উপন্যাস         :         শরম 
লেখিকা          :         তসলিমা নাসরিন
গ্রন্থ               :         শরম 
প্রকাশকাল      :       

জনপ্রিয় লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বহুল আলোচিত উপন্যাস 'লজ্জা'। ১৯৯৩ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের প্রথম ছয় মাসেই বইটি পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি বৈধ কপি বিক্রি হয়। এরপর ধর্মীয় মৌলিবাদিদের একতরফা বিতর্কের মুখে উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালিন বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি লেখার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে। 

পরবর্তীতে 'লজ্জা' উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা হয়েছিলো লেখিকা তসলিমা নাসরিনের। সেই অনুভূতিকে পুজি করে তিনি লিখলেন নতুন উপন্যাস 'শরম'। এ উপন্যাসটি কবিয়াল পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
শরম || তসলিমা নাসরিন
শরম || তসলিমা নাসরিন

11111111111111111111111111111

১৮ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

শরম || তসলিমা নাসরিন (পর্ব - ১৯)

আমি ঠিক বুঝতে পারি না কী বলা উচিত আমার। জুলেখাকে সুরঞ্জন কোনও ফাঁদে ফেলছে, নাকি এ সত্যিই কোনও ভালোবাসার সম্পর্ক! এসব নিয়ে ভাবলে আমার মাথা বনবন করে। চা করতে চলে যাই। চা মিনতিকে করতে বললেই হয়। কিন্তু আমি কেন নিজেই করতে যাই। ভালো লাগছে না বলে ওদের সামনে বসতে! কেন ভালো লাগছে না। ওরা যদি পরস্পরকে ভালোবাসে, তবে তো আমারই সবচেয়ে খুশি হওয়ার কথা। তার মানে সুরঞ্জন এখন আর কট্টরপন্থী নয়, এখন সে উদার, যাকে সে ভালোবাসে তার ধর্ম দেখে না সে।

চা করতে অনেকটাই সময় নিতে থাকি। হঠাৎ রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় সুরঞ্জন।
আপনার কী হয়েছে? সোজা প্রশ্ন।
- কেন, কিছু হয়নি তো।
- চলে এলেন যে।
- চা করছি।
- চা করতে হবে না। আসুন। কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যাই।
- চা খেয়ে যাও।

সুরঞ্জন খুব গভীর চোখে আমার দিকে তাকায়। যেন আমার অন্তরাত্মা ভেদ করে যাবে সে। যেন কোনও ভাবনাই আর আমার থাকতে দেবে না ও। ভাবনাগুলো তার যে করেই হোক দেখা চাই।
- ওর সঙ্গে কী সম্পর্ক তোমার?
- কার সঙ্গে?
- মেয়েটা, যাকে এনেছো।
- ওহ, জুলেখার সঙ্গে? কী বলবো!
- বলে ফেলো!
- বন্ধুত্ব।
- শুধু বন্ধুত্ব?
- আসলে বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি।
- প্রেম?
- হ্যাঁ, প্রেম ..। তা বলা যায়।
- ও।
- কেন? গল্প লিখবেন?
- না না।
- আপনার তো আবার যা দেখেন, যা শোনেন লিখে ফেলার অভ্যেস।
- কেন, তোমাদের কথা লিখে কি ভুল করেছি?
- কী লাভ হয়েছে আমাদের?
- লাভ-এর জন্য লেখা? ইনফরমেশানটা দিচ্ছি, এটা যথেষ্ট নয়? 
- ইনফরমেশান দিয়ে কী দরকার, যদি লাভ না হয়? যদি কিছুরই পরিবর্তন না হয়!
- তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
- ধরুন আমার পা ভেঙে গেছে, আপনি সেটা বিস্তারিত লিখে মানুষকে জানিয়ে দিলেন। মানুষ শুনে টুনে চলে গেল। আমি পা ভাঙা অবস্থায় যেমন আছি, তেমনই রয়ে গেলাম। সেইজন্যই বলছি জানিয়ে কী লাভ। যদি আমার ভাঙা পায়ের কোনও ট্রিটমেন্ট না হয়, তবে জানিয়ে তো কোনও লাভ নেই।
- ক্ষতি তো নেই? রাগ ফুটে ওঠে আমার চাপা স্বরে।
ততোধিক রাগত গলায় সুরঞ্জন বলে, - হ্যাঁ ক্ষতি আছে।
- কী ক্ষতি?
- আমাকে কেউ খেলায় নেবে না। আমাকে কেউ গোনায় ধরবে না। ভাববে আমি পঙ্গু। আমি আউটকাস্ট। আমার পা ভালো হয়ে গেলেও আমি আর শক্ত সমর্থ বলে ট্রিটেড হব না।
আমি থামিয়ে দিয়ে বলি, - এটা কোনও কথা না ..
আমাকে থামিয়ে সুরঞ্জন বলে, - হ্যাঁ কথা। 
সুরঞ্জনের চোখে স্থির চোখে তাকিয়ে বলি, - এ নিয়ে পরে তোমার সঙ্গে আমি কথা বলবো ..

আমি চা নিয়ে ড্রইংরুমে এলাম। জুলেখা জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আপনি কোথায় থাকেন, কী পড়েছেন, কী করেন, আদি বাড়ি কোথায়, ভাই বোন কজন ইত্যাদি জিজ্ঞেস করি, কিন্তু জিজ্ঞেস করি না আসল কথাটা, যেটা মন কামড়ে বসে আছে, সুরঞ্জনের সঙ্গে আপনি কি প্রেম করেন? জুলেখা ধীরে ধীরে উত্তর দেয়। মফস্বলের একটা সাধারণ মেয়ে বলে তাকে মনে হয়। নিরীহ গোছের কিছু। এর সঙ্গে সুরঞ্জনকে ঠিক মানায় না। কেন মানায় না ভাবতে থাকি। আমি তো বাহির দেখতে কেমন, তা নিয়ে ভাবার মানুষ নই। মানুষের ভেতরটা কেমন, তা দেখি। যদি না মেলে মনে, তবে তো সম্পর্কের পাথর বয়ে বেড়াবার কিছু নেই।

সম্পর্ক ওদের যাই হোক না কেন, আমি কেন মাথা ঘামাচ্ছি! সুরঞ্জন আমার উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ছাড়া কিছু তো নয়। ওর সঙ্গে বহু বছর পর হঠাৎ দেখা। কেমন আছে কী করছে সৌজন্যবশত জানতেই পারি। কিন্তু আমার ভুলে গেলে চলবে না যে বাংলাদেশের সুরঞ্জন আর এখানকার সুরঞ্জনে আকাশ পাতাল তফাৎ। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের তফাৎটাই তো বিশাল। সুরঞ্জন তখন সংখ্যালঘু, এখন সে সংখ্যাগুরু। সংখ্যাগুরুর পক্ষে তাবৎ সমাজ। সুতরাং তার দারিদ্র্য নিয়ে চোখের জল ফেলার কিছু নেই। সুযোগ পেতে চাইলেই সে সুযোগ পেয়ে যাবে অবস্থার পরিবর্তন করার। জুলেখার সঙ্গে সম্পর্কটা তার সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তার যদি ভালো লাগে একটা মুসলমান মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে, তবে অসুবিধে কী।

সুরঞ্জন জুলেখার পাশে বসে। একটু ঘনিষ্ঠভাবেই বসে। আমি ঠিক বুঝতে পারি না, ঘনিষ্ঠভাবে সময় কাটানোও ওদের এখানে আসার উদ্দেশ্য কি না। হতে পারে দুজনের বাড়িতেই এখন এ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তাই জায়গা খুঁজছে কোথাও ঘনিষ্ঠ হবার। নাকি আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে! জরুরি কোনও কথা ওদের আছে বলেও আমার মনে হয় না। উঠে স্টাডিতে চলে যাই। এত লেখার কাজ অথচ কিছুই করছি না। আলমারিতে থরে থরে সাজানো বই, কবে এগুলো পড়বো, কবে মাথায় বসে থাকা ভাবনাগুলো লেখায় নামাবো। সুরঞ্জন আর জুলেখা বরং ও ঘরে বসেই নিভৃতে সময় কাটাক।

ডেস্কে কম্পিউটারের সামনে বসে ইয়াহু ম্যাসেনজারে মেসেজ পাঠাতে থাকা ইয়াসমিনের কী করছো, কোথায় তুমির উত্তর লিখে দিই, সুরঞ্জন এসেছে, কথা বলছি।
- হু ইজ সুরঞ্জন?
- লজ্জার সুরঞ্জন।
- তাই নাকি লিখে ইয়াসমিনের পঁচিশটা বিস্ময় চিহ্ন। ওয়াও, ওরা আছে কেমন?
- আছে খুবই ভালো। আচ্ছা বল তো তুই, সুরঞ্জন আমার শান্তিবাগের বাড়িতে কবার গিয়েছিল?
- তুমি বলেছিলে দুবার।
- কেন, তুই দেখিসনি?
- না, কী করে দেখবো!
- ডিসেম্বরে থাকিস না তুই শান্তিবাগে?
- না না না বুবু, তুমি এত ভুলে যাও কেন। ৬ ডিসেম্বর ভালোবাসার জন্ম হল। আমি তো তখন ময়মনসিংহে।
- ও তাইতো!

এটুকু কথা হতেই মিনতি এসে বললো, ওরা চলে যাচ্ছে।
আমি লেখা ফেলে দ্রুত ওদের কাছে গেলাম। কেন, কী হয়েছে। এক্ষুনি যাওয়ার কী হল!
- যেতে হবে।
- আর বসবে না?
সুরঞ্জন বললো, - না।
- কী হল, ক্ষেপেছো নাকি?
- না না।
- এত না না কেন? সুরঞ্জনের হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিই।
জুলেখা মিহি গলায় বলে, - আমাদের যেতে হবে।

জুলেখার এই কথা শুনে সুরঞ্জন দাঁড়িয়ে যায়। আমি ঠিক বুঝি, তার ইচ্ছে না করলেও এটা জুলেখার সিদ্ধান্ত যে তারা যাবে এখন।
- আপনার কোনও গল্পই কিন্তু আমার শোনা হল না জুলেখা। 
জুলেখা একটু হেসে বলে, - আমি তো বিখ্যাত কেউ নই, আমার গল্প লিখে কী লাভ!
- কে বললো আমি আপনার গল্প লিখতে চাই।
জুলেখা হেসে বললো, - আমিই বললাম।
গল্প লিখে লাভের কথা উঠলো। বললাম, - কার লাভের কথা বলছেন?
জুলেখা কোনও উত্তর দিল না। বললাম, - আমি কি বিখ্যাতদের নিয়ে গল্প লিখি বলে আপনার মনে হয়?
জুলেখা বলে, - লিখে আপনি বিখ্যাত হন, আর যাদের নিয়ে লেখেন, তারাও বিখ্যাত হয়ে যায় রাতারাতি। ঠোঁট টেপা হাসি তার।
- আমি মানি না। সুরঞ্জন তো বিখ্যাত হয়নি। আমার কণ্ঠটি নিরীহ কণ্ঠ।

জুলেখা রহস্যময় হাসলো। আমি সরলতার অনুবাদ করতে পারি, জটিলতারও পারি না। সুরঞ্জন দাঁড়িয়ে জুলেখার হাত ধরলো। তার উষ্ণ হাতে আরেকটি উষ্ণ হাত। আমার চোখ ওই হাতদুটো থেকে ফিরতে চায় না। ওই হাতদুটো দুটো জরুরি চরিত্র হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি কেবল হাঁটু নুয়ে বসে তাদের গতিপ্রকৃতি দেখতে চাই অপলক।

ওরা চলে যাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে একটা বালিশ মুখের ওপর চেপে চোখ বুজে থাকি। বুঝি যে ওদের সঙ্গে আমার আরও সময় ব্যয় করা উচিত ছিল। সুরঞ্জনের কাছে আমি অনেক বড় একজন, তাই সে তার প্রেমিকাটিকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এতই কম আমার উৎসাহ যে ওরা চলে যেতে বাধ্য হল। সুরঞ্জন কি ভেবেছে আমি ওকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছি না! কিন্তু ও একা এলেই বুঝতে পারতো, কতটুকু গুরুত্ব ওকে দিই! সুরঞ্জনের সঙ্গে আমি জানি না কেন, জুলেখাকে দেখতে আমার ভালো লাগে না।


চলবে.......

২০ তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন


লেখক সংক্ষেপ: 
জনপ্রিয় প্রথাবিরোধী লেখিকা তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের ২৫ আগষ্ট ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সাল অবদি চিকিৎসক হিসেবে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলেন। 

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে লেখালেখি নয়তো চাকুরি ছাড়তে বললে তিনি লেখালেখি ছাড়েন নি। বরং সরকারি চিকিৎসকের চাকুরিটিই ছেড়ে দেন তিনি। তখন এই লেখিকাকে কেন্দ্র করে উগ্র মৌলবাদীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিলো পুরো দেশ। বেশ কিছু মামলাও হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে। শেষে এককথায় বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করেন নারীমুক্তির অন্যতম অগ্রপথিক তসলিমা নাসরিন। এরপর তিনি নির্বাসিত অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। 

কবিয়াল
 
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন