উপন্যাস : শরম
লেখিকা : তসলিমা নাসরিন
গ্রন্থ : শরম
প্রকাশকাল :
জনপ্রিয় লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বহুল আলোচিত উপন্যাস 'লজ্জা'। ১৯৯৩ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের প্রথম ছয় মাসেই বইটি পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বৈধ কপি বিক্রি হয়। এরপর ধর্মীয় মৌলিবাদিদের একতরফা বিতর্কের মুখে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালিন বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি লেখার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে।পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা হয়েছিলো লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। সেই অনুভূতিকে পুজি করে তিনি লিখলেন নতুন উপন্যাস 'শরম'। এ উপন্যাসটি কবিয়াল পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
![]() |
শরম || তসলিমা নাসরিন |
11111111111111111111111111111
১৪ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
শরম || তসলিমা নাসরিন (পর্ব - ১৫)
জুলেখা সিউড়ির অভিজ্ঞতা সুরঞ্জনকে বর্ণনা করেনি। সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করেছিল— কী করলে বলো।
- কত কিছু।
- কত কিছু কী? পুরনো প্রেমিকদের সঙ্গে দেখা করলে?
জুলেখা হাসতে হাসতে বলেছে— হ্যাঁ। হ্যাঁ ওদের সঙ্গে পালাবো। তোমার চেয়েও হ্যান্ডসাম ওরা।
- তো, চলে এলে যে!
- এলাম, দেখতে এলাম!
- কাকে?
- কাকে আবার? তোমাকে।
- কী দেখতে এলে, তোমার বিরহে কান্নাকাটি করছি?
- না না না, সে দেখার সৌভাগ্য কি আমার হবে?
- কোনও অঘটন ঘটাওনি তো সিউড়িতে?
- অঘটন ঘটানোর শক্তি কি আমার আছে? অঘটন তো অন্যরা ঘটায়, আমি তার সাক্ষী হই বা শিকার হই।
কথাটা তীক্ষ্ণ। জুলেখা জানে না কথাটা বেঁধে সিউড়ি সম্পর্কে আর কোনও কিছু সুরঞ্জন জানতে চায় না। জুলেখারও আগ বাড়িয়ে বলার কিছু ছিল না। তার দিদি আর গুরুজনদের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেয়েছে, তা আর সবাইকেই সে বলতে পারে, কিন্তু সুরঞ্জনকে সে পারে না। তাকে সে যদি নিজ মুখে বলে যে আমাকে আসলে দূর দূর করে তাড়িয়েছে ওরা, সুরঞ্জনের মনে হতে পারে, এখন তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে, তার সাহায্য চাইছে সে। জুলেখা বরং এমন ভাব দেখায় যে কিছুই হয়নি মন্দ যেন জুলেখা যা করছে, তাতে সবারই মত আছে, সমর্থন আছে। আত্মীয়-বন্ধু সবাই আশ্বাস দিয়েছে সহযোগিতা করার। তার মতো করে জীবন তাকে যাপন করতে বলা হয়েছে। সবারই শুভকামনা, তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তার জন্য ছিল এবং আছে। পরিবার থেকে, গোত্র থেকে, সম্প্রদায় থেকে, সমাজ থেকে সকলেই জুলেখাকে বাহবা দিচ্ছে।
কেন বলবে সে সুরঞ্জনকে সব কথা? আত্মসম্মান বলে কিছু তো এখনও তার অবশিষ্ট আছে। সত্যিকার আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে সে থাকতে চায়। কোথাও কোনও কাজ সে করতে চায়। কোনও স্কুলে মাস্টারির চাকরি যদি সে পেতে পারতো। সুরঞ্জনের তো জানাশোনা আছে কলকাতা শহরে। নিজেও সুরঞ্জন অনেকদিন শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছে। যদি সে ইচ্ছে করতো, হয়তো জুলেখাকে এই সাহায্যটুকু করত। জুলেখা কারও কাছে কিছু প্রত্যাশা করে না, করতে চায় না, তার পরও মনের গভীর কোনও কোণে লুকিয়েই থাকে কিছু প্রত্যাশা। যেমন খুব গোপনে সুরঞ্জনের কাছে ছিল, ছিল তার বড় বোনটির কাছে যে সুলেখা হয়তো ফেরাবে না, হয়তো রবিউল আর সুলতানার কাছে ছিল। ভরসা করার জন্য জুলেখারতো আর কয়েক শ লোক ছিল না, হাতে গোনা কজন মাত্র। প্রত্যাশার সঙ্গে আবার সে একা একা লড়তে থাকে। একে সে জীবন থেকে পুরোপুরি ছুটি দিয়ে দিতে পারলে সত্যিকার মুক্তি পাবে।
যাদের কেউ নেই, কিছু নেই, যাদের কোনও স্বপ্ন নেই, তারা কি এই শহরে বেঁচে নেই, যারা শুধু বেঁচে আছে বলে নিশ্বাস নেয়, যারা শূন্য চোখে শূন্য বুকে বসে থাকে অসীম শূন্যতার দিকে তাকিয়ে, তাদের মতোও তো হতে পারে জুলেখা।
মামাবাড়ির তেল চিটচিটে বালিশ আর পেচ্ছাবের গন্ধে ভরা বিছানার চাদরটি গায়ে জড়িয়ে জুলেখাকে শুতে হয়, তাও আবার পেচ্ছাব-পায়খানার হাঁ হয়ে থাকা দরজার দিকে মুখ করে। সুরঞ্জন যদি দেখতো কোথায় ঘুমোয় জুলেখা, কীভাবে এই বাড়িতে সে থাকে, কীভাবে প্রতিদিন! জুলেখার সন্দেহ হয়, তার দুর্ভোগ দেখে সুরঞ্জনের কোনও মমতার উদ্ৰেক আদৌ হবে কিনা, হয়তো চুক চুক করে কিছু দুঃখ করবে— এর বেশি কিছু নয় জুলেখা নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে, ওরই বা কী ক্ষমতা। ও নিজেই তো দুরবস্থার মধ্যে আছে। ওর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড তো কবেই ভেঙে বসে আছে। দৃশ্য দেখলে বরং সুরঞ্জনের ওপর চাপ বাড়বে। তার চেয়ে ও যদি না দেখে, তাহলে জুলেখার মনে হবে, দেখলে হয়তো সে এখান থেকে জুলেখাকে বের করে নিয়ে যেত। আর দেখলে যদি বের করে নিয়ে না যায়! এই ভয়ে জুলেখা চায় না সুরঞ্জন দেখুক কিছু। কারণ সে যে করেই হোক চায় পরস্পরের প্রতি তাদের উত্তাপ এবং আকর্ষণটা থাকুক, বেঁচে থাকুক। এটা জুলেখার কাছে এখন সব দুঃখ মোচনের জায়গা হয়ে গেছে । সুরঞ্জন না থাকলে, জুলেখার জগৎ ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। অন্তত একটি লোককে জুলেখা পেয়েছে, যে শরীরের সম্পর্কে গিয়েছে, কিন্তু তাকে কোনও দিনই ধর্ষণ করেনি। জুলেখা না চাইলে সুরঞ্জন তাকে কোনও দিন স্পর্শও করে না। সুরঞ্জন ধীরে ধীরে তার নিজের অজান্তেই জুলেখার জীবনের একমাত্র সুখ হয়ে উঠেছে। ওকে কোনও রকম দায়িত্ব আর কর্তব্যবোধের ধারে-কাছেও জুলেখা যেতে দিতে চায় না। সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে হলে মুক্তির দরকার, বন্ধন নয়। আসলে, সম্পর্ক যদি মুক্তি না দেয়, বন্ধন দেয়, তবে সম্পর্কে আনন্দ রইলো কই! সম্পর্ক যদি জগদ্দল পাথরের মতো হয়, তবে সেই সম্পর্ক কোনও স্বস্তি দেবে না।
সুরঞ্জনের থাকুক না জানা সব। সুরঞ্জন জানুক, মামাবাড়িতে খুব একটা কিছু অসুবিধে হচ্ছে না। জানুক যে, চাকরিটাও বেশ চলছে, শপার্স স্টপে মাইনে তার পাঁচ হাজার, বছর বছর মাইনে বাড়বে। জানুক যে সোহাগ দিনরাত মায়ের জন্য কাঁদছে। কিছু ভালো জিনিস জুলেখাকে নিয়ে জানুক সে। এটুকুও যদি না জানে সে, তবে তো জুলেখা তার কাছে গণধর্ষণের শিকার, স্বামীর মার খাওয়া, তালাক পাওয়া অসহায় নারী ছাড়া আর কিছু নয়। এবং দ্বিতীয়বার সে চায়না তার জন্য সুরঞ্জনের করুণায় উদ্রেক হোক। করুণার জায়গায় ভালোবাসা ঢুকেছে। আবার সে চায় না ভালোবাসার জায়গায় করুণা ঢুকে গিয়ে সর্বনাশ করুক তার।
মাঝে মাঝে অবশ্য এ নিয়ে সংশয় হয় জুলেখার, আসলেই কি সুরঞ্জনের মনে তার জন্য কোনও ভালোবাসা আছে? নাকি তাকে বিনা পয়সায় বিনা দায়িত্বে ভোগ করার একটা চমৎকার সুযোগ সে পেয়ে গেছে মাত্র, আর কিছু নয়। এ শহরের কোনও মেয়ের সঙ্গে তার এই সম্পর্ক হতে পারতো না। যে কোনও মেয়েই দাবি করতো অনেক কিছু, অথবা বলতো বিয়ে করবে। আর তা যদি না হয়, তবে তো সোনাগাছি আছে। ওখানেও ঝুঁকি আছে, পয়সা খরচা আছে। জুলেখা সুরঞ্জনের অর্থনৈতিক-সামাজিক- পারিবারিক অবস্থায় কোনও অসুবিধে সৃষ্টি করছে না। বরং দিচ্ছে কেবল অকাতরে তাকে। হৃদয় এবং শরীর এই দুটোই নিঃশর্তভাবে দিচ্ছে। মানুষ কি কেবল দিয়েই যেতে পারে ক্রমাগত? জুলেখার খুব একা লাগে।
একা লাগাটির প্রয়োজন আছে খুব। চোখ ফেটে যখন জল চলে আসতে চায় জুলেখা আটকে রাখে। তার চোখের জল ফেললে চলবে না। প্রতিদিন কয়েকটা খবরের কাগজ কিনে এতে চাকরির সুযোগের দিকে ঝুঁকে থাকে। যে চাকরিটি সে করছে, অনুভব করে, ইউনিফর্ম পরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকার কাজের চেয়ে আরও ভালো কাজ করার যোগ্যতা তার আছে। যদি পেয়ে যায়, সে চলে যাবে এই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও। সোহাগ ভালো আছে। সে যদি মাকে ভালোবাসে, মাকে খুঁজে নেবে সে। সুরঞ্জনও যাবে, যদি ভালোবাসে। পার্ক সার্কাসে সুরঞ্জনের থাকা, বেলঘরিয়ার এত দিনের বাস ছেড়ে চলে আসা, জুলেখার মনে হয় না, যতই সুরঞ্জন দাবি করুক যে তার জন্য, আসলে তার জন্য নয়। এর পেছনে অন্য কোনও কারণ নিশ্চয়ই সুরঞ্জনের আছে।
চলবে.......
১৬ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
জনপ্রিয় প্রথাবিরোধী লেখিকা তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের ২৫ আগষ্ট ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সাল অবদি চিকিৎসক হিসেবে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলেন।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে লেখালেখি নয়তো চাকুরি ছাড়তে বললে তিনি লেখালেখি ছাড়েন নি। বরং সরকারি চিকিৎসকের চাকুরিটিই ছেড়ে দেন তিনি। তখন এই লেখিকাকে কেন্দ্র করে উগ্র মৌলবাদীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিলো পুরো দেশ। বেশ কিছু মামলাও হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে। শেষে এককথায় বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করেন নারীমুক্তির অন্যতম অগ্রপথিক তসলিমা নাসরিন। এরপর তিনি নির্বাসিত অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন