোমায় কতটা ভালোবাসি এটা জানা...
দোলা ওকে থামিয়ে বললো,
---আপনার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি যদি না-ই থাকতো তবে কেন সেদিন নিজের বিয়ের কথা শুনে পাগলের মতো আপনার সাথে দেখা করতে পার্কে ছুটে গেলাম বলুন? যেই আমি কক্ষনো কোনো ছেলের সাথে প্রয়োজনের বাহিরে কথা অব্দি বলিনি, সেই আমি শুধুমাত্র আপনার আবদার রাখতে মাঝরাতে দেখা করতে বের হতাম, কেন? আর কেনই বা আমার বিয়ের কথা জানামাত্রই সবার আগে আপনাকে জানাতাম? কোনো জবাব আছে আপনার কাছে?
নিশীথ চুপচাপ চেয়ে রয়। ওর চাহনি দেখে মনে হয় যেন দোলার চোখেমুখে নিজের প্রতি অনুভুতি খুজার চেষ্টা করছে। এরই মাঝে দোলা আবারও বলে,
---এটা সত্যি যে, আমি বাসায় ফিরে রাগের বশে পাত্রের ব্যাপারে কোনোকিছু না জেনেই হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু মাথা ঠান্ডা হওয়ার পরে আমার খটকা লাগে। আমার মনে হয় আপনার এমন ব্যবহারের পেছনে হয়তো কোনো কারণ আছে, হয়তো আংকেলের সাথে আপনার ঝগড়া হয়েছে অথবা অন্য কোনো কারণে আপনি আপসেট ছিলেন যার কারণে ওমন আচরণ করেছিলেন। এরপর আ..
---তবে কেন পরে আমার সাথে যোগাযোগ করোনি? কেন আন্টির থেকে ছেলের ব্যাপারে শুনতে চাওনি, বিয়ের জন্য মানা করোনি?
---আরে ভাই, সেটাই বলছিলাম। থামুন তো! এত অধৈর্য হলে হয়? আমি তো বলছিই!
নিশীথকে থামাতে দোলা হাপিয়ে যায়। একটা মানুষ এত অধৈর্য হয় কিভাবে ও বুঝেনা! দোলার কথা মেনে নিশীথ চুপ হয়ে যায়। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। দোলা হাফ ছেড়ে বলে,
---আমি মোটেও অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইনি। বরং, আপনার ব্যাপারে মা-কে বলার জন্যই ওদিন রাতে বের হয়েছিলাম রুম থেকে। সে সময় মার রুমে ঢুকে তাকে ফোনে কথা বলতে শুনি। আমি চলে আসছিলাম এমন সময় ওনার মুখে আপনার নাম শুনে থেমে যাই। এরপর আপনাদের দুজনের বলা বিয়ের ব্যাপারে কিছু কথোপকথন শুনে ফেলি। তখন আমি চমকে যাই, একপ্রকার থমকে যাই। মা আমাকে দেখার আগেই দ্রুত রুমে ফিরে এসে সবকিছু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে থাকি। একদিকে আপনি আমার সাথে সব জেনে-বুঝে এমন করলেন, অন্যদিকে মা নিজেও সবকিছু জানে তবু আমায় বলছেনা বিষয়টা আমায় বেশ ভাবায়! ইংগেজমেন্টের আগ অব্দি এ নিয়ে চিন্তা করি কিন্তু কারণ খুজে পাইনা।
দোলা একটু থামে। থেমে নিশীথের হাত ধরে বলে,
---এক পর্যায়ে আমি ভেবেছিলাম হয়তো আপনি আমায় সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এসব করেছিলেন তাই ইংগেজমেন্টের দিন আসবেন। আমি ধৈর্যের সাথে আপনার অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু ইংগেজমেন্টের দিন আপনি যা বললেন তাতে আমি কনফিউজড হয়ে যাই। আমি বুঝিনি আপনি কেন আমায় শা'স্তি দিতে চেয়েছিলেন। যেখানে আমার কোনো দোষই নেই! এজন্যই আজ সবার আগে আপনার থেকে জবাব চাই। এবার বলুন আমার ভুলটা কোথায়?
নিশীথ দোলাকে ছেড়ে দেয়। ও কি বলবে ঠিক ভেবে পায়না! যতদূর সে বুঝলো দোষটা ওদের কারোরই না, দোষটা পরিস্থিতির। দুজনই দুজনের জায়গা থেকে ঠিক কিন্তু একজনের দিক থেকে অপরজন দোষী। তবে কি করবে ওরা? নিশীথ ধীর গলায় বলে,
---সবই বুঝলাম। যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন আর কি করার? বাদ দাও!
নিশীথ বিছানায় চলে যায়। খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে। দোলা শান্ত নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নিশীথের পানে। যেন ও বুঝে, নিশীথ কি ভাবছে। ও নিজেও ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। নিশীথের শিওরে বসে চুপিসারে। পুরুষালি হাতের উপর আলতো করে রাখা কোমল হাতের স্পর্শ পেতেই নিশীথ চোখ মেলে তাকায়। পাশ ফিরে দোলাকে বসে থাকতে দেখে। দোলা মাথা নিচু করে বলে,
---হয়তো আমি আপনার মতো করে আপনাকে ভালোবাসতে পারবোনা, নিশীথ। এ কথাটা আজ নয়তো কাল আপনাকে মেনে নিতেই হবে। প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা, তাদের ভালোবাসার ধরন, প্রকাশভংগি আলাদা। আমরা যেভাবে চাইবো সবকিছু তো সেভাবে হবেনা। জীবন আমাদের সবসময় সেটা দেয়না যেটা আমরা চাই, বরং জীবন আমাদের ওটাই দেয় যেটা আমাদের প্রয়োজন! আমি আমার মতো করে আপনাকে ভালোবাসবো, আপনি আপনার মতো করে! জানেন, আমার বাবা বলতেন ভালোবাসা হলো রংধনুর সাত রঙের মতো। যার প্রত্যেকটা রঙ আলাদা। একটার সাথে আরেকটার কোনো তুলনা হয়না। কিন্তু কোনোটার সৌন্দর্য অপরটার চেয়ে কম নয়! মানুষের জীবনে ভালোবাসার সার্থকতাও ঠিক এখানেই। আমি কি বুঝাতে পেরেছি?
নিশীথ মুগ্ধ হয়ে শুনলো দোলার প্রত্যেকটা কথা। মেয়েটা অল্পবয়সেই এত্ত ম্যাচিউরড। এত গোছানো ওর প্রত্যেকটা কথা! নিশীথের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মুগ্ধতা ছেয়ে যায় নিজের ভালোবাসার প্রতি। দোলনচাঁপার মতো স্বচ্ছ মনের মেয়েকে ভালোবেসে নিজেকে ধন্য মনে হয় ওর! নিশীথ তৎক্ষণাত উঠে বসে। হুট করেই দোলাকে টেনে চেপে ধরে বক্ষপিঞ্জরে। মেয়েটাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নিশীথের! দোলাও নিশীথের ডাকে সাড়া দেয়। দু'হাতে নিশীথকে আগলে ধরে রাখে! মিনিট পাঁচেক পরে ওকে ছেড়ে দেয় নিশীথ। দোলাকে কি যেন দেখানোর জন্য ফোন খুজে আশেপাশে।
অতঃপর মাথা চাপড়ে বলে,
---ওহ নো! শাওয়ারে যাওয়ার টাইম ফোন নিয়ে বেরিয়েছি। ওটা মেইবি বাইরে রেখেই চলে এসেছি। পাঁচ মিনিট দিবে, দোলনচাঁপা? ফোনটা নিয়ে আসি!
দোলা মাথা নাড়তেই নিশীথ গায়ে টিশার্ট চাপিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ফোন খুজে রুমে আসতে আসতে দশ মিনিট পেরিয়ে যায়। রুমে ঢুকে দরজা লক করে বিছানার কাছে যেতেই নিশীথ লক্ষ্য করে দোলা বিছানায় হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে! নিশীথ মনে মনে খানিকটা হতাশ হলেও কাছে এগিয়ে দোলার কাছে যায়। ঘড়িতে রাত ১.৩০টা পার হয়ে গেছে ততক্ষণে! এ সময়টা ঘুম আসাই স্বাভাবিক! তারপর যত ধকল গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে আজকে!
নিশীথ দোলাকে ঠিকভাবে শুয়ে দেয়। দোলা পাশ ফিরে ওর দিক হয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমায়। নিশীথ ওর গায়ে কাথা টেনে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পড়ে। রাত গভীর হতেই বাতাসের সাথে টবে ফোটা দোলনচাঁপার সুবাস নাকে এসে লাগে। শ্বাস টেনে ঘ্রাণ নিয়ে নিশীথ পাশ ফিরে ঘুমন্ত দোলনচাঁপার দিকে তাকায়। খানিকটা ঝুকে গাঢ় এক চুমু একে দেয় মেয়েটার কপালে। দোলা নড়ে ঘুমের ঘোরে আরেকটু কাছে চলে আসে। নিশীথ সাদরে ওকে দু'হাতে বুকের মাঝে আগলে নেয়।
আজকের রাতটা ওর কাছে স্বপ্নের মতো লাগে!
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
৪৮ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন