উপন্যাস : কপোত কপোতীদের গল্প
লেখিকা : আনআমতা হাসান
গ্রন্থ :
প্রকাশকাল :
রচনাকাল : ১০ নভেম্বর, ২০২২ ইং
লেখিকা আনআমতা হাসানের “কপোত কপোতীদের গল্প” শিরোনামের এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘কবিয়াল’ পাঠকদের জন্য উপন্যাসটি পর্ব আকারেই প্রকাশিত হবে। লেখিকা অনবদ্য এ উপন্যাসটি ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখ থেকে লেখা শুরু করেছেন।
![]() |
কপোত কপোতীদের গল্প || আনআমতা হাসান |
11111111111111111111111111111111111
এখানে ক্লিক করে পড়ুন কপোত কপোতীদের গল্প (পর্ব- ৫০)
কপোত কপোতীদের গল্প || আনআমতা হাসান (পর্ব - ৫১)
ছলছল চোখ নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে কিরণ। তার পাশেই অপরাধীর মতো মাথা নিচু দাঁড়িয়ে আছে কুহু। তারা তো যাস্ট একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু বেপারটা যে এতোটা গুরুতর হয়ে উঠবে তা ভাবতে পারেনি। কাব্য রাগী কন্ঠে বললো
- তোমাদের কোন ধারণা আছে, যদি সময় মতো হসপিটালের না নিতাম বা আমার রক্তের গ্রুপ যদি ও নেগেটিভ না হতো তাহলে কি হতো।
ভাইয়ের এই কথা শুনে এবার কেঁদে দেয় কিরণ। ছেলেটাকে এভাবে কাঁদতে দেখে কষ্ট হয় কুহুর। কিরণকে সে নিজের ভায়ের মতো ভালোবাসে। আর কাব্যের কিরণকে বকা ঠিক না। কারণ এই ভয় দেখানো বুদ্ধিটা তার ছিল। জুসের গ্লাসে ছোট খেলনা তেলাপোকাটাও সেই রেখেছিল। কিরণ তো শুধু নাড়ু আর জুসের গ্লাসটা মামির রুমে দিয়ে এসেছে। কুহু কিরণের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে কাব্যকে বললো
- তুমি কিরণকে একদম বকবে না। সব কিছু আমি করেছি। সব দোষ আমার বকতে হলে আমাকে বক।
কাব্য গম্ভীর কন্ঠে কুহুকে বললো
- তুমি বড় হয়েছ কুহু। এখনো বাচ্চাদের মতো দুষ্টমি করো কেন? তাও গুরুজনদের সাথে।
কুহু তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বললো
- গুরুজন! যে পদে পদে তার ননদের ছেলেকে কারনে অকারণে তিক্ত কথা শোনাতে ব্যস্ত থাকে, সে কিভাবে গুরুজন হয়?
কাব্য একনজর কিরণের দিকে তাকায়। ভাইটি তার খুব আদরের। তার চোখে পানি দেখে কাব্যের খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু এখন তাকে শাসন না করলেই নয়। কাব্য একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো
- দেখ মামি আমাকে অপছন্দ করে। ছোটবেলা থেকেই করে। অপমান করে, তিক্ত কথা শুনিয়ে কষ্ট দেয়। তাই বলে তোমাদের এই কাজ করা ঠিক হয়নি। কেউ তোমাকে কষ্ট দিলে, যদি তুমিও উল্টো তাকে কষ্ট দেও। তাহলে তোমার আর মধ্যে তো কোন পার্থক্য নেই, তাই না? আর আল্লাহ না করুক আজ যদি মামির কিছু একটা হয়ে যেত, পারতে শান্তিতে বাঁচতে? প্রতি মূহুর্তে নিজেদের ভিতর একটা অপরাধবোধ কাজ করতো।
কাব্যের এই কথাটা শুনে কুহুর মনে লাড্ডু ফোটা শুরু করে। কাব্য তাকে নিয়ে এতো ভাবে! এতোক্ষণ তো সে ভেবেছিল তার মহা দরদী কাব্য এই মহিলার উপর দরদ দেখিয়ে তাদের বকা দিচ্ছে। কিন্তু না, কাব্য তাদের কথা ভেবে তাদের বকা দিচ্ছে। আহা, কেমন সুখ সুখ বাতাস বয়ে যাচ্ছে গা জুড়ে। কিরণকে কাঁদতে কাঁদতে বললো
- বিশ্বাস করো ভাইয়া আমরা ইচ্ছে করে কিছু করিনি। তোমাকে কটুকথা কথা বলে দেখে, আমরা তো শুধু মামিকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মামি যে খেলনা তেলাপোকাটা দেখে ভয়ে লাফ দিয়ে, খাটের সাথে বাড়ি খেয়ে, এতো ভাজে ভাবে মাথা কেটে ফেলবে তা বুঝিনি। সরি ভাইয়া।
কাব্য কিরণের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার গালে হাত দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো
- আমি জানি তোমরা ইচ্ছা করে করোনি। কিন্তু তাও যেহেতু অন্যায়টা হয়ে গিয়েছে, তাই সরি তো তোমাদের বলতেই হবে। আর মামি আমাকে কটুকথা বললেও মামি কিন্তু খারাপ না। এই মামিই কিন্তু আমাদের মা মরা মাকে আদর যত্ন করে বড় করেছে। সেই হিসেবে তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ।
কিরণ মাথা উপর নিচে নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে কুহুর দিকে তাকায়। কুহু ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো
- চল কিরণ আমরা মামিকে সরি বলে আসি।
এদিকে,
একেই অসুস্থ তার উপর একটা একা মানুষ। ছেলে এক বছর আগে জার্মান গিয়েছে পিএইচডি করতে। স্বামী সকালে অফিসে যায় আসে সন্ধ্যায়। কাজের মহিলা সকালে এসে দুপুরের দিকে চলে যায়। সারাদিন একা বাসায় থাকতে হয়। তাই অসুস্থ ভাবীকে আর বাসায় যেতে দেয়নি মিসেস কবিতা। জোর করে নিজের বাসায় রেখেছে। সেবাযত্ন করছে। এই যেমন এখন গরম গরম স্যুপ তাকে নিজ হাতে খায়িয়ে দিচ্ছে। পাশেই মিসেস মায়া একটা চেয়ারে বসে তাদের সাথে গল্প করছেন আর মুগ্ধ নয়নে দেখছেন মিসেস কবিতাকে। বরাবরই সে মুগ্ধ হয় মিসেস কবিতাকে দেখে। মহিলাটা ভালো। শুধু ভাল না, মহিলাটা যেন অসম্ভব ভালো মনের মানুষ। তা না হলে যে মহিলা তার ছেলেকে সারাক্ষণ অপমান করে, তাকে এতো যত্ন করা কোন মায়ের পক্ষে সম্ভব না। কাব্যটাও হয়েছে মায়ের মতো। এতো অপমান করার পরও কখনো চোখ মুখ কালো করে মামির সাথে কথা বলেনি। সব সময় সম্মান করেছে। কষ্ট পেলেও মামির সামনে তা প্রকাশ করেনি। হাসি মুখে সব সময় কথা বলে। নিজের রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছে। এই মা ছেলের মধ্যে মনে হয় যেন রাগ, ক্ষোভ, অহংকার বলতে কিছুই নেই। তা না হলো মানুষগুলো এতোটা ভালো কিভাবে হয়? মিসেস মায়ার ভাবনার মাঝেই কুহু আর কিরণ রুমের ভিতরে ঢুকে মাথা নিচু করে একসাথে বলে উঠে
- সরি মামি।
কুহু আর কিরণের সরি বলার কারণ বুঝতে না পেরে, মিসেস মায়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল
- তোরা এভাবে সরি বলছিস কেন?
কুহু মাথা নিচু করে অপরাধীর কন্ঠে বললো
- আসলে মা আমিই মামির জুসের গ্লাসে খেলনা তেলাপোকা দিয়েছিলাম। তা দেখে ভয় পেয়ে, লাফ দিয়েই মামি মাথা ফাটায়।
মিসেস মায়া রেগে মেগে মেয়েকে থাপ্পড় দিতে গেলে কাব্য দরজায় থেকে দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। রেগে মেগে মিসেস মায়া বললো
- সামনে থেকে সর কাব্য। এই মেয়েকে আদর করে করে বাদর বানিয়ে ফেলেছি। একে শাসন না করলেই নয়।
মিসেস কবিতা চুপ করে বসে আছে। সে খুব ভালো করে জানে কিরণ আর কুহু এই কাজটা কেন করেছে। সেও যে তার ছেলের জন্য খুব কষ্ট পেত। কয়েকবার তার ভাবিকে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে নাও করেছে। সোজাসাপ্টা কিছু বলতেও পারে না। মাএ বার বছর বয়সে মা-বাবা মারা যাওয়ার পর এই ভাই-ভাবীই তাকে লালন পালন করে বড় করেছে। তাদের সাথে সে কিভাবে খারাপ ব্যবহার করবে। চোখটা ছলছল করে উঠে তার। মিসেস পদ্মা মানে কাব্যের মামি, মিসেস মায়াকে বললো
- মায়া ওকে কিছু বলো না। ওর কোন দোষ নেই। দোষ তো সব আমার। আমি এতো বড় হয়েও কাব্যের মতো এতো ভালো ছেলেকে অকারণে খারাপ কথা বলতাম। আসলে কি জানতো, আমার গায়ের রঙ কালো বলে ছোট থেকেই মানুষের কটু কথা শুনে বড় হয়েছি। কখনো কোন জায়গায় দাওয়াত পড়লে, আমার মা আমাকে নিয়ে যেত না। আমার ছোট বোনকে নিয়ে যেত। আমাকে নিয়ে গেলে নাকি মানুষের কথা শুনতে শুনতে তার কান ব্যথা হয়ে যায়, তাই। আমার কালো রঙ প্রিয়। ঈদের মার্কেটে গেলে যদি কালো রঙের জামা পছন্দ করতাম। তাহলে সেই ড্রেস তো আমার কপালে জুটতোই না উল্টো গায়ের রং নিয়ে গা জ্বালা কিছু কথা শুনতে হতো।
একটু দম ফেলে আবার পদ্মা বললো
- কিশোরী বয়স থেকে ভালোবাসাতাম আমার চাচাতো ভাইকে। যার মেয়ের জন্য কাব্যের বিয়ে কথা বলেছি। তার মেয়েকে কালো ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্যই, আমি কাব্যের সাথে তার বিয়ের কথা বলি। কলেজে পড়ার সময় তাকে প্রপোজ করেছিলাম। তাকে প্রপোজ করতেই সে আঁটো হাসিতে ফেটে পরে। হাসতে হাসতেই আমাকে বলেছিল, "সিরিয়াসলি পদ্মু। তুই ভাবলি কিভাবে, আমার মতো কোন হ্যান্ডসাম ছেলে যার জন্য কত সুন্দরী মেয়েরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যথা করে ফেলেছে। সে তোর মতো অন্ধকার মেয়ের প্রপোজাল একসেপ্ট করবে!"
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে পদ্মা বললো - আগের কষ্ট তো কিছুই ছিল না। আমার জীবনের আসলে কষ্ট তো শুরু হয় বিয়ের বয়স হওয়ার পর থেকে। গায়ের রঙের জন্য একে পর এক পাএ আমাকে রিজেক্ট করে। আমাকে দেখতে এসে আমার ছোট বোনকে পছন্দ করে। এসবে যতটা কষ্ট হতো মা-বাবা, বোন আর দাদীর কথা আর ব্যবহারে তার থেকে বেশি কষ্ট হতো। এমন কোন বাজে কথা বা বকা নেই যা তারা আমাকে দিত না। কয়েকবার মরতে চেয়েছি। কিন্তু ভীতু ছিলাম বলে তা পারিনি। আমার মনে হতো না, আমার কখনো বিয়ে হবে। সে তো আমার কোন পূন্যের ফল ছিল, যে মা-বাবার কাছে টাকা চাইলে খোটা শুনতে হতো বলে টিউশনি শুরু করেছিলাম। আর ভাগ্যক্রমে কবিতাকে টিউশন করাই। কবিতা অনেক শান্ত সৃষ্ট মেধাবী ছিল। আর সে আমার গায়ের রঙের জন্য আমাকে ঘেন্না করতো না। আমাকে সম্মান করতো। তাই আমি তাকে অনেক ভালোবাসতাম। মেয়েটাও আমাকে ভালোবাসতো। আমার এতো এতো কষ্টের মধ্যে এক টুকরো শান্তি ছিল কবিতা। তাই মা-বাবা মারা যাওয়ার পর বোনকে ভালো রাখার জন্য রাহুল আমাকে বিয়ে করে। না হলে কোন নরকে আমার বাকি জীবনটা কাটতো তাই জানিনা।
পুরনো ক্ষত তাজা হতেই চোখে দুটো ছলছল করে উঠে পদ্মার। চোখের জল আটকানোর বৃথা চেষ্ট করে বললো
- যেখানে নিজে কালো ছিলাম বলে মানুষের এতো অপমান, অবহেলা শুনতে হয়েছে। সেখান অন্য একজন আমার থেকেও কালো হয়ে সবার এতোটা ভালোবাসা পায়, সেটা যেন আমার সহ্য হতো না। তাই কাব্যের সাথে এমন করতাম।
কাব্যের দিকে তাকিয়ে দুই হাত জোর করে বললো
- কাব্য বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিস।
কাব্য গিয়ে মিসেস পদ্মার সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেরে বসে, খাটে বসা মিসেস পদ্মার হাত জোড়া ধরে কোমল বললো
- এভাবে বল না মামি। তুমি তো আমার আরেক মা। মাকে খুশি করতে পারার চেয়ে সুখের কিছু, সন্তানের হতেই পারে না। তুমি যদি আমাকে আপমান করে খুশি হও এটা তো আমার সৌভাগ্যের।
মিসেস পদ্মা কাব্যের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। মিসেস কবিতা আর কিরণও কেঁদে দেয়। মিসেস মায়া আর কুহুর চোখের কোণেও জল চিকচিক করছে। কয়েক সেকেন্ড কেঁদে মিসেস পদ্মা কাব্যের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে, মিসেস কবিতার উদ্দেশ্যে বললো
- কবিতারে তুই ছেলে না আস্ত একটা হরের টুকরো জন্ম দিয়েছিস। হিরের টুকরো।
আপনার পছন্দের গল্পের নাম কমেন্টে জানান
সবার আগে সব পর্ব পেতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজে।
চলবে ...
এখানে ক্লিক করে পড়ুন কপোত কপোতীদের গল্প (পর্ব- ৫২)
লেখক সংক্ষেপ:
তরুণ লেখিকা আনআমতা হাসান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে জানতে পারলে অবশ্যই কবিয়াল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হবে।
কবিয়াল
কবিয়াল’এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত কবিয়াল’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় কবিয়াল কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। কবিয়াল’এ প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন