উপন্যাস : বেশ্যা
কবি : অর্পিতা ঘোষ চক্রবর্তী
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : অক্টোবর ২০২০
পশ্চিমবঙ্গের তরুণ লেখিকা অর্পিতা ঘোষ চক্রবর্তীর “বেশ্যা” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২০ইং সালের ৩রা অক্টোবর থেকে লেখা শুরু করে শেষ করেছেন একই সালের ১০ই অক্টোবর।
![]() |
বেশ্যা || অর্পিতা ঘোষ চক্রবর্তী |
২য় পর্ব পড়তে এখানে ট্যাপ/ক্লিক করুন
বেশ্যা || অর্পিতা ঘোষ চক্রবর্তী (পর্ব - ৩)
প্রবাদ আছে চোরের দশ দিন গৃহস্থের এক দিন। সেরকমই একদিন রুপন সন্ধ্যেবেলায় চন্দ্রানীর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে ঠিক তখনই চন্দ্রানী সন্ধ্যে দিয়ে কাপড় ছাড়ছিলো। চন্দ্রানীকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরতেই চন্দ্রানী এক ধাক্কা দিয়ে রুপনকে ফেলে দিল। রূপণের মাথাটা গিয়ে লাগল খাটের কোনায়। মাথা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছিল। নিজের রক্ত দেখতেই রুপনের হিংস্রতা দশগুণ বৃদ্ধি পেলো। রুপন চন্দ্রানীর চুলের মুঠি ধরে টেনে তাকে বিছানায় ফেলে তার সাথে জোর জবরদস্তি করতে লাগল। চন্দ্রানী কাকুতি মিনতি করে রুপনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল ঠিকই কিন্তু রুপনের মতন অমানুষদের কান পর্যন্ত কোনো অনুরোধই পৌঁছায় না। ঠিক সেদিনই তপন অসুস্থতার কারণে দোকান থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে রুপন আর চন্দ্রনীকে দেখে ফেলেছিল ঘনিষ্ঠ অবস্থায়। চন্দ্রানীর কোনো কথা সেদিন তপন শোনেনি। রুপনকে একটা চর মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল শুধু। আর চন্দ্রানীকে ঘৃণায় আর দুঃখে কিছুই বলে উঠতে পারেনি। পরের দিন তপন চন্দ্রানীকে জিজ্ঞেস করেছিল, “চন্দ্রানী আমার কি দোষ ছিল যে তুমি আমাকে এভাবে ঠকালে?”
তপন আরও বলেছিল, “আমিতো তোমার আর তোমার মা-বোনের প্রতিও সব দায়িত্ব পালন করেছি। তবুও তুমি আমার সাথে এমন টা করতে পারলে?” চন্দ্রানী বলেছিল, “আমি তোমাকে ঠকাইনি, আমার পুরো কথাটা একবার শোনো। আমি অনেক দিন থেকেই তোমাকে বলতে চেয়েছি, কিন্তু বলতে পারিনি। তোমার ভাই আমাকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করে গেছে। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে গেছে।” এটুকু বলতেই তপন ধমক দিয়ে চন্দ্রানীকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, “নোংরা মেয়েছেলে, এখন ধরা পড়ে গেছিস বলে আমার ভাইয়ের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছিস। তোর সাথে আমি আর সংসার করতে পারব না, তোর মতন নোংরা মেয়েছেলের মুখ দেখাও পাপ।”
চন্দ্রানী আর কোন জবাব দিতে পারেনি। কারণ যে যাই বলুক না কেন কোনটাই আর তপনের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই সে চুপ করে তপনের সবটাই মেনে নিয়েছিল, চন্দ্রানীর কাছে রুপনের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছিল না। আর তপন নিজের চোখে যা দেখেছে সেটা বিশ্বাস করাটাই স্বাভাবিক। তারপরেও অবশ্য কিছুদিন তপনের বাড়িতেই ছিল চন্দ্রানী। কিন্তু শেষে একদিন তপন ডিভোর্স পেপার হাতে ধরিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বিদায় হতে বলে।
চন্দ্রানীকে বাড়ি থেকে তাড়াতে পেরে রুপন খুব খুশি হয়েছিল। দাদার সাথে তার নিজের সম্পর্ক খুব বেশি ভালো না হলেও চন্দ্রানীর ওপর প্রতিশোধ নিতে পেরে মনে মনে আনন্দ অনুভব করছিল। চন্দ্রানীর আড়াই বছরের সাজানো গোছানো সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো চোখের সামনেই। যে ভয়টাই সে বারংবার পেত, সেই ভয়টাই তাকে ছুঁয়ে ফেলল। কোথাও যাবার জায়গা না থাকায় তাকে আবার বাপের বাড়িতেই ফিরে আসতে হল।
অপরদিকে চন্দ্রানীর বোনের সাথে রুপনের একটা সম্পর্ক রয়েছে। চন্দ্রানীর বোন ইন্দ্রানী রুপনকে ভালোবাসে। রুপন ওকে বিয়ের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল এবং ইন্দ্রানীদের বাড়িতে রুপনের অবাদ যাতায়াতের কারণে তাদের দুজনের ঘনিষ্ঠতা খুব বেশিই ছিল। উচ্চমাধ্যমিক দেবে ইন্দ্রানী এবারে। তপনের সাথে ডিভোর্স নিয়ে চন্দ্রানীর মা আর ইন্দ্রানী দুজনেই ভীষন অখুশি। তারা দুজনের কেউই চন্দ্রানীকে সাপোর্ট করে না। দুজনেই চন্দ্রানীর ভুলগুলো খুঁজে বের করতে প্রস্তুত। তার উপর ইন্দ্রানীকে রুপন ভুলভাল বুঝিয়ে দিদির বিপরীতে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। চন্দ্রানী তার মায়ের কাছে সব খুলে বললে তার মাও বিশ্বাস করে না। কারণ তার মা রুপনকে তার ছোট বোন ইন্দ্রানীর জন্য পছন্দ করেই রেখেছিলেন।
বাড়ির মধ্যে দুটো দল তৈরি হয়ে যায়। একটা দলে চন্দ্রানী একা, আর অপর দলে ইন্দ্রানী আর তার মা। কথায় কথায় উঠতে-বসতে চন্দ্রানীকে খোটা দেয়, কথা শোনায় দুজনে মিলে। আসলে আমাদের সমাজে এখনো মেয়েদের ডিভোর্সের জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। আমাদের সমাজ এখনো ডিভোর্সটাকে মেনে নিতে পারে না। ডিভোর্সি মেয়ে মানেই খারাপ মেয়ে, নষ্ট চরিত্রের মেয়ে। এমনটাই ভাবে সবাই। ডিভোর্সি মেয়েদের সমাজে বেঁচে থাকা দায়, সমাজ তাদেরকে অচ্ছুৎ করেই রাখে।
চন্দ্রানির এক একটা দিন পাড়ার লোক ও বাড়ির লোকের অত্যাচারে ভীষন দুর্বিসহ হয়ে উঠছিল। উঠতে বসতে কথা শুনতে হচ্ছিল তাকে। ঘরের ভেতরে নিজের মানুষদের চেনা মুখগুলোও যে পাল্টে যেতে পারে, সেটা সে বিশ্বাসই করে উঠতে পারছিল না। ঘরে বাইরে সকলেই চন্দ্রানীকে নষ্ট মেয়ে বলতে লাগল। পাশের বাড়ির বিল্টুর বাবা ডিভোর্সের খবর শুনে খুশি হয়ে চন্দ্রানীদের বাড়িতে এসেছিল সমবেদনা জানাতে।
রুপনের যাতায়াতও একইরকম ভাবেই চলছিল। ইন্দ্রানীর সাথে মেলা মেশা ইচ্ছা করেই রুপন বাড়িয়ে দিয়েছিল। ইন্দ্রানীকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, গিফ্ট কিনে দেওয়া সবটাই চলছিল একইরকম ভাবে। তার কারণ রুপন ইন্দ্রানীকে বিয়ে করবে বলে আশ্বস্ত করেছিল চন্দ্রানীর মাকে। উচ্চমাধ্যমিকের পরেই ইন্দ্রানী আর রুপন বিয়ে করে নেবে। আর ইন্দ্রানী বিয়ের পরেও পড়াশোনা করবে এমনটাই কথা হয়েছিল তাদের মধ্যে।
চন্দ্রানী এই বিয়েতে অমত প্রকাশ করায় ইন্দ্রানী বলেছিল, চন্দ্রানী নাকি তাকে হিংসে করে। তাই তার সুখ সহ্য করতে পারছে না। চন্দ্রানী খুব দুঃখ পেয়েছিল, কিন্তু প্রকাশ করেনি কারো কাছে। বারবার না করা সত্ত্বেও ইন্দ্রানী রুপনকেই বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু যখন পরীক্ষার আগে ইন্দ্রানী একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল, স্কুলেই বন্ধুরা ধরাধরি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়, সেদিনই প্রথম জানাজানি হয়ে যায় ইন্দ্রানী সন্তান সম্ভবা। রুপনকে খবরটা জানাতেই রুপন সাফ জানিয়ে দেয় তার পক্ষে এই মুহূর্তে কিছুই করা সম্ভব না। সবে মাত্র নতুন চাকরি, তাও আবার প্রাইভেট কোম্পানী। এই সময় সে কোনো বাচ্চা কাচ্চার দায়িত্ব নিতে পারবে না। ইন্দ্রানীর মা রুপনের হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করে, কিন্তু রুপন কোনো কিছুতেই ইন্দ্রানীর গর্ভের সন্তানকে রাখতে দিতে চায় না। ইন্দ্রানীকে রুপন এমন ভাবে বোঝায় যে, ইন্দ্রানী নিজেও তার নিজের গর্ভের সন্তান কে রাখতে চায় না। চন্দ্রানী বোঝাতে গেলে তাকে যাচ্ছে তাই ভাবে অপমান করে ইন্দ্রানী। ইন্দ্রানী বলে এটা যেতেতু তার গর্ভের সন্তান, সুতরাং রাখবে না নষ্ট করবে সেটা সে বুঝে নেবে। তার বিষয়ে যেন কেউ নাক না গলায়। চন্দ্রানী আর কিছু বলে না, শুধুই নির্বাক দর্শক হয়ে দেখতে থাকে পুরোটা।
ইন্দ্রানী আর তার মা হাসপাতালে গিয়ে চুপে চাপে এবরশন করিয়ে আসে। এবরশনের পর থেকে ইন্দ্রানীর শরীরটা খুব দুর্বল হয়ে যায়। একটা এবরশনের পর মেয়েদের অনেক যত্ন আর ভালো মন্দ খাবারের প্রয়োজন হয়, ওষুধের প্রয়োজন হয়। কিন্তু চন্দ্রানীদের পরিবারের সেরকম সামর্থ্য না থাকায় ইন্দ্রাণীর যত্নে অনেক ত্রুটি হচ্ছিল। রুপনও তারপর থেকে আর তেমন আসা যাওয়া করত না। ইন্দ্রানী অনেক বার রুপনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় নি। ফোন নাম্বারটাও চেঞ্জ করে নিয়েছিল রুপন। ইন্দ্রানী নানান ভাবে রুপনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। ওদিকে পারার লোকেরা কিছুটা হলেও জানতে পেরে যায়। তারা ইন্দ্রানীদের পরিবারের মুখে চুনকালি মাখানোতে উঠে পড়ে লাগে। কোনো কোনো লোক এমনও বলে তাদেরকে নাকি পারা থেকে তাড়িয়ে দিলে ভালো হয়। ভদ্রলোকের পাড়াতে নোংরামি করছে তিন মা মেয়ে মিলে।
তার অনেকদিন পরে একদিন রুপন ইন্দ্রানীদের বাড়িতে বউ নিয়ে এসে উপস্থিত হয়। নতুন বিয়ে করা বৌ দেখাতে নিয়ে এসেছে ইন্দ্রানীকে। রুপনের সাথে তার নতুন বউকে দেখে ইন্দ্রানী মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে। রুপন তার বউকে বলে মাসিমাকে প্রণাম কর। নতুন বউ ইন্দ্রানীর মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। ইন্দ্রানীর মা তাকে আশীর্বাদ দেবে না কি অভিশাপ বুঝেই উঠতে পারছিল।
শারীরিক অসুস্থতার জন্য ইন্দ্রানী আর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারেনি সে বছর। তার একটা বছর নষ্ট হয়ে গেল। অভাবের সংসার কোনমতে দিন কাটছিল ঠিকই, কিন্তু ইন্দ্রানীর শরীরটা যে দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছিল তা চন্দ্রানী আর তার মা ভালো মতনই বুঝতে পারছিল। শারীরিক দুর্বলতা তো ছিলই, তার ওপরে হয়ত কিছুটা পাপবোধ কাজ করছিল ইন্দ্রানীর। তাছাড়া পাড়ার লোকের বাজে মন্তব্য, সব মিলিয়ে একটা বিষাক্ত সাপ যেন দংশন করছিল প্রতিনিয়ত ইন্দ্রাণীর বুকে।
চলবে.....
৪র্থ পর্ব পড়তে এখানে ট্যাপ/ক্লিক করুন
লেখক সংক্ষেপ :
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন