উপন্যাস : কেয়া পাতার নৌকা
লেখিকা : রাজিয়া রহমান
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ২২ই ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ইং
লেখিকা রাজিয়া রহমানের “কেয়া পাতার নৌকা” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হল। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২৪ সালের ২২ই ফেব্রুয়ারী থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
কেয়া পাতার নৌকা || রাজিয়া রহমান |
৬ষ্ঠ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
কেয়া পাতার নৌকা || রাজিয়া রহমান (পর্ব - ৭)
রাতে এলাহি আয়োজন করা হলো খাবারের। আলমগীর খেতে বসেছে। আজকে ফাইজানকে নিচে সবার সাথে বসে খেতে হচ্ছে। লতার বাবা নিজেই বললেন, "মাস্টার, এই বেলা আমার সাথে একসাথে বসে খাইও।"
ফাইজানের ইচ্ছে করছে না এখানে বসতে।উপরে খেলে তরু খাবার নিয়ে যেতো।একবার তরুকে দেখতো।কেনো জানি এই মেয়েটাকে দেখা ফাইজানের একটা অভ্যাস হয়ে গেছে।
বলতে ইচ্ছে করে, তরু মাঝেমাঝে ভুল করে একটু হাসতে পারো না তুমি?
বলতে ইচ্ছে করে আরো অনেক কথা। কিন্তু ফাইজান বলবে না।সেই পরিস্থিতি নেই তার।
ফাইজান খেতে বসে দেখলো তরু ও এসেছে। এতো দিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে ফাইজান যতোদূর বুঝেছে এদের ব্যাপারে তাতে তরু এখানে খেতে আসবে এটা ফাইজানের জন্য কল্পনাতীত।
কল্পনাতীত তরুর জন্যও। এখানে এসে খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তরুর ছিলো না। রাবেয়া মেয়েকে অনেক বকাবকি, আদর,অনুরোধ করে রাজি করিয়েছে এখানে আসতে।মেয়েটা দিনদিন কেমন জেদি হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় রাবেয়ার।নয়তো ওর বড় চাচা বলেছে তার সাথে খাবার খেতে অথচ তরু রাজি না আসতে।
উল্টো বিরক্ত হয়ে বললো, "মা এসব ঢং ভালো লাগে না আমার। একদিন এতো আদর দেখাবে। এসব লোক দেখানো আদরের কি দরকার মা।আমি যেভাবে আছি সেভাবেই ভালো। "
আলমগীর নিজের এক পাশে তরুকে বসিয়েছেন অন্যপাশে লতা।বিগলিত হেসে তরুর প্লেটে লেগপিস তুলে দিয়ে বললো, "আম্মাজান,এখন থেকে প্রতিবেলা কিন্তু আমার সাথে বসে খাবার খাইবেন আপনি। আমি আমার দুই মায়েরে দুই পাশে নিয়ে খাবার খামু।"
লতা বিরক্ত হলো বাবার কথা শুনে। এতো আদিখ্যেতা করছে কেনো বাবা!
ফাইজান নিচের দিকে তাকিয়ে খাবার খাচ্ছে নিরবে।আমেনা রাগে ফেটে পড়ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না সবার সামনে স্বামীকে।
খাওয়ার পর ফাইজান কোনো দিকে না তাকিয়ে চলে গেলো।
তরু খাওয়া শেষ করে উঠলো। আলমগীর উঠে গিয়ে একটা স্যুটকেসে এনে তরুর হাতে দিয়ে বললো, "আম্মাজি,এটা আপনার জন্য। বেশি কিছু আনতে পারি নি। যেটুকু সামর্থ্য আমার। "
তরু বুঝতে পারছে না কি করবে।চাচীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে চাচীর মুখ অন্ধকার হয়ে গেছে। সম্ভবত চাচী জানতো না এটা তরুর জন্য এনেছে।
তরুর হাসি পেলো। নেওয়ার ইচ্ছে ছিলো না তরুর কিন্তু চাচীর মুখটা আরেকটু অন্ধকার করতেই মুচকি হেসে স্যুটকেস নিলো তরু।সাথে সাথে আমেনার চেহারা বিকৃত হয়ে গেলো।
তরু চলে যাওয়ার পর আমেনা আলমগীরের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলো।
আলমগীর বিরক্ত হয়ে বললো, "বেশি কথা বলবা না আমেনা।আমার ভাতিজির প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। তোমার তো কোনো কিছুর অভাব দিই না তাইলে তোমার এতো অসুবিধা কিসের?আমি আমার বুদ্ধিতে চলি তোমার বুদ্ধিতে না।"
আমেনা রাগ করে চলে গেলো।
য়রু রুমে গিয়ে দেখে মা এখনো আসে নি।স্যুটকেসের দিকে তাকিয়ে তরুর চোখ ভিজে উঠলো। আব্বা থাকলে তো এরকম কতো স্যুটকেস তরু দেখতো।তরুর কেমন বুকটা শূন্য শূন্য লাগছে। আব্বাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে তরুর।আব্বার গায়ের গন্ধ কেমন তরুর মনে নেই।হঠাৎ করে তরু আব্বা আব্বা বলে কাঁদতে লাগলো।
রাবেয়া মেয়ের কান্না শুনে ছুটে এলো।তরু মা'কে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো।
সপ্তাহ খানেক কেটে গেলো নির্ঝঞ্ঝাটভাবে।চাচার উপর তরুর একটু একটু করে শ্রদ্ধা, সম্মান বাড়ছে।
তবে চাচাকে তরু সেদিন সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো যেদিন আলমগীর তরুর মা'য়ের বিয়ের কথা উঠালো।
রাতে তখন সবাই মিলে খেতে বসেছে। রাবেয়া সবাইকে সব বেড়ে দিচ্ছে।
আলমগীর হাসতে হাসতে বললো, "আর অল্প কয়দিন রাবেয়ার হাতের রান্না খেতে পারবো আমরা। "
সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আলমগীর জানালো তরুর মামার সাথে আলমগীরের কথা হয়েছে। রাবেয়ার বিয়ের ব্যাপারে।
রাবেয়া পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক।
তরুর কেমন একটা কষ্টকর অনুভূতি হতে লাগলো।
রাবেয়া কিছুক্ষণ পর বললো, " আমি কোথাও যাবো না আমার মেয়েকে রেখে।স্বামী সংসার যদি ভাগ্যে থাকতো তাহলে আল্লাহ বিধবা করতো না আমাকে।"
আলমগীর বললো, "তাই বলে তো আল্লাহ নিষেধ করে নি যে স্বামী মারা গেলে দ্বিতীয় বিয়ে করা যাবে না।সেই বিধান তো আছে।"
"আমার আর কোনো কিছু লাগবে না ভাইজান।আপনারা আমাকে না জানিয়ে এসব কথা কেনো বলেছেন আমি জানি না তবে আমি কোথাও আর বিয়ে করবো না।"
আলমগীর গম্ভীর হয়ে বললো, "তোমার বাপ ভাই সবাই চায় তোমার নতুন একটা সংসার হোক।তাছাড়া তপ্রুও বড় হয়েছে। দুদিন পর বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে,তোমার বাকি জীবন পড়ে আছে।বাকি জীবন তুমি কিভাবে কাটাবে?
তরু তো তোমার ছেলে না যে আজীবন তোমার কাছে থাকবে।মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে যখন আজ না হোক কাল দূরে যাবে-ই।
এখন সুযোগ আছে তোমার, এই সুযোগ সবসময়ই থাকবে এরকম তো না ও হতে পারে! "
চাচার কথা তরুর মাথায় ঢুকলো। চাচা ভুল কিছু বলে নি। মা শুধু তরুর কথা ভাবছে,নিজের জীবন নিয়ে কেনো ভাবছে না?
রুমে গিয়ে তরু মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, "মা আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে জানো?তোমার এরকম কষ্ট আমার আর ভালো লাগে না মা।তোমার নিজের একটা সংসার হোক আমি মন থেক চাই।আমি এখন বড় হয়েছি মা,অনেক কিছুই বুঝি এখন।"
রাবেয়া ছলছল নয়নে তাকিয়ে বললো, "এতোটা বড় হয়ে গেছিস যে মা'কে বিয়ে দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিস?"
তরু হেসে বললো, "না মা,সরিয়ে দিচ্ছি কোথায়?তোমার একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেখতে চাই মা।এই কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়ানো জীবন তোমার জন্য না।তুমি রানী হওয়ার জন্য জন্মেছো,এভাবে ভেসে ভেসে আর কতো? "
রাবেয়া তরুর দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা কি হুট করে অনেক বড় হয়ে গেলো না-কি!
এরকম ভারী ভারী কথা কিভাবে বলছে ও?
রাবেয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, "আমি রানী হতে চাই না মা।আমি আমার রাজকন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি জীবন কাটাতে চাই।"
"তা হয় না মা,তোমার জীবনের একটা নিশ্চিত ব্যবস্থা না করতে পারলে আমি নিজের কাছে নিজে অপরাধী হয়ে থাকবো আজীবন মা।সারাজীবন আমি এই অনুতাপ নিয়ে বাঁচবো যে আমার জন্য আমার মা'য়ের জীবন এলোমেলো।
আমি এই গ্লানি নিয়ে বাঁচতে চাই না মা।আমি যতো সুখেই থাকি এই যাতনা আমাকে সুখে থাকতে দিবে না।"
রাবেয়া মেয়ের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। তার ছোট্ট তরু অনেক বড় হয়ে গেছে।
রাবেয়া সারারাত ঘুমাতে পারলো না আর।এই ঘর,এই সংসার তার হাতে সাজানো। এই ঘরটা করার সময় রাবেয়া কি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তা একমাত্র তিনি জানেন আর আল্লাহ জানেন।
অথচ সেসবের দখলদারি এখন অন্য কারো কাছে। তবুও রাবেয়া মেয়েকে নিয়ে পড়ে ছিলো, ভালো ছিলো। অথচ এখন নাকি নিজের সংসার ছেড়ে চলে যেতে হবে তাকে।
এক প্রকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যেনো সবাই।
রাবেয়ার ভয় হয়।তার মেয়ের কি হবে?
সবাই রাবেয়াকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে তরুর জীবন অনিশ্চিত করে ফেলছে না তো!
সারা রাত কেটে গেলো এসব ভেবেই। এরপর ভোর হতেই রাবেয়া কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
বিকেলের দিকে রাবেয়াকে না জানিয়ে পাত্রপক্ষ এলো। রাবেয়া তখন রান্নাঘরের সামনে বসে লাকড়ি বাঁধছে।
তরু পড়তে বসেছে। হুট করে রাবেয়া নিজের ভাইয়ের কথা শুনতে পায়।চমকে দেখে তার বড় ভাই রাজিব এসেছে।
এই অসময়ে ভাইকে দেখে রাবেয়া কিছুটা অবাক হয়ে যায়।
কাহিনি কি বুঝতে পারে আলমগীর যখন আমেনাকে বললো, "রাবেয়া কে সাজিয়ে দাও তো একটু।পাত্রপক্ষ এসেছে রাবেয়াকে দেখতে।"
রাবেয়ার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো এই কথা শুনে। ততক্ষণে তরু,লতা দুজনেই এসে হাজির।
তরুর মুখে ম্লান হাসি।
হেসে তরু বললো, "আজকে আমি তোমাকে সাজিয়ে দিবো মা।"
রাবেয়ার হাত পা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে এসেছে। এই কোন সর্বনাশ হচ্ছে তার?
কেনো এরা সবাই মিলে এরকম উঠে পড়ে লেগেছে!
রাবেয়ার চোখ টলমল করতে লাগলো। আমেনার মুখ গম্ভীর। রাবেয়া চলে গেলে সব কাজ তাকে করতে হবে।আমেনার একটা কাতান শাড়ি পরানো হয়েছে রাবেয়াকে।রাবেয়ার বয়স বেশি না।তাকে সাজানোর পর বেশ রূপবতী লাগছে। কেউ বলবে না রাবেয়ার এতো বড় একটা মেয়ে আছে।
পাত্র,পাত্রের মা,বোন,খালা,মামা এসেছে। রাবেয়াকে সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। আলমগীর উপর থেকে ফাইজানকে ও ডেকে এনেছে। ফাইজান অবাক হয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে আছে। দরজার বাহিরে তরু দাঁড়িয়ে আছে। তরুর চোখ মুখ কেমন শুকনো লাগছে।
মেয়েটার বুকের ভেতর কেমন উথাল-পাথাল করছে কে জানে!
সবাইকে এড়িয়ে তরু চোখ মুছে নিলো। ফাইজান তা দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। আমরা অন্যের কষ্ট কেউ কি কখনো বুঝি!
যার কষ্ট সেই বুঝে আর কেউ না।
মানুষ যতোই বলে অন্যের কষ্ট ভাগ করে নিবে,আদৌও কি তা সম্ভব হয়? হলে ফাইজান অনেক আগেই এই মেয়েটার সব কষ্ট নিজের করে নিতো।
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
Follow Now Our Google News
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
৮ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা রাজিয়া রহমান বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহন করেন। লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন তিনি। তরুণ এই লেখিকা বৈবাহিক সূত্রে লক্ষ্মীপুরেই বসবাস করছেন। বর্তমানে তিনি একটি পুত্র সন্তানের জননী। পেশাগতভাবে তিনি গৃহিনী হলেও লেখালেখির প্রতি তার ভিষন ঝোক। আর তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও শখের বশে ধারাবাহিকভাবে লিখে যাচ্ছেন একের পর এক উপন্যাস। ২০২২ সালের মধ্যদিকে গর্ভকালিন সময়ে লেখিকা হিসেবে হাতেখড়ি নিলেও এরই মধ্যে লিখে ফেলেছেন “তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর” ও “শালুক ফুলের লাঁজ নাই” -এর মতো বহুল জনপ্রিয় উপন্যাস।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন