উপন্যাস        :         বেশ্যা
কবি              :         অর্পিতা ঘোষ চক্রবর্তী
গ্রন্থ               :         
প্রকাশকাল   :         
রচনাকাল     :         অক্টোবর ২০২০

পশ্চিমবঙ্গের তরুণ লেখিকা অর্পিতা ঘোষ চক্রবর্তীর “বেশ্যা” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি  ২০২০ইং সালের ৩রা অক্টোবর থেকে লেখা শুরু করে শেষ করেছেন একই সালের ১০ই অক্টোবর।
বেশ্যা || অর্পিতা ঘোষ চক্রবর্তী
বেশ্যা || অর্পিতা ঘোষ চক্রবর্তী

৩য় পর্ব পড়তে এখানে ট্যাপ/ক্লিক করুন

বেশ্যা || অর্পিতা ঘোষ চক্রবর্তী (পর্ব - ৪)


মানুষ যখন ভুল করে তখন সে জ্ঞান হারিয়ে অজ্ঞানতার বশবর্তি হয়েই করে। তারপর যখন তার চোখের সামনে থেকে অজ্ঞানতার পর্দা সরে যেতে থাকে, তখন নিজের করণীয় ভুলগুলোর জন্য আক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ইন্দ্রানীও মনে মনে দংশিত হচ্ছিল। দিদিকে সে কত অপমান করেছিল সেগুলো ভেবে লজ্জিত বোধ করছিল। আর নিজের শরীরের প্রতি অযত্ন করেই চলেছিল। চন্দ্রানী সংসার চালানোর জন্য একটা প্রসাধনী কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেছিল। তার মায়ের বয়সটাও বেড়েছে। বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতার জন্য আর খুব বেশি কাজ কর্ম করতে পারত না সে। অগত্যা চন্দ্রানীর রোজগারটাই তাদের সংসারের একমাত্র ভরসা। চন্দ্রানীর প্রসাধনী কোম্পানীর মাইনে মাত্র চার হাজার টাকা। এই চার হাজার টাকা দিয়ে সংসার চালানো সত্যিই কষ্টকর। তার উপর বোন আর মায়ের ওষুধের খরচ। চন্দ্রানী ওভার টাইম করেও সবটা সামাল দিতে পারছিল না। 

ঠিক সেরকম সময় ইন্দ্রানী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরে। যেখানে সংসার চালানোই দায়, সেখানে কিভাবে ইন্দ্রানীর চিকিৎসা চালাবে তারা? পারার লোকেদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাবেনা। তার কারণ তারা নষ্ট, তাই পাড়ার সবাই তাদেরকে অচ্ছুৎ করে রেখেছে। চন্দ্রানীর কাজের জায়গা থেকে দু চার হাজার টাকা সাহায্য এসেছিল ঠিকই, কিন্তু তা দিয়ে আর কতক্ষন। ইন্দ্রানীর শরীর দিন দিন অনেক বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছিল। রাজনৈতিক নেতাদের ধরে সরকারি ভাবে একটা দুটো কেমো হয়েছিল কিন্তু পরের দিকে কেউই আর কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি।

ঠিক সেরকমই এক সঙ্কটময় মুহূর্তে চন্দ্রানীকে তাদের অফিসের জয়িতা দি বলে, “চন্দ্রা তোরতো খুব টাকা পয়সার দরকার। যেটুকু মাইনে পাস তা দিয়ে কিভাবে সব সামলাস?

চন্দ্রানী নিজের সমস্ত সমস্যার কথা জায়িতাদিকে খুলে বলে। জয়ীতা চন্দ্রানীকে বলে এই ছোট খাটো কাজ দিয়ে তুই সব কিছু কোনোদিনই সামলাতে পারবিনা। চন্দ্রানী জয়িতার কথা বুঝে উঠতে পারে না। তখন জয়িতা চন্দ্রানীকে অল্প সময়ে বেশি টাকা কামাই করার পথ বলে। চন্দ্রানী ছি ছি বলে জয়িতাকে থামিয়ে দেয়। জয়িতা আবার বলে, “একবার ভেবে দেখিস চন্দ্রানি।”

জয়িতাকে থামিয়ে দিলেও চন্দ্রানীর মাথায় কথা গুলো একদম গেঁথে বসে যায়। একদিকে ইন্দ্রানীর ক্যান্সার অপরদিকে সংসার চালানো, তার উপর বয়স্কা মায়ের ওষুধের খরচ। ইনকাম বলতে একটাই প্রসাধনী কোম্পানির চার হাজার টাকা। এসব কথা ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হওয়ার সময় একবার রিক্সার সাথে তার ধাক্কাও লেগে যায়। বাড়ি ফিরে এসে নিজের জীবনের কাহিনীগুলোর আরেক বার স্মৃতচারনা করতে বসে। প্রথম থেকে পর পর এক একটা দৃশ্য চন্দ্রানীর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেই রাত্রে সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি সে। একবার ভেবেছে জয়িতাদির কথায় রাজি হয়ে যাবে, আবার পরক্ষণে ভেবেছে নাহ শেষ পর্যন্ত বেশ্যাবৃত্তি করতে হবে তাকে! বাবার শিক্ষা সংস্কার সেগুলোর কি কোনো মর্যাদা নেই?

কিন্তু সেদিন নিজের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চন্দ্রানী বেশ্যাবৃত্তির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল। তার কারণ নিজের মৃত্যুর চেয়ে মানুষ প্রিয়জনের মৃত্যুকে বেশি ভয় পায়। ইন্দ্রানীর চিকিৎসার জন্য তাকে এই পথে যেতেই হবে। তার জীবনে আর কিবা বাকি ছিল! স্বামী তপন তাকে ভুল বুঝে তাড়িয়ে দিয়েছিল বাড়ি থেকে। বিয়ের আগে বিল্টুর বাবা তাকে ভোগ করতে চেয়েছিল। সেই নোংরা থাবাগুলো যেন তাকে এখনও প্রতি রাতে তাড়া করে বেড়ায়। আর এখন যখন তার আর কিছুই চাওয়া পাওয়ার নেই, তখন কোনো কিছুতেই কিছু আসবে যাবে না। 

জয়িতা বলেছিল, “চন্দ্রা তুই এখনও যেরকম সুন্দর, যেরকম ডাগর ডগোর চেহারা, তুই অনেক রেট পাবি। একবারে অনেক টাকা রোজগার করতে পারবি। আর তোকে ওরা গাড়ি করে হোটেলে নিয়ে যাবে, আবার দিয়েও যাবে। তোর কোনোরকম ঝামেলা পোহাতে হবে না। এমনকি কেউ জানতেও পারবে না।” চন্দ্রানী সেদিন নিজের সমস্ত পবিত্রসত্তা জলাঞ্জলি দিয়ে জয়িতাকে জানিয়ে দিয়েছিল সে রাজি বেশ্যাবৃত্তির জন্য।

চন্দ্রানী দেখতে অসাধারণ সুন্দরী। তার রূপের ছটায় যেন চাঁদও লজ্জা পেয়ে যায়। যে কোনো পুরুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে সে। গায়ের রং যেন কাচা সোনা। চোখ দুটো যেন পদ্ম ফুলের কুঁড়ির মতন। শরীরে যৌবন যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চন্দ্রানীর শরীর যেন পাহাড়ের আঁকা বাঁকা রাস্তার মতন ঢেউ খেলানো। চুল কাঁধ বেয়ে নিচে নেমে কোমর ছুঁই ছুঁই করছে। তার চুলের মিশিকালো অন্ধকারে যে কেউ এক নিমেষেই ঘুমিয়ে থাকতে পারে আজীবন কাল।

বছর পঁচিশের একটা মেয়ে জীবনের চড়াই উৎরাই পার করে আজ সে সব বিষয়েই অভিজ্ঞ। এমনকি জয়িতাকেও জানিয়ে দিয়েছে, সে টাকা কামানোর জন্য যেকোনো কিছু করতেই রাজি। জয়িতা তাকে বলেছে, “কাল একটু সেজেগুজে অফিসে চলে আসিস। বাদ বাকিটা আমিই ব্যবস্থা করে নেব।”

অনেকদিন পর সে আয়নার সামনে দাড়িয়ে একটা সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছিল। কপালে ছোট্ট একটা সবুজ টিপ। চুল টাকে আঁচরে নিয়ে একটা বিনুনি করেছিল প্রথমে, তারপর আবার বিনুনী খুলে ফেলে শুধু মাত্র একটা গাডার দিয়ে চুলটা বেঁধে নিয়েছিল। একবার ভেবেছিল ঠোঁটে একটুও লিপস্টিক লাগাবে না, কিন্তু পরক্ষণেই আবার হালকা রঙের লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁটটাকেও রাঙিয়ে নিয়েছিল চন্দ্রানী। 

বাড়িতে মাকে বলেলো আজ তার বাড়ি ফিরতে দেরি হতে পারে। তার মা তাকে কারণ জিজ্ঞেস করায় সে উত্তর দেয়, জয়িতার বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে। ইন্দ্রানী পাশের চৌকিতে শুয়ে ছিল। ইন্দ্রানীর মাথায় হাত বুলিয়ে চন্দ্রানী বলে, “আমি সব ঠিক করে দেবোরে বোন, তুই একদম ঠিক হয়ে যাবি।” তারপর সে উর্ধস্বাসে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েছিল অফিসের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় রুপনের সাথে তার দেখা হয়ে যায়। চন্দ্রানীকে অত সাজ গোজ করে বেরোতে দেখে রুপন টিটকিরি কাটে। চন্দ্রানী সে সব কিছু পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে চলে যায়। 

অফিসের কাজ শেষ করার পর জয়িতা তাকে বড় রাস্তার ধারে এক জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে কালো কাঁচওয়ালা একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। জয়িতা তাকে ইশারা করে বলে সেই গাড়িতে উঠে বসতে। চন্দ্রানী প্রথমে ভয় পেয়ে বসতে চায়না। তারপর নিজের ভয়ের সাথে নিজেই যুদ্ধ করে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যায়। গাড়ি চলতে শুরু করে। গাড়ির ভেতর একজন বয়স্ক লোক, প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স হবে। কিছুদূর গাড়িটা যেতে না যেতেই গাড়ির ভেতরকার লোকটা চন্দ্রানীর হাত ধরে নাম জিজ্ঞেস করে। চন্দ্রানী তাড়াতাড়ি করে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে নিজের নাম বলে। গাড়ির মধ্যকার লোকটা বলে, “এই ব্যবসায় তোমার নামটা বদলে নিতে হবে। আজ থেকে তোমার নাম রোজি।” চন্দ্রানি মাথা নেড়ে সম্মতিতে হ্যাঁ বলে। সেদিন থেকে চন্দ্রানী পরিণত হয় রোজিতে। 

লোকটার দামী গাড়ি একটা বিলাস বহুল হোটেলের ভেতর ঢুকে যায়। অত বড় হোটেলের ভেতরে চন্দ্রানী কোনোদিন যায় নি। গাড়ি থেকে নেমে চন্দ্রানী হোটেলের চারিদিকে চোখ ঘোরাতে থাকে। রিসেপশন থেকে একটা মেয়ে এসে চন্দ্রানীকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি মিসেস রোজি?” চন্দ্রানী শুধু ঘাড় নেরে হ্যাঁ বলে। মেয়েটা মিসেস রোজির হাতে একটা হোটেলের রুমের চাবি দিয়ে বলে রুম নাম্বার ১০১।

চন্দ্রানী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পা দুটো মনে হয় কেউ মাটির নিচ থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তাই সে পা সরাতেই পারছে না। রিসেপশনের মেয়েটা মিসেস রোজির পায়ে হাত দিতেই সে চমকে ওঠে। “রিসেপশনের মেয়েটা বলে, “ম্যাডাম আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন? আমি কি আপনাকে রুমে দিয়ে আসবো?” ম্যাডাম তখনও শুধুই ঘার নাড়ে।

মেয়েটা চন্দ্রানীকে হাত ধরে রুমে নিয়ে এসে বলে, “এই যে আপনার রুম, ভেতরে গিয়ে রেস্ট নিন সব ঠিক হয়ে যাবে।” চন্দ্রানী রুমের ভেতর ঢুকেই একজন লোককে দেখতে পেল বেশ ভারী ভারী চেহারা। লোকটার চোখে খিদেও দেখতে পেল চন্দ্রানী। তাকে হাতের নাগালে পেয়েই খাবলা খাবলি শুরু করে দিয়েছিল লোকটা প্রথমেই। প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্বেও চন্দ্রানীকে নিজের শরীর একটা অচেনা লোককে বিক্রি করতে হলো। বিক্রয়মূল্য হিসেবে সে পেল নগদ কুড়ি হাজার টাকা। কুড়ি হাজার টাকা লোকটা সুদে আসলে উসুল করেও নিয়েছিল। রাতের আগেই কালকাঁচের গাড়িটা আবার তাকে রাস্তার মোড়ের মাথায় নামিয়ে দিয়ে গেল। 

সে টাকাগুলো নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পথে অনেক খাবারদাবার বাজার করে ঘরে নিয়ে এসেছিল। এত বাজার দেখে চন্দ্রানির মা একটু অবাক হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অভাবের সংসারে খাবারটাই আসল কথা। কেউ জানতে চায়না কোথা থেকে আসলো আর কিভাবে আসলো। ইন্দ্রানীর পরের কেমোর জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করতে চন্দ্রানী আরও অনেক বেশি করে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছিল। চন্দ্রানীর ইনকামের একটা ভাগ জয়িতাকে দিতে হয়। তার কারণ জয়িতা এই গোপন বেশ্যা বৃত্তির একজন কেয়ার টেকার।

চলবে.....

৫ম পর্ব পড়তে এখানে ট্যাপ/ক্লিক করুন


লেখক সংক্ষেপ

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন