উপন্যাস : দোলনচাঁপার সুবাস
লেখিকা : তাসফিয়া হাসান তুরফা
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং
লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফার “দোলনচাঁপার সুবাস” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা |
৫৪ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
দোলনচাঁপার সুবাস || তাসফিয়া হাসান তুরফা (পর্ব - ৫৫)
এসির কৃত্তিম হিমশীতল বাতাসে ক্ষণিকের মাঝেই তন জুড়িয়ে গেলেও মন জুড়াতে পারলোনা আয়মান সাহেবের। কিছুক্ষণ একিভাবেই বসে থাকলেন তিনি। ভাবতে লাগলেন আজ রাস্তায় দেখা সে দৃশ্যের কথা!
প্রচন্ড ব্যস্ত রাস্তায় জ্যামে বসে বিরক্ত সবাই। আয়মান সাহেবও ব্যতিক্রম নন, গাড়িতে বসে বসে ফোন ঘাটছিলেন। একসময় বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন,
---কাদের, এই জ্যাম ছাড়তে কতক্ষণ লাগতে পারে?
---১০ মিনিট তো লাগবেই, স্যার। সিগনাল দিছে সামনে। এই রুটে সহজে ছাড়েনা।
আয়মান সাহেব হতাশ ভাবে মাথা নাড়লেন। থামা গাড়িতে বসে থাকতে একপ্রকার দম বন্ধ লাগছে। তাই চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে কি হচ্ছে দেখতে লাগলেন। রাস্তায় তার বিপরীত সাইডে একটি বাইক তার চেনা চেনা লাগলো। কি মনে করে উকি দিতেই আয়মান সাহেবের সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হলো। বাইকটা তার ছেলের। নিশীথ হেলমেট পড়ে বসে আছে, ওর পেছনে বসে আছে দোলা। আয়মান সাহেব ভাবলেন, এই গরমে জ্যামের মাঝেও কেন হেলমেট পড়ে আছে তার ছেলে? বংশ পরম্পরায় ওদের সকলের রক্ত গরম। শরীরের গরমটাও একটু বেশি। সে হিসেবে এখন ওনার মতো নিশীথেরও তো প্রচুর গরম লাগার কথা! আয়মান সাহেবের কথা সত্যে পরিণত হলো খানিকবাদেই, যখন উনি দেখলেন নিশীথ হঠাৎ করে মাথা থেকে হেলমেট খুলে ফেললো। আয়মান সাহেব দেখলেন, ঝামে ক্লান্তিতে কেমন জর্জরিত হয়ে আছে তার ছেলেটা। খোলা বাতাসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিভাবে! বাপের হৃদয়ে গ্লানি হানলো যেন! ছেলেটা তার কষ্ট করছে। কখনো এসির বাইরে না থাকা ছেলেটা এত গরমে কিভাবে সব ম্যানেজ করছে কে জানে? আয়মান সাহেব গাড়ির জানলা খুলে দিলেন। উনার বেশ রাগ হলো দোলার উপর। সব দোষ দোলার! কি এমন হতো এই মেয়েটা তার ছেলের জীবনে না এলে? তবে তো অযথা নিশীথ রাগ জিদ করে আলাদা থাকতোনা আজ তার থেকে! দুটো মাত্রই সন্তান তার। একটা দেশের বাহিরে, আরেকটা দেশে থেকেও কাছে নেই। বাবা-মার জন্য এর চেয়ে বড় কষ্টের আর কিছু হতে পারে?
এসব ভেবে তার সমস্ত আক্রোশ পড়লো দোলার উপর! দেখলেন কেমন খোলা হাওয়ায় পিছে বসে আছে ও আরাম করে। এদিকে তার ছেলেটা একাই এত কষ্ট করছে! সারাদিন অফিস করে আবার ওকে ভার্সিটি থেকে নিয়ে বাসায় ফিরে। এত কষ্ট করার কি দরকার ছিলো? সে কি চাইলেই পারতোনা নিশীথকে রাজি করতে তালুকদার বাড়িতে থাকার জন্য? তবে তো ওদের দুজনের সংসারটাই সহজ হতো।মেয়েমানুষের এত ইগো অহংকার দেখালে হবে! তার ছেলে একাই সব করে যাচ্ছে। আয়মান সাহেব ভেবে পাননা, কি এমন আছে ওই মেয়েটার মাঝে যে ওর জন্য নিশীথ এতটা পাগল? জবাব তিনি জানেন না। হয়তো কখনো জানবেনও না! ফলে একা একাই রাগে ফোসফাস করলেন গাড়ির ভেতর। এদিকে তার ফোসফাস শুনে দারোয়ান কাদের বললো,
---স্যার, জানলাটা লাগায়ে দ্যান। গরম লাগবে আপনার।
আয়মান সাহেব জানলা লাগাতে যাবেন এমন সময় আবারো রাস্তার ওপাশে চাইতেই তার চোখে পড়লো দোলা নিজের ওড়না দিয়ে একমনে নিশীথের ঘামে ভরা মুখ মুছে দিচ্ছে। আয়মান সাহেব কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেন। এতক্ষণ দোলাকে নিয়ে মনে মনে যা ভাবছিলেন তা কিছুটা হলেও ভুল গেলেন। এ মুহুর্তে ওদের দুজনকে দেখতে একটি সুস্থ স্বাভাবিক হাসিখুশি দম্পতির চেয়ে কোনো অংশে কম লাগছেনা। আয়মান সাহেবের মনে পরে গেলো নিজের পুরনো দিনগুলির কথা। বিয়ের পর পর আসমাও তার প্রতি এমনই যত্নশীল ছিলো। উনি বাসায় যাওয়ার সাথে সাথেই ঠান্ডা পানি এগিয়ে দিতো নয়তো ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিতো। যেভাবেই হোক, ওনার কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করতো! এ মুহুর্তে দোলাও যেন তাই করছে! শুধু পার্থক্য এটাই, আসমাকে তিনি মন থেকে ভালোবাসতে পারেননি। কিন্তু নিশীথ মনপ্রাণ দিয়ে দোলনচাঁপাকে ভালোবাসে। আয়মান সাহেবের ভাবনার মাঝেই নিশীথ পেছন ফিরে দোলার দিকে তাকালো। তাতে ওর হাসি হাসি মুখটা নজর কাড়লো ওনার! সত্যি বলতে বেশ অনেকদিন পর তিনি নিশীথকে এভাবে হাসতে দেখলেন। কেননা নিশীথ অফিসে যতক্ষণ থাকে, তাদের তেমন দেখাই হয়না মিটিং বাদে। তাই এতদিন পর ছেলের মুখে হাসি দেখে আয়মান সাহেব বেশ প্রসন্ন অনুভব করলেন। তার হঠাৎ মনে হলো এতক্ষণ এসির বাতাস তাকে যতটা না ঠান্ডা করতে পেরেছে, ছেলের মুখের এক চিলতে হাসি মুহুর্তেই তার অন্তরকে দ্বিগুণ শীতল করে দিলো!
_________________________
আজ ঢাকা শহরে যেন গরমটা একটু বেশিই। কদিন বৃষ্টি হয়ে আবহাওয়া একটু ভালো হলেও এখন আবার আগেকার ন্যায় গরম ফিরে এসেছে। তার মধ্যে ইলেকট্রিসিটি গেলে তো কথাই নেই! এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা! দুজনের খাওয়া শেষে দোলা রান্নাঘরে থালাবাসন ধুচ্ছিলো। এমন সময় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় হঠাৎ চারদিক নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়ায় ও ভয় পায়। এক প্রকার জোরেশোরে চিল্লিয়ে উঠে মেয়েটা। নিশীথ সবেমাত্র বাথরুম থেকে বেরিয়েছে। দোলার চিৎকার শুনে গলা উচিয়ে বলে,
---ভয় পেয়োনা। রান্নাঘরেই থাকো, আমি আসছি।
---আচ্ছা!
দোলা নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে উত্তর দেয়। নিশীথ ফোনের লাইট জ্বা'লিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোতেই দোলার দেখা পায়। ওকে এবং লাইট দেখে দোলা ছুটে চলে আসে ওর কাছে! বলাবাহুল্য, ঘরে কোনো মোমবাতি নেই। নতুন সংসারে এখনো অনেক জিনিসপত্র কেনা বাকি। টুকটাক ঘরের জিনিস কেনা হলেও মোমবাতির মতো সূক্ষ্ম জিনিস কেনার কথা ওদের কারও মাথায় আসেনি। কিছুক্ষণ নীরবতার পর নিশীথ বলে ওঠে,
---কারেন্ট চলে যাবে এটা আমার তো মাথায়ই আসেনি, নয়তো মোমবাতি কিনে আনতাম। এখন কি করবো? ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে রাখা ছাড়া তো কোনো উপায় দেখছিনা!
দোলা কিছুক্ষণ ভাবে কি করবে। খানিক বাদে বলে,
---ছাদে যাবেন?
---এ সময়?
নিশীথ খানিকটা অবাক হয়েই বলে! ফোনের আলোয় দেখা গেলো, দোলা ভ্রু কুচকে ফেললো। নিশীথের ফোনে সময় দেখে বললো,
---হ্যাঁ, দশটা বাজে কেবল! কেন এ সময় ছাদে যেতে মানা আছে?
ওর কথার ধরনে নিশীথ হেসে ফেলে। এক হাতে দোলার গাল চেপে ধরে বলে,
---মানা যদি থাকতো তাও তোমার ইচ্ছে হলে আমি ঠিকই নিয়ে যেতাম। চলো!
দোলার হাত ধরে বাসার গেট লক করে দুজনে বেরিয়ে পড়ে ছাদের উদ্দেশ্যে। ওরা যে বাসায় উঠেছে, তা পাঁচতলা। ওরা তিনতলায় থাকায় উঠতে বেশিক্ষণ লাগলোনা! ছাদের দরজা লাগিয়ে কিছুক্ষণ খোলা আকাশের নিচে হাটাহাটি করলো দুজনে! ঘরের ভেতর যতটা অন্ধকার, বাইরে ততটা নয়। বরং রোডলাইটের আলোয় রাস্তা থেকে সামান্য আলো আসছে এদিকেও। তার উপর আকাশে চাঁদটাও আছে! সবমিলিয়ে মন্দ লাগছেনা ছাদে থাকতে। নিশীথ হাটতে হাটতে রেলিঙের কাছে চলে গেলো। ছাদে কিছুটা বাতাস বইছে, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল্লাগছে! ওর পাশেই রেলিং ঘেষে দাড়ালো দোলা। নিশীথ বললো,
---ছাদে আসার কথা বলে ভালোই করেছো। এখানে এসে একটু ভাল্লাগছে! ঘরের চেয়ে গরম কম।
---আগে কারেন্ট গেলে আমরা ভাইবোনরা ছাদে চলে আসতাম। প্রথম প্রথম মা মানা করলেও পরে মা-ও চলে আসতো আমাদের সাথে!
পুরনো স্মৃতি মনে করে দোলা হেসে বললো। নিশীথ বিস্মিত হয়ে বললো,
---বাহ! ভালোই মজা করতে তোমরা। আর আমি লাস্ট কবে কারেন্ট চলে যাওয়া টের পেয়েছি নিজেরও মনে নেই। কারেন্ট গেলেও জেনারেটরে সবই চলতো! এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম কারেন্ট গেলে কেমন লাগে!
দোলা আড়চোখে তাকালো নিশীথের দিকে। এতক্ষণে চোখ সয়ে গেছে আলো-আধারের এ খেলায়। তাই এই আবছা অন্ধকারেও নিশীথকে দেখতে খুব একটা বেগ পেতে হলোনা ওর! নিশীথ একমনে চেয়ে আছে রাস্তার দিকে, যেখানে একটু পরপর হেডলাইট জ্বালিয়ে একেরপর এক গাড়ি চলছে। আচ্ছা, নিশীথ কি ওর পুরনো জীবন মনে করে আফসোস করছেনা তো? দোলার মনে প্রশ্ন জাগে! মনে জমে আত্মগ্লানি ও কষ্ট। নিশীথ ওকে বিয়ে করে কোনো ভুল করলোনা তো? ও কি আসলেই নিশীথের সাজানো-গোছানো জীবনটাকে নষ্ট করে দিলো?
দোলার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ নিশীথ ওকে কাছে টেনে নিলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে গেলো দোলা। ওর মাথা থেকে কাপড় পড়ে গেলো। খোলা চুল বাতাসে উড়তে লাগলো। সেই চুলে মুখ গুজে নিশীথ বড় করে এক শ্বাস নিলো। মাথা তুলে দোলার গালের সাথে গাল ঠেকিয়ে বললো,
---আমি সুখে আছি, দোলনচাঁপা। একাকী বিলাসবহুল জীবন থেকেও ভীষণ সুখে আছি। তুমি আমার পাশে থাকলে আমি পৃথিবীর সব কষ্ট মাথা পেতে নিতে রাজি! এসব তো কিছুই নয়!
দোলার চোখদুটো বিস্ময়ে অতিশার্যে বড় হয়ে এলো। এ অন্ধকারের মাঝেও ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরলো। নিশীথের দিক তাকিয়ে ওর মুখভঙ্গি দেখার চেষ্টা করলো। নিশীথ ওর মনের দ্বিধা বুঝলো কিভাবে? আশ্চর্য!
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
৫৬ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা তাসফিয়া হাসান তুরফা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই তা কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হইবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন