উপন্যাস : শরম
লেখিকা : তসলিমা নাসরিন
গ্রন্থ : শরম
প্রকাশকাল :
জনপ্রিয় লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বহুল আলোচিত উপন্যাস 'লজ্জা'। ১৯৯৩ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের প্রথম ছয় মাসেই বইটি পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বৈধ কপি বিক্রি হয়। এরপর ধর্মীয় মৌলিবাদিদের একতরফা বিতর্কের মুখে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালিন বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি লেখার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে।পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা হয়েছিলো লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। সেই অনুভূতিকে পুজি করে তিনি লিখলেন নতুন উপন্যাস 'শরম'। এ উপন্যাসটি কবিয়াল পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
![]() |
শরম || তসলিমা নাসরিন |
11111111111111111111111111111
১৩ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
শরম || তসলিমা নাসরিন (পর্ব - ১৪)
জুলেখার খুব একা লাগে। বুকের ভেতর চিনচিন করে কষ্ট হতে থাকে। মামার বাড়ির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সে বাইরের দিকে। বিশাল একটা আকাশ। থই থই করছে শূন্যতা। সময়টা বোধহয় এই সময়ই যখন মেয়েরা আত্মহত্যা করে। জুলেখা আত্মহত্যা করতে চায় না। বাঁচতে চায়। বাঁচতে সে বরাবরই চেয়েছিল। তার মতো করে। কিন্তু পারেনি। তার পরও এই সমাজ এই পরিবার তাকে যেভাবে রাখে, যতটুকু সুযোগ দেয় বাঁচার সেভাবেই ততটুকুই সে থাকতে চেয়েছিল। ওর মধ্যেই যদি সে তার রুচিমতো জীবন সামান্যও যাপন করতে পারে। না, বেশি কিছু জুলেখা কখনও চায়নি। বড় বড় স্বপ্নও সে দেখেনি কোনদিন। সুরঞ্জন তার অপহরণকারী থেকে প্রতিশোধপরায়ণ শত্রু থেকে প্রেমিকে উত্তরণ ঘটা একজন। সুরঞ্জনের সঙ্গে সম্পর্কে কোনও স্বপ্ন তৈরি হয় না। আজ মন কেমন করছে, আজ শরীরে বান ডেকেছে, আজ হৃদয়ের একূল ওকূল দুকুল ভেসে যেতে চাইছে, তখন সুরঞ্জন। ততক্ষণই সে, যতক্ষণই সে আছে। এ রকম কত হয়েছে যে সে আসবে বলে আসেনি, ভুলে গেছে। বাড়িতে থাকবে বলেও থাকেনি। জুলেখা বাড়িতে এসে দেখে যার জন্য এসেছে, সে নেই। অগত্যা কিরণময়ীর সঙ্গে বসে বসে গল্প করেছে জুলেখা। কিরণময়ী জুলেখাকে স্নেহ করেন, তার কষ্টে তিনি আহা আহা করেন। কিন্তু সুরঞ্জনের সঙ্গে প্রেমটা জুলেখার আরও বেশি গভীর হোক, তিনি যে চান না, জুলেখা বোঝে।
একদিন কিরণময়ী জিজ্ঞেস করলেন— দেখো, সময়টা তোমার খারাপ যাচ্ছে। এই সময় ডাক্তার-টাক্তার ভালোভাবে দেখিও। শরীর যেন খারাপ না করে।
- শরীর তো আমার ভালোই আছে। জুলেখা বলেছিল।
কিরণময়ী বলেছিলেন- দেখো আবার যেন পেটে বাচ্চাটাচ্চা না চলে আসে। ঝামেলা যেন না হয়।
জুলেখা শরমে মুখ নত করেছে। একটা কথাও বলতে পারেনি। জুলেখা জানে, সুরঞ্জনের সঙ্গে সম্পর্কের কোনও পরিণতি নেই। সম্পর্কটা এ রকমই থেকে যাবে যতদিন না দুজনের দুজন থেকে মন ওঠে, শরীরের আকর্ষণ ওঠে। একত্রবাস তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বিয়ে না হলেও যদি একত্রবাস হতো, মামার বাড়ি যন্ত্রণা থেকে সে যদি মুক্তি পেতে পারতো, যদি সুরঞ্জনের ঘরে এসে উঠতে পারতো, হয়তো এই কলকাতা শহরে চেষ্টা চরিত্রির করে ভালো একটা চাকরি সে পেতে পারতো। কারণ কোথাও তার ফিরে যাওয়ার নেই। সিউড়ি ফিরে যাওয়ার কোনও কারণ তার নেই। ওখানের দুর্বিষহ জীবন জুলেখা বেশ কল্পনা করতে পারে। ওই জীবনের মধ্যে গেলে লোকে তাকে ছিঁড়ে খাবে, বাঁচতে চাইলে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ থাকবে না।
আত্মহত্যা করলে লোকে খুশি হবে সে জানে। এমনকি তার বাবাও খুশি হবে। কিন্তু কাউকে খুশি সে করতে চাইছে না। তার জীবনটা অন্য কারও নয়, সম্পূর্ণই তার। তার জীবন। এই জীবনটাকে সুযোগ পেলেই লোকে কেবল পায়ে মাড়িয়ে যেতে চাইবে, তা সে কেন হতে দেবে? কোনও অন্যায় সে করেনি। তার স্বামীর অন্যায়ের প্রতিশোধ লোকে তার ওপর নিয়েছে। তার প্রতি আরও বেশি আদর, আরও বেশি আবেগ না ঢেলে উল্টো তার গায়ে হাত তুলেছে। কোনও আত্মীয় কোনও বাবা তো তখন কাছে আসেনি। বাবাকে সে ফোন করে বলেছিল, এক বাবাকেই কেঁদে কেঁদে জানিয়েছিল যে স্বামীর কৃতকর্মের প্রতিশোধ নিতে তাকে ধরে নিয়ে কিছু ছেলে ধর্ষণ করেছে, বাড়িতে ফেলে গেছে। শুশ্রূষা করার বদলে স্বামী তাকে জঘন্যভাবে মেরেছে। এ সময় বাবা বললেন— স্বামীর পায়ে ধরে মাফ চা জুলেখা।
- মাফ চাইবো কেন বাবা। কী অন্যায় আমি করেছি?
- মাফ চা। ও তোর স্বামী। ও তোকে মারতেই পারে।
- মাফ কেন চাইবো বাবা? কী দোষ তার কাছে আমি করেছি, বলে দাও। কিছু লোক আমাকে কিডন্যাপ করেছিল। এটা আমার দোষ? আমার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে না? আমাকে একটু আদর করে কথা না বলে তুমিও চিৎকার করছো?
বাবা আগুন হয়ে আছেন ওদিকে রেগে। মাফ না চাইলে তিনি মেয়েকেও মাফ করছেন না এমন। মাফ জুলেখা চায়নি। কারণ, কী অন্যায়ের জন্য সে মাফ চাইবে, সে জানে না। কারণ সে মনে করে না কোনো অন্যায় সে করেছে। অন্যায় করেছে সুরঞ্জন আর তার বন্ধুরা, করেছে মহব্বত।
জুলেখার কী উচিত জুলেখা তখন জানে না। তখন সে বিভ্রান্তির ঘোরে গিয়ে পৌঁছেছিল সিউড়িতে। প্রথম সে তার বড় বোনের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। সুলেখা ফোনে বলে দিয়েছে, শ্বশুরবাড়িতে জুলেখার ঢোকা তো অসম্ভব। বাইরে? ঠিক এই সময়টায় বোনের সঙ্গে দেখা করলে খবরটা জানাজানি হয়ে গেলে তার শ্বশুরবাড়ির অশান্তি হবে। তার চেয়ে জুলেখা যদি মাসখানিক পর আসে, পরিস্থিতির উন্নতি হলে সুলেখার দেখা করায় কোনও অসুবিধে হবে না।
এরপর রবিউল ইসলাম আর সুলতানা কবীরের সঙ্গে দেখা করেছে তাদের সিউড়ির বাড়িতে। দুপুরবেলায় চা-বিস্কুট জুটেছে। এবং কেউ চায়নি জুলেখা অনেকক্ষণ সময় ব্যয় করুক বাড়িতে। গিয়েছিল তাদের সমর্থন পেতে, তাদের পাশে পেতে না, কারও কাছে তার কোনও আশ্রয় মেলেনি। দুজনই উপদেশ দিয়েছেন তাকে বাপের বাড়ি চলে যেতে।
বাপের বাড়িতে গিয়ে কী করবে জুলেখা? সকলে ঘেন্না দেবে। আর তখন একটাই পথ খোলা থাকবে, আত্মহত্যা করা। অথবা নতুন কোনও বদমাশকে বিয়ে করা। কোনও ভদ্র-শিক্ষিত লোক তো বিয়ে করতে চাইবে না জুলেখাকে। তালাকপ্রাপ্তা হয়ে যে অন্যায় সে করেছে, তার চেয়ে অন্যায় করেছে হিন্দু দ্বারা অপহৃত হয়ে, ধর্ষিতা হয়ে এবং তার চেয়েও বেশি অন্যায় সে করেছে হিন্দুর সঙ্গে প্রেম করে।
বাবাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে হয় জুলেখার। পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা। বাড়িতে কাজের লোক, আর একটি দূরসম্পর্কের ভাইপো। এই নিয়ে বাবার সংসার। বাবার আগের পক্ষের একটি ছেলে, জুলেখার সৎ ভাই, সতেরো- আঠারো বছর আগে, যখন ছোট জুলেখা, রহমান চলে গিয়েছিল কাশ্মীরে। প্রথম প্রথম চিঠি পাঠাতো, তারপর আর পাঠায়নি, তার খোঁজও পাওয়া যায়নি। রহমানের একটি ছবি ফ্রেমে ঝোলানো বাড়ির দেয়ালে। কাশ্মীরে চলে যাওয়ার পর থেকেই ঝোলানো আছে ছবিটা। জুলেখা কোনও দিন জানতে পারেনি কেন সে কাশ্মীর গিয়েছিল, কেনই সে কোনও দিন আর ফেরেনি। তার বাবা হেন দিন নেই, ছবিটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেননি।
বাবার প্রথম পক্ষও অকালে মারা গেছেন। দ্বিতীয় পক্ষও। দুটো কন্যা ছাড়া আর কিছু জন্ম দিতে পারেনি বলে দ্বিতীয় পক্ষকে কম গঞ্জনা সইতে হয়নি। জুলেখা ট্রেন স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল আর সেই গঞ্জনাগুলো তার মনে পড়ছিল। দিনভর গালি, থুতু, খোঁটা পেত আর গভীর নিস্তব্ধ রাতে মিহি সুরে যা কাঁদতো। সুলেখা-জুলেখা কোনও দিনই মার দুঃখ এতটুকু দূর করতে পারেনি। কী অসুখে ভুগে মা মারা গেল, তা কেউ জানে না । চিকিৎসা হলে তো জানতে পারতো। মায়ের তার কোনও চিকিৎসা হয়নি। পেটে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। বাবা বলতো, খাওয়াটা বেশি হয়ে গেছে বোধহয়, তাই ব্যথা। পুরো এগারো বছর বাবা তাই বলেছে, মার খাওয়াটা বেশি হয়ে গেছে। হাতের কাছে যা পায় মা নাকি তাই খায়। কোনও নাকি বাছবিচার নেই।
জুলেখা দ্রুত হাঁটে স্টেশনের দিকে। পেছনে তার বাড়ি, যে বাড়িতে সে জন্মেছে, বড় হয়েছে। বিয়ে হওয়ার আগ অবধি যে বাড়িটি ছিল তার ঠিকানা। তার স্কুল মাস্টার বাবা শুয়ে আছে উঠোনের চৌকিতে। ঘরের দেয়ালে ঝুলে আছে রহমানের ছবি। কাজের ছেলেটি বাবা যা চাইছে তাই দিচ্ছে, কোনও বন্ধু বা আত্মীয় এলে তার সঙ্গে কথা বলছেন, আর জুলেখাকে ত্যাজ্য কন্যা করে দেবেন, এ রকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। মনে মনে কামনা করছেন, জুলেখা মরুক। জুলেখা হাঁটে। কুলকুল করে ঘামছে সে। তার মনে হতে থাকে এ তার নতুন জীবন, যে জীবনের দিকে সে যাচ্ছে। এ জীবনে সে নিজে ছাড়া তার আর কেউ নেই। জুলেখাকে কবর দিয়ে দিয়েছে তার সমাজ। নতুন কোনও সমাজের দিকে সে এগোচ্ছে, যে সমাজটা তাকে গ্রহণ করবে। কারণ কিছুতেই সে সমাজের বাইরে এলাকায় যেতে পারবে না। সমাজের সবুজ বাতির লোকদের শরীর শান্ত করতে লালবাতি এলাকায় সে জীবন উৎসর্গ করতে পারবে না। যেদিন ওখানে যাওয়ার তার সময় হয়, সেদিন সে নিজেকে নিজে কথা দেয়, আত্মহত্যা করবে।
চলবে.......
১৫ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
জনপ্রিয় প্রথাবিরোধী লেখিকা তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের ২৫ আগষ্ট ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সাল অবদি চিকিৎসক হিসেবে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলেন।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে লেখালেখি নয়তো চাকুরি ছাড়তে বললে তিনি লেখালেখি ছাড়েন নি। বরং সরকারি চিকিৎসকের চাকুরিটিই ছেড়ে দেন তিনি। তখন এই লেখিকাকে কেন্দ্র করে উগ্র মৌলবাদীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিলো পুরো দেশ। বেশ কিছু মামলাও হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে। শেষে এককথায় বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করেন নারীমুক্তির অন্যতম অগ্রপথিক তসলিমা নাসরিন। এরপর তিনি নির্বাসিত অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন